শুভেন্দু 'হোমো', দীপ্সিতা 'কালো'! প্রতিপক্ষকে যে নজরে দেখেন কল্যাণ?

Kalyan Banerjee criticism: এমন মন্তব্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উসকে দেয়। ভারতের বিচারব্যবস্থা কিন্তু LGBTQ+ অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে সমকামিতা অপরাধমুক্ত হয়।

সম্প্রতি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘কর্মচারী’ বলে কটাক্ষ করেন। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় কল্যাণের উত্তর ছিল:

বাংলার হোমো শুভেন্দু

বরাবরের মতো কল্যাণের এই মন্তব্য এখন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে তাঁর রাজনীতির অভিমুখকে। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন সমলিঙ্গের বিবাহে শুভেচ্ছে জানাচ্ছেন কল্যাণ তখন মনে করছেন বিরেধীকে হোমো বা সমকামী দাগিয়ে দেওয়াতাই স্ৱাভাবিক। সমালোচকদের মতে, এই মন্তব্য শুধু শুভেন্দু অধিকারীকে অপমান নয়, গোটা LGBTQ+ সম্প্রদায়কে হেয় করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, রাজনৈতিক তরজা কি এতটাই নিচে নেমে গিয়েছে যে লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে টানাটানি করে নিজেরাই বেআব্রু হয়ে যাচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা। 

সমকামী বা সমপ্রেমি মানুষদের বলা হয় হোমো সেক্সুয়াল। অর্থাৎ, একজন পুরুষ যদি অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হন, তিনি হোমো সেক্সুয়াল। একইভাবে, একজন নারী যদি নারীর প্রতি আকৃষ্ট হন, তিনিও হোমো সেক্সুয়াল। বলে রাখা জরুরি, সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ জন্মগত, স্বাভাবিক এবং কোনো ভাবেই রোগ বা বিকৃতি কিছু নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (APA)-সহ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই বলেছেন সমকামিতা মানুষের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য, এটি কোনো অপরাধ বা মানসিক অসুখ নয়। অনেকে মনে করেন, LGBTQ+ পরিচয় যেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে এসেছে। অথচ ভারত, গ্রিস, রোম, মিশর-সহ বহু প্রাচীন সভ্যতার গ্রন্থ, শিল্প, সাহিত্য ও পুরাণে সমলিঙ্গ সম্পর্কের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। 

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি কেন সমস্যার? একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও এ ধরনের কটূক্তি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সেখানে সংসদের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য করলে সমাজে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। রাজনৈতিক বক্তব্যে শিষ্টাচার ভঙ্গ করলে তার অভিঘাত পড়ে বৃহত্তর সমাজে, বিশেষত যদি তাতে লিঙ্গপরিচয় বা যৌন পরিচয় জড়িয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এটি কি শুধুই শুভেন্দু অধিকারীকে আক্রমণ? নাকি পরোক্ষভাবে LGBTQ+ সম্প্রদায়কেও দুর্বল দাগিয়ে দিতে চাইলেন কল্যাণ? তাহলে তো প্রশ্ন ওঠে 'দূর্বল লিঙ্গে'র মানুষটি কীভাবে নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে হাড়ালেন। পাড়ায় পাড়ায় দুর্বলকে কোণঠাসা করতে 'লেডিস', 'হোমো' বলার চল ছিল কিন্তু সেও বহুদিন আগের কথা সভ্যতা তারপর এগিয়েছে, কল্যাণ কী ভাবে এতটা পিছিয়ে পড়লেন?

মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, একজন প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে LGBTQ+ পরিচয়কে ‘অপমানসূচক’ শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা গুরুতর সমস্যা। এতে শুধু রাজনৈতিক বিতর্কই নয়, সমাজে থাকা হোমোফোবিক মনোভাবকেও আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এমন মন্তব্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উস্কে দেয়। ভারতের বিচারব্যবস্থা কিন্তু LGBTQ+ অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে সমকামিতা অপরাধমুক্ত হয়। তাই জনসমক্ষে একজন সাংসদের মুখে এমন মন্তব্য তাঁর কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তবে মনে রাখতে হবে কল্যাণ একজন আইনজীবীও বটে।

মূল প্রশ্ন হলো, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কি হোমো সেক্সুয়ালদের দুর্বল বলে মনে করেন? তাঁর মন্তব্যের ধরন দেখে মনে হয়, ‘হোমো’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন অসম্মানসূচক অর্থে। এর মাধ্যমে তিনি যৌন পরিচয়কে অপমান বা আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই কিন্তু LGBTQ+ ব্যক্তিরা অবদান রেখে গিয়েছেন, দিনের পর দিন মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলতেই হয় অ্যালান টিউরিং-এর কথা। আধুনিক কম্পিউটারের জনক; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এনিগমা কোড ভেঙে মিত্রশক্তিকে জিততে সাহায্য করেন তিনিই। এছাড়াও টিম কুক— অ্যাপলের CEO; বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান। ভার্জিনিয়া উলফ— সাহিত্যজগতে সমলিঙ্গ প্রেম ও নারী-নারী সম্পর্ককে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন। এলেন ডেজেনারেস— বিশ্বের প্রভাবশালী টিভি হোস্ট; ১৯৯৭ সালে নিজের সমকামী পরিচয় প্রথমবার প্রকাশ করেন। ল্যাভার্ন কক্স (অভিনেত্রী)— প্রথম এমি নমিনেশন পান। র‍্যাচেল লেভিন— যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ফেডারেল অফিসার। স্যালি রাইড— প্রথম মার্কিন মহিলা মহাকাশচারী। বেন বারেস— বিশ্বস্বীকৃত স্নায়ুবিজ্ঞানী। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। ফলে হোমো সেক্স্যুয়ালরা দুর্বল তো নয়ই, তার সঙ্গে এ কথাও বলতে হয়— যৌন পরিচয় নয়, মানুষের যোগ্যতা, প্রতিভাই সাফল্য নির্ধারণ করে। মানুষের কাজই তাঁকে সম্মান এনে দেয়।

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু হোমোফোবিক মন্তব্যই করেননি, অতীতে তাঁর একাধিক নারীবিদ্বেষী মন্তব্যও সামনে এসেছে। ২০২৫ সালের ল কলেজের ছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনার প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,

“বন্ধু যদি বন্ধুকে ধর্ষণ করে, তবে আর কী করা যাবে?”

একবার দলীয় বিরোধের সময় তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্রর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মন্তব্য করে বলেন, মহুয়া মৈত্র 'নারীবিদ্বেষী', '৪০ বছরের সংসার ভেঙেছেন'। শুধু তাই নয় আরও একবার মহুয়া মৈত্রকে নির্বাচন কমিশনের দফতরে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘rude female MP’ বা ‘অসভ্য মহিলা সাংসদ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কেন বারবার নারীবিদ্বেষী এবং এখন হোমোফোবিক মন্তব্যও করলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়?

সমাজকর্মী শতাব্দী দাশ বলেন,

একজন নির্বাচিত সাংসদ রাজনৈতিক তরজায় ‘হোমো’ শব্দটিকে গালাগাল হিসেবে ব্যবহার করছেন, এটা খুবই উদ্বেগের। এর আগেও এমন ইঙ্গিত মিলেছিল। কয়েক বছর আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন, আর কুণাল ঘোষ দাবি করেছিলেন যে শুভেন্দু নাকি নিজের এক পুরুষ কর্মচারীর সঙ্গে ‘বিকৃত যৌনতা’র ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়েই তাকে খুন করেন।"

শতাব্দী দাশ প্রশ্ন তুলেছেন,

যদি সত্যিই এমন ভয়ংকর অভিযোগ থাকে, তবে তৃণমূল তা প্রমাণ-সহ প্রকাশ্যে আনছে না কেন? শুধুই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করা হচ্ছে কেন?

