মহাভারতের 'ঘৃণ্য' চরিত্র পূজিত হন ভারতে! দুর্যোধন মন্দিরের যে কাহিনি অবাক করবেই
Duryodhana Temple Kerala: এই মন্দিরে কোনও মূর্তি নেই। ভিতরে গেলে কেবল একটি উঁচু মঞ্চ দেখতে পাওয়া যায় যাকে বলা হয় মণ্ডপম বা আলথারা।
মহাকাব্য নায়ক গড়ে, মহাকাব্যই গড়ে ভিলেন। কোনও কোনও নায়কের আগে মহাকাব্যিক সেই কলম বসিয়ে দেয় 'ট্রাজিক' শব্দটি, কোনও খলনায়কের গা ভরে ওঠে পাঠকের থুতুতে। ভারতীয় দুই মহাকাব্যই নায়ক আর খলনায়কের দ্বন্দ্বে চরম ভুক্তভোগী। এখানে নায়ককে মাঝেমাঝে খল সেজে ‘ধর্ম’ রক্ষার ডাক দিতে হয়েছে, খলনায়ককে মাঝেসাঝে হয়ে উঠতে হয়েছে সংবেদনশীল। তবে কোনও কোনও খলনায়ককে পাঠক জীবনে ক্ষমা করেনি। স্থান কাল বদলেও ঘৃণা আর ক্ষোভের পাত্র হয়ে থেকেছেন সেই চরিত্ররা। ভারতে রাম পুজো পান, পণ্ডিত রাবণ হয়ে ওঠেন পোড়ানোর কুশপুতুল। আর মহাভারতে? থরে থরে নায়ক, তবে সবচেয়ে ঘৃণ্য খলনায়ক দুর্যোধন। পাশাখেলা, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা- সবটা মিলেই দেশ যাকে ক্ষমা করেনি। মহাকাব্যের অন্য এক বিশ্লেষণ বলে, তিনিই এই মহাকাব্যের একজন উজ্জ্বল, দয়ালু এবং সাহসী মানুষও। ১০০ কৌরব ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় দুর্যোধন এই ভারতে পূজিতও হন। শুনতে অবাক ঠেকলেও, খোদ দুর্যোধনকে রীতিমতো মন্দির গড়ে পুজো করা হয় এখানে। কিন্তু কেন?
পোরুভাজি পেরুভিরুথি মালানাদা মন্দির
পোরুভাজি পেরুভিরুথি মালানাদা মন্দির পেরুভিরুথি মালানাদা বা মালানাদা নামেও পরিচিত। এটিই ভারতের একমাত্র মন্দির যেখানে দুর্যোধনকে পুজো করা হয়। কেরলের কোল্লাম জেলার পোরুভাজি গ্রামে অবস্থিত এই মন্দিরটি আসলে খলনায়ক হিসেবে গড়ে তোলা এক চরিত্রের জীবনের শুভদিকগুলির প্রতীক। ঈর্ষায় মত্ত ভাই, পাশাখেলায় ছলনা, দ্রৌপদীর শ্লীলতাহানি- এত কিছুর পরেও দুর্যোধনের কিছু প্রশংসনীয় গুণ ছিল।
আরও পড়ুন- এক হাতে পদ্ম, অন্য হাতে ফল! ভারতের এই রাজ্যেই আছে সনিয়া গান্ধীর বিশাল মন্দির!
