অমাবস্যার অন্ধকার অশুভ, তাই এই বিশেষ রং পুজোয় নিষিদ্ধ! কালী আরাধনার যে যে নিয়ম আজও প্রচলিত
Kali Puja 2022: কেন এই দিনেই করা হয় কালীপুজো? কীভাবে পালিত হয় পুজোর উপাচার?
কার্তিক মাসে কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথি। ঠিক এই দিনই একদিকে আলোর উৎসব। আর অন্যদিকেই শ্যামার পুজোয় মেতে ওঠে দেশ। বিশেষত, বাংলা বুঁদ হয় কালী-বন্দনায়। কিন্তু কে এই কালী? কীভাবে উৎপত্তি তাঁর? কেন এই দিনেই করা হয় কালীপুজো? কীভাবে পালিত হয় পুজোর উপাচার? এদিন কী করলে শুভ, কী করলে বিপদ ঘনাবে আপনার জীবনে? সব প্রশ্নের উত্তর দেব আমরা।
কালী কে
পুরাণ অনুযায়ী, দশমহাবিদ্যার প্রথম যিনি, তিনি হলেন দেবী কালী। তারপরেই রয়েছেন তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতি, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা। মতান্তরে এই সংখ্যার কথা বলা হয় ২৭। এর সঙ্গেই 'মালিনী বিজয়' গ্রন্থে এই রূপের নামের ক্ষেত্রে ভিন্নতা প্রকাশিত হয়। যদিও এই সমস্ত ক্ষেত্রেই কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম, একথা নিশ্চিত করা হয়।
মূলত, মহাদেবের স্ত্রী। পার্বতীর আর একটি রূপ হিসেবে বিবেচিত হন এই দেবী। আবার কেরলের মতো রাজ্যে মহাদেবের কন্যা হিসেবে পূজিতা হন দেবী। সেখানে তাঁকে ভৈরবকন্যা মহাকালী বলা হয়। তবে পুরাণ অনুযায়ী, শিবের কন্যা না স্ত্রী, এ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও অধিকাংশ পুরাণবিদের মতে, কালী শিবের স্ত্রী এবং দুর্গার আর এক রূপ।
শাক্তধর্মের ইতিহাসে এই দশমহাবিদ্যার গুরুত্ব সর্বাধিক। যেখানে কালী শক্তির দেবী হিসেবে অন্যতম এবং প্রতিষ্ঠিত। যদিও উত্তর-পৌরাণিক যুগে পুরুষ দেবতার প্রাধান্যে নারী দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পাবেন কে, এই ক্ষেত্রেও কালী অন্যতম।
কালী-ইতিহাস
পুরাণ অনুযায়ী, কালী শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ। তিনি সময়ের দেবী। জগতের উৎপত্তি, স্থিতি, মন্দের ধ্বংসের দেবী। তান্ত্র মতানুসারে, তিনিই চূড়ান্ত ব্রহ্ম এবং মোক্ষের দেবী।
বেদবেদান্তের যুগে কালীর অস্তিত্ব ছিল। 'অথর্ববেদ' বলে এই দেবীর কথা। পুরাণবিশারদ ডেভিড কিন্সলি দাবি করেন, ৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কালীকে একাধিক গ্রন্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মহাভারতে (১০.৮.৬৪) পাণ্ডবদের স্বপ্নে কালীর অবস্থানের কথা জানা যায়। দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামার আক্রমণের সময় তিনি যুদ্ধের মধ্যে উপস্থিত হন। যুদ্ধে নিহত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মা বহন করেন। এছাড়াও মহাভারতে ভদ্রকালীর উল্লেখ রয়েছে, তিনি দেবী আদিশক্তি পার্বতীর রূপ। আবার 'হরিবংশ' গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
কথকতায় কালী
পুরাণে কথিত আছে, একবার নাকি ঘুমন্ত বিষ্ণুর শরীর থেকে দেবী যোগনিদ্রা রূপে আবির্ভূত হন। জগতের বিপদ মধু এবং কৈটভ নামক দুই অসুরের হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য, বিষ্ণুকে জাগিয়ে তোলা হয় তারপর। বিষ্ণু জেগে ওঠেন। তিনি দুই অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গে দীর্ঘযুদ্ধের পর যখন দুই অসুরকে হারানো গেল না, তখন কালী ওই দুই অসুরকে মোহিত করার জন্য মহামায়ার রূপ ধারণ করলেন। মধু ও কৈটভ কালী দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ হলে বিষ্ণু তাদের হত্যা করেন।
