শাসকের উল্লাসের বলি! ৯ বছরের তামান্নার মৃত্যু ভুলতে কতক্ষণ নেবে পশ্চিমবাংলা?

Kaliganj Tamanna Khatun: কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের গণনা শেষ হওয়ার আগেই নাকি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদ বিপুল ভোটে জয়ী হতে চলেছেন। তাই বিজয়োল্লাস তো জায়েজ!

রাজায় রাজায় যুদ্ধ করলেই যে উলুখাগড়াদের মরণ হয় তা নয়। রাজা ও তার নানাস্তরের পারিষদরা যদি প্রচণ্ড আনন্দে উন্মত্তের মতো উৎসবে মাতে, তাহলেও বলির তালিকায় নাম ওঠে উলুখাগড়াদেরই। সে ৮০ বছরের প্রাচীন প্রজা হোক বা চতুর্থ শ্রেণির ছোট্ট ছাত্রী। রাজ্যের শাসক তৃণমূল বিজয় উল্লাসে মেতেছিল। কালীগঞ্জে উপনির্বাচন হয়ে গিয়েছে। তখনও ভোট গণনা কিন্তু হয়নি। অর্থাৎ কে জিতবে গণতান্ত্রিক হিসেবমতো তা অজানাই থাকার কথা। তবু, শাসক তো অন্তর্যামীরই রূপ! তাই আগেভাবেই নিশ্চিত জয়ের আনন্দে বিজয়োল্লাস। রাজার জয়ে বোমা ফাটবে, গুলি চলবে আর সেই বোমার আঘাতে মৃত্যু হবে সেই প্রজার, যে ভোট দেওয়ার বয়সেও পৌঁছয়নি। নিরীহ বালিকা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী, ৯ বছরের তামান্না খাতুন শাসকের জয়ের 'কোল্যাটেরাল ড্যামেজ' হয়েই বিদায় নেবে পৃথিবী থেকে, বড় বড় দেশে এমন ছোট ছোট ঘটনা হয়েই থাকে।

পুলিশ বলেছে, "যারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের ছাড়া হবে না। এই মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের খোঁজে চলছে তল্লাশি"। শাসকের অধীনে থাকা রাজ্য পুলিশ এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে জানিয়েছে, “'কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশের কালীগঞ্জ পুলিশ স্টেশন এলাকায়, একটি বিস্ফোরণে এক বালিকার মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার পিছনে যে দুষ্কৃতীরা রয়েছে, তাদের ধরতে আমরা কোনও ত্রুটি রাখব না। অভিযুক্তদের খোঁজে জোরকদমে তল্লাশি চলছে।" মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, "কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার বারোচাঁদগড়ে বিস্ফোরণে একটি বাচ্চা মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় আমি মর্মাহত এবং গভীর শোকাহত। এই দুঃখের দিনে পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও আইনি ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।"

 

জানা গিয়েছে, তামান্নার মৃত্যুর ঘটনায় চার মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতেরা হলেন আদর শেখ, মানোয়ার শেখ, কালু শেখ এবং আনওয়ার শেখ। সোমবার কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের গণনা শেষ হওয়ার আগেই নাকি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদ বিপুল ভোটে জয়ী হতে চলেছেন। তাই বিজয়োল্লাস তো জায়েজ! অভিযোগ, বিজয়মিছিল থেকে বোমা ছোড়া হয় সিপিএম কর্মীদের বাড়ি লক্ষ্য করে। একটি সকেট বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া, বড় চাঁদঘর পঞ্চায়েতের মোলান্দা গ্রামের বাসিন্দা তামান্না খাতুনের।

আরও পড়ুন- পুলিশ তো হাতের পুতুল! শঙ্খ ঘোষকেও কটূক্তি করতে ছাড়েননি মমতার স্নেহধন্য কেষ্ট

 

তামান্নার দোষ? আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, তামান্নার মা সাবিনা ইয়াসমিন বলেছেন, ‘‘আমি দেখেছি কারা বোমা ছুড়েছে। আমরা সিপিএম করি। ওদের নাম না-জানলেও সকলের মুখ চেনা, সবাই তৃণমূল করে।’’ এরপরের ঘটনা সকলেরই মোটামুটি জানা। কয়েকদিন সমস্ত সংবাদমাধ্যমে উত্তপ্ত আলোচনা হবে, সমস্ত দলই নানা ইতিহাস টেনে সমস্ত দলের মুণ্ডপাত করবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কান্নাকাটিও চলবে। কালীগঞ্জ নিজস্ব ছন্দে ফিরে যাবে। চার অভিযুক্ত এবং অভিযুক্তদের মদত দেওয়া নেতাদের কী হবে, তা সংবাদে আর শিরোনামে আসবে না, বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাবে একটি শিশুমৃত্যু ও শাসকের উল্লাস। চলে আসবে আগামী নির্বাচন, বোমা মজুত হবে। পুলিশের কাছে সেসবের কোনও খবরই থাকবে না। শুকনো সহানুভূতি নিয়ে তামান্নাদের মতো অজস্র পরিবার কোনও বিচার না পাওয়াকে 'কপাল' মেনে কাটিয়ে দেবে অনন্ত ক্যালেন্ডার বর্ষ।

উল্লেখ্য, নদিয়ার কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছে তৃণমূল। গতবারের বিধানসভা নির্বাচনের থেকেও ভোটের মার্জিন বেড়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কালীগঞ্জে জয়ী হয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন (লাল) আহমেদ। তাঁর মৃত্যু হওয়াতেই উপনির্বাচনের আয়োজন। উপনির্বাচনে ৪৯,৭৫৫ ভোটে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী তথা নাসিরুদ্দিনের কন্যা আলিফা। শাসক সম্ভবত এই জয়ের আভাস আগেই পেয়ে গেছিল, তাই চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হওয়ার আগেই বিজয়োল্লাস চালানোর অনুমতি মিলেছিল, তাতে ৯ বছরের ছোট্ট শিশু মারা গেল! তামান্না বোমায় ভয় পেত, আওয়াজে ভয় পেত। কিন্তু বিজয়ের উল্লাসের কবেই বা শিশুর ভয়ের থেকে সংবেদনশীল দূরত্ব বজায় রেখেছে?

More Articles