কিংবদন্তি যা বলে
জনশ্রুতি আছে, নির্বাসনে থাকাকালীন পাণ্ডবদের খোঁজ করতে গিয়েছিলেন দুর্যোধন। কেরলের দক্ষিণের বনাঞ্চলে পাণ্ডবদের খোঁজ করার সময় তিনি এই স্থানে পৌঁছন। সারাদিন ধরে খোঁজাখুঁজির জেরে অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত ছিলেন দুর্যোধন। জলতেষ্টা মেটাতে একজনের কাছে জল চান তিনি। নিম্নবর্ণের একজন বৃদ্ধা তাকে টডি মানে মিষ্টি নারকেলের জল দেন। দুর্যোধন বিনা দ্বিধায় তা পান করেছিলেন।
দুর্যোধনের রাজকীয় পোশাক দেখে, বৃদ্ধ ওই মহিলা বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি একজন রাজা। এমন এক সম্মানীয় ব্যক্তি কুরব জাতের এক অস্পৃশ্য মহিলার হাত থেকে জল খাচ্ছেন এমনটা দেখেই অবাক হয়ে যান তিনি। দুর্যোধন কখনও জাতিভেদে বিশ্বাস করেননি। উলটে ওই বৃদ্ধার আতিথেয়তা দুর্যোধনকে এতটাই স্পর্শ করে যে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে সেখানে একটি পাহাড়ে ধ্যানে বসেন। গ্রামে বসবাসকারী মানুষদের মঙ্গল কামনায় শিবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন দুর্যোধন। শুধু তাই নয়, গ্রামবাসীদের কৃষিজমিও দান করেছিলেন দুর্যোধন।
পরে, যেখানে তিনি ধ্যান করেছিলেন সেই জায়গায় গ্রামবাসীরা পোরুভাজি পেরুভিরুথি মালানাদা মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। মজার বিষয় হলো, প্রতি বছর দুর্যোধনের নামে সম্পত্তি করও দেয় এই মন্দির কর্তৃপক্ষ। আজ পর্যন্ত যতজন এই মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্বে এসেছেন, সকলেই কুরব সম্প্রদায়ের মানুষ।
মূর্তিবিহীন মন্দির
তবে সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, এই মন্দিরে অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের মতো কোনও মূর্তি নেই। ভিতরে গেলে কেবল একটি উঁচু মঞ্চ দেখতে পাওয়া যায় যাকে বলা হয় মণ্ডপম বা আলথারা। এখানেই ভক্তরা প্রার্থনা করেন এবং ধ্যান করেন। কেরলের কোল্লামের কুন্নাথুরে অবস্থিত এই মন্দিরটি একটি ছোট পাহাড়ে অবস্থিত। মালায়লাম ভাষায় 'মালা' মানে হচ্ছে পাহাড় এবং 'নাদা'র অর্থ মন্দির। পোরুভাজি পেরুভিরুথি মালানাদা মন্দিরে এক বিশাল খোলা মঞ্চও আছে। ভক্তরা চাইলে পাথরের মণ্ডপে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে পারে।
আরও পড়ুন- ভারতের এই মন্দিরে পূজিত হয় মোটরবাইক! ‘বুলেট বাবা’-র নেপথ্যে রয়েছে গা ছমছমে যে ঘটনা
মন্দিরের আচার ও উৎসব
পোরুভাজি পেরুভিরুথি মালানাদা মন্দিরে একটি সোনার পতাকা (স্বর্ণাক্কোদি) রয়েছে। এটি শাসক মান্নানের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক। 'মালাক্কুদা মহলসভাম দিবস'-এর মতো শুভ দিনগুলিতে আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন দিয়ে উৎসব শুরু হয়। মালাক্কুদা মহোৎসবের শোভাযাত্রা চোখ ধাঁধানো। ষাঁড় এবং ঘোড়ার প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ফুট লম্বা সুসজ্জিত কাঠামো তৈরি করা হয়। ঐতিহ্যবাহী সুর বাজাতে বাজাতে এই বিশাল কাঠামোগুলো হয় কাঁধে চাপিয়ে বা রথে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
কৌরব রাজা দুর্যোধনের শুভ গুণগুলিই পূজিত হয় এই মন্দিরে। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে দুর্যোধনের দৃষ্টিভঙ্গি, কর্ণের সঙ্গে বন্ধুত্ব, নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলা এবং দরিদ্রদের প্রতি সমবেদনার মতো প্রশংসনীয় গুণগুলির পুজো প্রমাণ করে ভারতে নায়ক-খলনায়ক, পূজিত হন দু'জনেই। আর চরম ঘৃণার মধ্যেও কোথাও যে নরম কোনও কুঁড়ি ফুটতে পারে- সেই সম্ভাবনাকেই যেন পুজো করা হয় এই মন্দিরে।