আবার কালীর রোষানলে ধ্বংস হওয়া আরও দুই অসুরের কাহিনি রয়েছে পুরাণে। বলা হয়, চণ্ড-মুণ্ড দুই অসুর দেবী দুর্গাকে আক্রমণ করে। দুর্গা এমন ক্রোধের সঙ্গে সেই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানান, যার ফলে দেবী দুর্গার মুখ কালো বর্ণের হয়ে যায়, যার ফলে কালী তার ত্রিনয়ন থেকে বেরিয়ে আসেন। যে কালীর চেহারা ছিল গাঢ় নীল বর্ণের, পরনে ছিল বাঘের চামড়ার শাড়ি এবং গলায় মানুষের মাথার মালা। তিনি ওই দুই অসুরকে পরাজিত করেন।
পরবর্তীতে একই যুদ্ধে, অসুর রক্তবীজ অপরাজিত থাকে। কারণ, তার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা মাটিতে পড়লেই সেখান থেকে নতুন জীবন তৈরি হচ্ছিল। অগণিত রক্তবীজ তৈরি হচ্ছিল মুহূর্তেই। সেই যুদ্ধে কালী মাটিতে রক্তবিন্দু পৌঁছনোর আগেই তার রক্ত চুষে নেন।
একাধিক ক্ষেত্রে এই কালীর সঙ্গে পার্বতী ও শিবের কথা জড়িত।
পার্বতীকে সাধারণত সৌম্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ দেবী হিসাবে চিত্রিত করা হয়। 'লিঙ্গ পুরাণ' বলে যে, শিব পার্বতীকে একদিন বলেন দ্বারকাসুরকে পরাজিত করতে। যে অসুর বর পায় যে, শুধুমাত্র মহিলা দ্বারাই তাকে হত্যা করা সম্ভব। এরপর এই লক্ষ্য পূরণে পার্বতী শিবের দেহের সঙ্গে মিলিত হন। এরপর যুদ্ধক্ষেত্রে দেবী পার্বতী, কালীরূপে পুনরাবির্ভূতা হলেন। দেবীর বিরাট ক্রোধ বিরচিত হল চারিদিকে। অবশেষে শিবের হস্তক্ষেপে শান্ত হলেন দেবী।
'বামনপুরাণ'-এ পার্বতীর সঙ্গে কালীর সম্পর্কের ভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। যখন শিব পার্বতীকে কালী, গাঢ় নীল বা মতান্তরে কালো বলে সম্বোধন করেন, তখন নাকি পার্বতী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। পার্বতী তাঁর কালোবর্ণ শেষের জন্য তপস্যা করতে শুরু করেন এবং গৌরী তখন হন সোনালী বর্ণের হলেন। তার গাঢ় আবরণ হয়ে ওঠে কৌশিকী, যিনি ক্রুদ্ধ হয়ে কালীকে সৃষ্টি করেন বলে বলা হয়।
আবার 'কালিকাপুরাণ'-এ বলা হয়, শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই রাক্ষস পৃথিবীজুড়ে তাদের ভয়ংকর ত্রাসের সৃষ্টি করে। তারা দেবলোকেও আক্রমণ করে। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। দেবতাদের দেবলোক ত্যাগ করতে বাধ্য করে তারা। এই সময়, দেবতারা সকলে মিলে বিষ্ণু, মহাদেব এবং ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। তারপর আদ্যশক্তি মহামায়ার উপাসনা করেন সকলে। দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাছে আবির্ভূত হন। মহামায়া অবতীর্ণ হলে তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন এবং অসুর নিধনে তার রুদ্ররূপ ধারণ করেন। দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয়, যা ভক্তদের কাছে পরিচিত দেবী কৌশিকী হিসেবে। মা মহামায়া দেহ থেকে নিঃসৃত বলে, মহামায়া কালোবর্ণ ধারণ করে, এমন বলা হয়। আবার এই রূপকে কালীর আদিরূপ বলেও ধরা হয়।
দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীর পুজো
