শ্রীলঙ্কাকে দ্বীপ দান! ৫০ বছর আগে ইন্দিরা গান্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোটের আগে কেন সরব বিজেপি?
Katchatheevu Island Issue: ১৯৭৪ সালে ভারত সরকার দ্বিপাক্ষিক আইনের মাধ্যমে দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দেয়।
১৯৭৪ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি শ্রীলঙ্কাকে একটি দ্বীপ দান করেন। ৫০ বছর পর বিতর্কিত সেই কাচাথিভু দ্বীপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ কাচাথিভু দ্বীপকে ঘিরে তামিলনাড়ুর রাজনীতি এই মুহূর্তে উত্তপ্ত, শুধু তামিলনাড়ু না লোকসভা নির্বাচনের আগে সারা দেশেই এই দ্বীপকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করতে চাইছে বিজেপি।
প্রধানমন্ত্রী মোদি এক্স-এ লিখেছেন, কংগ্রেস কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই কাচাথিভু দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দিয়েছিল, এই ঘটনায় প্রতি ভারতীয়ই ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তাই কংগ্রেসকে কখনই বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু কংগ্রেস কেন এই দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে দেয়? কেনই বা আজ ৫০ বছর পর একটি দ্বীপ বিজেপির মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠল?
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামিলনাড়ু বিজেপির প্রধান কে আন্নামালাই আরটিআই করে একটি নথি পেয়েছেন যাতে বলা আছে কীভাবে শ্রীলঙ্কা ভারতীয় উপকূল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ১.৯ বর্গকিমি জমিটি নিজেদের করে নেয়। স্বাধীনতার পরে, শ্রীলঙ্কা দ্বীপটি দাবি করে এবং ভারতীয় নৌবাহিনীকে শ্রীলঙ্কার অনুমতি ছাড়া ওই দ্বীপে অনুশীলন করার অনুমতিও দেয়নি।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বিষয়টিকে পাত্তা দেননি। ১৯৬১ সালের ১০ মে নেহরু বলেন, "আমি এই ছোট্ট দ্বীপকে এত গুরুত্ব দিই না এবং এর উপর আমাদের দাবি ছাড়তেও আমার কোনও দ্বিধা নেই।"
আরও পড়ুন- বাহুবলে ব্যারাকপুর দখল করতে পারবেন তৃণমূল-বিজেপি ডেইলি প্যাসেঞ্জার অর্জুন সিং?
কমনওয়েলথ সেক্রেটারি ওয়াইডি গুন্ডেভিয়া নেহরুর বক্তব্যের মিনিটস লেখেন। পরে তা বিদেশ মন্ত্রক ১৯৬৮ সালে সংসদের অনানুষ্ঠানিক উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে ভাগ করে নেয়। ওই প্রতিবেদনে জানা যায়, দ্বীপটি ধরে রাখার জন্য ভারতের 'অনিচ্ছা'-ই ছিল বেশি। ১৯৭৪ সালে ভারত এই দ্বীপের উপর নিজের দাবি ছেড়ে দেয়। বিষয়টিতে ভারত বা শ্রীলঙ্কার সার্বভৌমত্বের দাবি নিয়ে তাই কোনও স্পষ্ট উপসংহার টানা যায় না। ভারতের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এম সি শীতলাবাদ ১৯৬০ সালে বলেছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক রামনাদের রাজাকে দেওয়া জমিদারি অধিকারের স্পষ্ট উল্লেখ থাকায় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে গঠিত দ্বীপের উপর, এখানকার মাছের এবং চারপাশে অন্যান্য সম্পদের উপর ভারতের শক্তিশালী দাবি ছিলই, তা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়। রাজা রামনাদেব ১৮৭৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কাচাথিভুতে শাসন করেন। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে মাদ্রাজ রাজ্যের মধ্যেই দ্বীপটি ঢুকে যায়।
নথিপত্রে আরও দেখা যায়, তখন বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব কে কৃষ্ণা রাও নিজেও এই দ্বীপ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি শুধু বলেছিলেন, আইনত ভারতের অবস্থান শক্তিশালী। এই দ্বীপে ভারতের মাছ ধরার অধিকারকে তাই সুরক্ষিত করা যেতে পারে।
দ্বীপটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠে মূলত ১৯৬৮ সালে। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ডুডলি সেনানায়েক শ্রীলঙ্কার মানচিত্রে দ্বীপটিকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দেখান। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ইন্দিরা গান্ধির সরকারকে আক্রমণ করে বিরোধীরা। ইন্দিরা গান্ধি এবং সেনানায়েকের মধ্যে একটি চুক্তি হতে চলেছে এই সন্দেহে বিরোধীরা সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। কংগ্রেস এমন চুক্তি কথা অস্বীকার করে জানায় 'ভালো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক' রাখতে হবে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে।
১৯৭৩ সালে কলম্বোতে এই দ্বীপ নিয়ে বিদেশ সচিব পর্যায়ের আলোচনা হয়। এক বছর পরে, ভারত দ্বীপের উপর দাবি প্রত্যাহার করে সিদ্ধান্ত জানান তৎকালীন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম করুণানিধিকে।
আরও পড়ুন- বাঙালি বিদ্বেষী মোদি-বিশ্বস্ত সঞ্জীব সান্যাল আসলে কে?
বিদেশ সচিব জোর দিয়ে জানান, দ্বীপটি জাফনাপত্তনম রাজ্যের অংশ, ডাচ এবং ব্রিটিশ মানচিত্রে দেখানো ছিল সেভাবেই। কাচাথিভু শ্রীলঙ্কার সঙ্গেই ছিল, ভারতের নয়। ১৯৭৪ সালে ভারত সরকার দ্বিপাক্ষিক আইনের মাধ্যমে দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দেয়।
জনবসতিহীন দ্বীপ কাচাথিভু ১৪ শতকে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে গঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে দ্বীপের ২৮৫ একর জমি যৌথভাবে ভারত ও শ্রীলঙ্কা দ্বারা পরিচালিত হতো। মধ্যযুগের প্রথম দিকে, দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ নেয় শ্রীলঙ্কার জাফনা রাজ্য। ১৭ শতকে, রামেশ্বরমের প্রায় ৫৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে রামনাথপুরমের রামনাদ জমিদারির নিয়ন্ত্রণে আসে এই দ্বীপ।
১৯২১ সালে, শ্রীলঙ্কা এবং ভারত দুই দেশই মাছ ধরার জন্য দ্বীপের জমির অংশ দাবি করে। এই দাবি নিষ্পত্তি হয়নি। ভারতের স্বাধীনতার পর, ফের এই দ্বীপ মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। এই দ্বীপে একটিই মাত্র কাঠামো আছে, সেটি একটি গির্জা। সেন্ট অ্যান্থনি'জ চার্চ ২০ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত। ভারত এবং শ্রীলঙ্কা দুই জায়গারই খ্রিস্টান পাদ্রিরা এখানে উপাসনা করেন। গত বছরও রামেশ্বরম থেকে ২,৫০০ জন ভারতীয় কাচাথিভুতে গিয়েছিলেন।