বিতর্কের মুখে 'ভূত কোলা'! রহস্যময় লোকসংস্কৃতিতে লুকিয়ে বিচিত্র কোন প্রথা?

Kantara Bhoot Kola: টুলুতে, ‘ভূত’ শব্দের অর্থ ‘সৃষ্টিকর্তা’। কোলা শব্দের অর্থ ‘পারফরমেন্স’ যা সাধারণত সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত চলে। এই উপাসনায় স্থানীয় দেবতাদের পুজো করার মাধ্যমে নিজেদের ভূমি রক্ষা করা হয়।

বক্স অফিস হিট করলেও বিতর্ক যে থেমে থাকে না তা সিনেমাপ্রেমীরা খুব ভালো মতোই জানেন। ঋষভ শেঠি পরিচালিত কান্তারার ক্ষেত্রেও এই ঘটনার অন্যথা হয়নি। ৩০ সেপ্টেম্বর সিনেমা মুক্তির পর থেকেই শুরু হয় টালমাটাল। এমনিতেও, ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করতে বসলে এখন সামনে সারিতে সদর্পে থাকে দক্ষিণ ভারতের একাধিক দুর্ধর্ষ কাজ। কান্তারা চলচ্চিত্রে কর্ণাটকের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে। ১৮৪৭ সালের একটি গল্পে কর্ণাটকের একটি আঞ্চলিক গ্রামকে দেখানো হয় এবং একটু একটু করে সেই গ্রামকে ঘিরে মানুষের অনুভূতি এবং গ্রামের ঐতিহ্যের গল্প বলে এই সিনেমা।

কর্ণাটকেরই লোকসংস্কৃতির এক ঐতিহ্য ‘ভূত কোলা’। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু মূলত এই অনুষ্ঠানই। সিনেমা মুক্তির পর পরিচালক ঋষভ শেঠি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সিনেমায় ব্যবহৃত ‘ভূত কোলা’ আসলে হিন্দু সংস্কৃতির একটি অংশ। এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট চেতন অহিংস বলেছেন, “ভূত কোলা কোনওভাবেই হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্য নয় বরং হিন্দু ধর্মের সূচনার অনেক আগে থেকেই এটি বিদ্যমান ছিল।” এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে চেতন অহিংস বলেন, “হিন্দুত্ব মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না সুতরাং এক্ষেত্রেও তা হবে না। এটি দেশের আদিবাসীদের ঐতিহ্য, কখনই এটি হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যের মধ্যে আসে না।”

অপরদিকে, পরিচালক ঋষভ শেঠি কোনও প্রকার বিতর্কে না জড়িয়েই দর্শকদের সামনে নিজের ভাবনা সহজ ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “যখন আমি এই সিনেমাটি তৈরি করছিলাম, যাঁরা এই সংস্কৃতির চর্চা করেন তাঁরা আমার সঙ্গে ছিলেন এবং আমি খুব সতর্কভাবেই এই ছবি পরিচালনা করেছি।” তবে অন্যদের বাক স্বাধীনতাতেও তিনি বাধা দেবেন না বলে জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন- ৩০ বছরে প্রথমবার স্নান আর তারপরেই মৃত্যু দুনিয়ার সবচেয়ে নোংরা ব্যক্তিত্বের

এই ‘ভূত কোলা’ আসলে কী? ভূত কোলার ঐতিহ্য কতটা মানুষের মনে প্রকট সে বিষয়ে ধারণাগুলি একটু স্পষ্ট করে দেওয়া যাক।

ভূত কোলা কী?

কর্ণাটকের লোকসংস্কৃতির এক ঐতিহ্যবাহী রূপ হল এই ভূত কোলা অনুষ্ঠান। যার মাধ্যমে প্রধানত ভূত বা আত্মাদের আরাধনা করা হয়ে থাকে। মনে করা হয়, যিনি আরাধনা করেন তিনি আসলে সেই সময়ের জন্য ঈশ্বরের এক রূপ হয়ে ওঠেন এবং ঈশ্বরের দূত হয়ে সকল মানুষের সব সমস্যার উত্তর দিতে পারেন। দক্ষিণ কন্নড়, উত্তর কন্নড় এবং উডুপি জেলায় টুলুভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পুজো প্রতিবছর পালন করা হয়ে থাকে।

ভূত কোলার 'কোলা' আসলে কারা?

কর্ণাটকের বেশিরভাগ গ্রামেই নির্দিষ্ট কিছু মানুষ বা পরিবার রয়েছে যারা এই কোলাগুলিকে সংগঠিত করেন এবং সেই পরিবারই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বংশ পরম্পরায় কোলা হিসেবে দেবতার আরাধনা করে থাকেন। যেহেতু একটি কোলা সংগঠিত করার দায়িত্ব নির্দিষ্ট পরিবারের উপর পড়ে, তাই এই দায়িত্বগুলি প্রতিটি প্রজন্মের পুরুষ উত্তরাধিকারীর কাছেও চলে যায়। পরিবারগুলি সাধারণত কোলার জন্য প্রস্তুত হতে প্রায় এক মাস সময় নেয়।

ভূত কোলা কীভাবে পরিচালিত হয়?

কোলা মূলত স্থানীয় এলাকায় বড় খোলা মাঠের কাছাকাছি অথবা মাঠের মধ্যে গান, নাচ, আবৃত্তি ইত্যাদির মাধ্যমে সঞ্চালন করা হয়। পুরনো টুলু ভাষায় প্রচলিত আবৃত্তির মাধ্যমে দেবতার উৎস থেকে শুরু করে বর্তমান পরিস্থিতি সকল বিষয়ে গল্প বলা হয়।

ভূত কোলায় কি অশুভ আত্মার পুজো হয়?

‘ভূত’ শব্দের সাধারণত একটি নেতিবাচক অর্থ রয়েছে। ‘অশুভ আত্মা’ বা ‘ভূত প্রেত’ সমস্যার সৃষ্টি করে- এই ধারণা সাধারণ মানুষের অজানা নয় কিন্তু টুলুতে, ‘ভূত’ শব্দের অর্থ ‘সৃষ্টিকর্তা’। কোলা শব্দের অর্থ ‘পারফরমেন্স’ যা সাধারণত সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত চলে। এই উপাসনায় স্থানীয় দেবতাদের পুজো করার মাধ্যমে নিজেদের ভূমি রক্ষা করা হয়। যদিও কবে থেকে এই অনুষ্ঠান পালন করা শুরু হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। অনেকে মনে করেন, গত ৫০০ বছর ধরে এই প্রথা পালন করা হয়। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘ভূত আরাধনার’ অনুশীলন ১৮০০ দশকেরও আগে থেকে শুরু হয়েছে।

যদিও কান্তারাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক শুধুমাত্র ভূত কোলা অনুষ্ঠানেই থেমে থাকেনি। কেরলের একটি মিউজিক ব্যান্ড ‘থাইকুদাম ব্রিজ’ পরিচালক ঋষভ শেঠির উপর কপিরাইটের নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে। ব্যান্ডের অভিযোগ, কান্তারার ‘ভারাহা রূপম’ গানটি সঙ্গীত পরিচালক আজনীশ লোকনাথের সুর করা ‘নাভারসম’ গানেরই অনুকরণ। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে থাইকুদাম ব্রিজ স্পষ্ট জানায় যে, কান্তারার সঙ্গে তাঁরা কোনওভাবেই যুক্ত নন এবং তাঁরা এর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেবেন। যদিও পরিচালক ঋষভ শেঠি এই বিষয়ে নীরবতার পথই অনুসরণ করেছেন।

 

More Articles