অশুভ শক্তির বিনাশ হয় এই দিন। বলা হয়, সমস্ত অশুভের শেষ হয় আলোর এই উৎসবে। আর শক্তির শ্রেষ্ঠ দেবীর, ঘরের মেয়ে শ্যামার আরাধনা হয় সেই সূত্রেই। কিন্তু এই কারণের পিছনেও রয়েছে একাধিক পুরাণ আর ইতিহাস।
কথিত আছে, মহালয়ার অমাবস্যায় পিতৃপক্ষের অবসান এবং জল দেওয়ার রীতির সূত্রে এই সময় মর্ত্যে হাজির হন প্রেতাত্মারা। তারা নিজেদের স্থানে ফেরেন দীপান্বিতা অমাবস্যায়। আর তাদের যাওয়ার পথ অমাবস্যার দরুন অন্ধকার থাকে। তাই আলো জ্বালিয়ে এই উৎসব। যাতে আলোয় ভরে থাকে ওঁদের পথ। এদিন পুজোর রেওয়াজ রয়েছে এই সূত্রেই।
আবার ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের বাসিন্দা 'নব্যস্মৃতি'র স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধান দেন। কিন্তু তিনি কালীপুজোর উল্লেখ করেননি। এদিকে ১৭৭০ সাল নাগাদ প্রকাশিত 'কালী সপর্যাসবিধি' গ্রন্থে প্রথম দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজোর কথা উল্লেখ করা হয়। তবে এর আগেও কালী পুজোর আভাস রয়েছে বাংলায়। বলা হয়, তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বাংলায় কালীর মূর্তি, কালী পূজার প্রথম প্রবর্তক। তার আগে মূলত ঘট এবং শিলাখন্ড দিয়েই পুজো হত। এরপর এই দিনে কালী পুজোর আড়ম্বর শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে।
কী করবেন এই পুজোর দিন?
দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীর পুজো যেমন হয়, তেমনই হয় আলোর উৎসব। তাই এদিন ঠিক যা যা করা উচিত বলে মনে করে জ্যোতিষ-বিশারদরা, তা হলো,
- আলোয় ভরিয়ে দিন চারদিক।
- মোমবাতি, প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে রাখা ভালো।
- ঘি দিয়ে ঠাকুর ঘরে প্রদীপ জ্বালান।
- তুলসী মঞ্চে সন্ধ্যায় ঘিয়ের প্রদীপ এবং জল দিন।
- বাড়িতে কালীর ছবি-মূর্তি থাকলে লাল জবা, লাল কাপড়, আলতা, সিঁদুর দিয়ে পুজো দিন।
- ঘরের পুজোর ক্ষেত্রে আতপ চাল, কলা আর আখের গুড় সহযোগে নৈবেদ্য সাজিয়ে নিবেদন করুন।
- কাছের কোনও কালী মন্দিরে গিয়ে ধূপ, দীপ জ্বালান।
- শুধুমাত্র সাদা ফুল বাদে যেকোনও ফুল, ফল-সহ পুজো দিন।
- এইদিন লক্ষ্মীর পুজোও হয়। বাড়ির কাছের কোনও তিন মাথার মোড়ে গিয়ে কুলোয় নিন প্রদীপ, ফুল, ধান, দূর্বা, আর একটি নতুন ঝাঁটা নিন সঙ্গে। পুজো করুন ওখানেই। বাড়িতেই নিয়মিত যেভাবে লক্ষ্মীপুজো করেন। সেখানেই করুন পুজো।
- কালীর সঙ্গেই শিবের জন্য আকন্দ ফুলের মালা, বেলপাতা নিন। শিবের পুজো করুন।
কী কী করবেন না
- দেবী কালীকে আমিষ ভোগ দেওয়ার প্রচলন থাকার কথা বলা হলেও অনেকেই বলছেন, এই অমাবস্যায় আমিষ খাওয়া বন্ধ রাখা ভালো।
- কোনওভাবেই কালো রঙের পোশাক, কালো রঙের (গাত্রবর্ণ নয়) কোনও বাসন দেবীর সামনে না দেওয়া ভালো। দেবীর বর্ণ কালো বা গাঢ় নীল হলেও এই ক্ষেত্রে অমাবস্যার কালো অন্ধকারকে অশুভের বাহক বলা হয়, তাই সেই অর্থে কালোয় নিষেধ।
- বাড়ির সমস্ত কোণে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিন।
- যেকোনও কালী মন্দিরে লোহার কিছু দান করুন।
- রাতে কাউকে কিছু ভিক্ষা হিসেবে এদিন দেবেন না।
- বাড়ির প্রয়াত সদস্যের ছবি থাকলে সেখানেও ফুল দিন। প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালান।
- অন্ধকারের অনধিকার প্রবেশ বাড়ির কোনও অংশেই ঘটানো যাবে না।

Whatsapp