তিনি আরও বলেন,

‘হোমো’ শব্দটি ধর্ষণ, খুন, দুর্নীতি বা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত বিষমকামী মন্ত্রীকে তো আমরা বলি না— 'তুই বাংলার হেটেরো রে'! সব লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যেই ভালো-খারাপ মানুষ থাকে। তাই পুরো LGBTQ+ সম্প্রদায়কে দায়ী করা বা তাদের পরিচয়কে গালাগালির মতো ব্যবহার করা সম্পূর্ণ অন্যায় ও যুক্তিহীন।

শতাব্দী দাশের মতে,

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দু অধিকারীকে যত রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করতে চান করতে পারেন, কিন্তু ‘হোমো’ বলে অপমান করতে পারেন না। কারণ, এটি আদতে 'গাল' নয়, বরং একটি পরিচয়। অনেকে নিজের ভিন্ন যৌন পরিচয় সগর্বে বলেন। এই শব্দকে গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করলে তাদেরও অপমান করা হয়।

সিপিএম নেত্রী দীপ্সিতা ধর বলেন,

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে আমি খুব একটা অবাক হইনি। নির্বাচনী প্রচারের সময় দেখেছি, তিনি মহিলা নেত্রীদের নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার বদলে ব্যক্তিগত আক্রমণেই বেশি আগ্রহী— কার গায়ের রং কেমন, বিয়ে হয়েছে কি না, পরিবার কেমন— এসব নিয়েই তিনি মন্তব্য করতে পছন্দ করেন। কারও কারও দৃষ্টি সব সময় নর্দমার দিকে থাকে, স্বাভাবিক রাজনৈতিক ভাষা তাঁদের কাছে যেন বড় কঠিন বিষয়।

তিনিও বলেন,

তাঁর নিজেদের দলের সাংসদ মহুয়া মৈত্র সম্পর্কেও তিনি কটূক্তি করেছেন, আমরা তো সেসব কথাও শুনেছি। এখন আবার শুভেন্দু অধিকারীকে আক্রমণ করতে গিয়ে হোমোফোবিক মন্তব্য করছেন। শুভেন্দু অধিকারীর রাজনীতির সঙ্গে আমাদের তীব্র মতো বিরোধ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বা যৌন পছন্দ কখনোই রাজনৈতিক সমালোচনার বিষয় হতে পারে না।

তৃণমূলের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন দীপ্সিতা। তিনি বলেন,

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, মহিলাদের স্বনির্ভরতার দাবি তুলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরেন। অথচ তাঁরই দলের এক সাংসদ প্রকাশ্যে নারীবিদ্বেষী ও হোমোফোবিক মন্তব্য করেও কীভাবে পার পেয়ে যান? তাঁকে দল থেকে তৎক্ষণাৎ বহিষ্কার করা হয় না কেন?

তাঁর মতে,

কিছুদিন আগে দুই সমকামী মেয়ের বিয়েতে তৃণমূলের পক্ষ থেকে বড়সড় সম্মান দেওয়া হলো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে। সেখানে একদিকে LGBTQ+ অধিকারকে সমর্থনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে, আবার অন্যদিকে একই দলের সাংসদ হোমোফোবিক মন্তব্য করছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তাহলে কি শুধু চমক দেখানোর জন্যই এসব করা হয়? এই প্রশ্ন তৃণমূল নেতৃত্বকেই তুলতে হবে।

গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক বিতর্ক উন্নয়ন বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বদলে ব্যক্তি আক্রমণ, কটূক্তি, জাত বা লিঙ্গপরিচয় নিয়ে টানাটানির দিকে বেশি ঝুঁকছে। প্রতিপক্ষের কাজ বা অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা গণতন্ত্রের অংশ। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচয়কে আক্রমণের মাধ্যমে রাজনৈতিক লড়াই করা আসলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই টেনে নিচে নামিয়ে দেয়। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য সেই প্রবণতাকেই আরও স্পষ্ট করেছে। গণতান্ত্রিক সমাজে ভাষার দায়িত্ব আছে। জনপ্রতিনিধিরা কি অন্তত এতটুকু সচেতন হতে পারবেন, যাতে তাঁদের ভাষা সমাজে বৈষম্য নয়, বরং প্রান্তিক মানুষের প্রেরণা হয়ে ওঠে?

More Articles