কানাডার হিন্দু ভারতীয়দের হুমকি, কে এই গুরপতওয়ান্ত সিং পুন্নুন?
India-Canada row: এরই মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আরও একটি নাম, গুরপতওয়ান্ত সিং পুন্নুন। কে এই গুরপতওয়ান্ত? যতদূর জানা গিয়েছে, আমেরিকার নিষিদ্ধ সংগঠন শিখস ফর জাস্টিস (SFJ)-র প্রধান সে।
খলিস্তানি ইস্যুকে ঘিরে যুযুধান ভারত ও কানাডা। কানাডার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই খলিস্তানি জঙ্গি তোষণের অভিযোগ এনে চলেছে ভারত। এরই মাঝে খলিস্তানি জঙ্গি হরদীপ সিং নিজ্জরের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে কানাডা। ভারতের কালো তালিকাভুক্ত জঙ্গি হরদীপ খুনের অভিযোগ ভারতের কাঁধেই চাপিয়েছিল জাস্টিন ট্রুডো সরকার। তার পর কূটনৈতিক স্তরে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। একে অপরের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে দু'দেশই। দু'দেশই গুপ্তচর সন্দেহে বরখাস্ত করেছে দু'দেশের কূটনৈতিককে। এমনকী ভারত স্থগিত রেখেছে কানাডার নাগরিকদের ভিসাও। এরই মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আরও একটি নাম, গুরপতওয়ান্ত সিং পুন্নুন। কে এই গুরপতওয়ান্ত? যতদূর জানা গিয়েছে, আমেরিকার নিষিদ্ধ সংগঠন শিখস ফর জাস্টিস (SFJ)-র প্রধান সে।
কানাডায় নিহত হরদীপ ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন খলিস্তানি টাইগার ফোর্স (কেটিএফ)-এর মাথা। তার বিরুদ্ধে একাধিক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। ২০২২ সালে এনআইএ তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে। ভুয়ো পরিচয় দিয়ে কানাডায় প্রবেশের পর বহুবারের চেষ্টায় সে দেশের নাগরিকত্ব পায় সে। কলের মিস্ত্রি থেকে শুরু করে ট্রাকচালক, নানা ধরনের কাজ করেছে সে। তলে তলে যোগাযোগ ছিল একাধিক খলিস্তানি সংগঠনের সঙ্গে। কেটিএফের মাথা হওয়ার পাশাপাশি শিখস ফর জাস্টিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তার। এমনকী একাধিক বার পাকিস্তানে গিয়ে সেখানকার কেটিএফ প্রধান জগতার সিংয়ের সঙ্গেও দেখা করে হরদীপ। জগতারও ছিল ভারতের কালো তালিকায়, যে থাইল্যান্ডে গিয়ে গ্রেফতার করা হয়। এবং প্রত্যার্পণ আইনে ফেরানো হয় ভারতে। হরদীপের মৃত্যুর পর থেকেই ফুঁসছে কানাডার খলিস্তানি সংগঠনগুলি। ইতিমধ্যেই কানাডার অভিবাসী হিন্দু ভারতীয়দের কানাডা ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে একটি হুমকি-বার্তা দিয়েছে শিখস ফর জাস্টিস। সেই ভিডিও বার্তায় যে মুখটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সেটি আদতে গুরপতওয়ান্ত সিং পুন্নুনের। যে কিনা শিখস ফর জাস্টিস আমেরিকা শাখার প্রধান।
আরও পড়ুন: কানাডাতেই কেন আশ্রয় নিলেন শিখেরা?
একটি নতুন গোয়েন্দা রিপোর্ট জানাচ্ছে, শুধুমাত্র হরদীপ খুনের প্রতিবাদই কিন্তু শিখস ফর জাস্টিস কিংবা গুরপতওয়ান্ত সিং পুন্নুনের উদ্দেশ্য নয়। বরং তলায় তলায় বড় পরিকল্পনা আঁটছে এই খলিস্তানি সংগঠনটি। ওই গোয়েন্দারিপোর্ট জানাচ্ছে, ধর্মীয় ভাবে ভারতকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে ওই খলিস্তানি সংগঠনগুলি। ধর্ম নিয়ে এই ভেদাভেদের খেলা তো নতুন নয়। এর আগেও একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে যুঝতে হয়েছে ভারতকে। দেশভাগের দাবি উঠেছে। খলিস্তানিদের পঞ্জাব প্রদেশ ভাগের দাবিও আজকের নয়। খলিস্তান চেয়ে এর আগেও নানা অশান্তি করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এই খলিস্তানি সমস্যার বলি হতে হয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে আগুন জ্বলে উঠেছিল। খলিস্তানি সন্দেহে প্রাণ যায় অসংখ্য নিরপরাধ শিখের। দেশে নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হয়েছিল খলিস্তানি সংগঠনগুলিকে। সে সময় ভারত থেকে পাততাড়ি গোটালেও কানাডার মতো একাধিক দেশে গিয়ে ছড়িয়ে বসে খলিস্তানিপন্থীরা। তলে তলে বাড়ে সংগঠন, বাড়তে থাকে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপও। আর পরোক্ষ ভাবে সেই কার্যকলাপে কানাডা সরকার মদত দিয়ে এসেছে বলেই অভিযোগ ভারতের বিদেশমন্ত্রকের।
যতদূর জানা যাচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য মিলিয়ে এই পুন্নুনের বিরুদ্ধে কম করে হলেও ষোলোটির কাছাকাছি মামলা ঝুলছে। তার মধ্যে রয়েছে দিল্লি, পঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা ও উত্তরাখণ্ড-সহ একাধিক রাজ্য, যেখানে সন্ত্রাসমূলক কাজ করেছে এই খলিস্তানি নেতা। শুধু খলিস্তানের দাবিই নয়, ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে একাধিক খণ্ডে ভাগ করতে চায় এই পুন্নুন। তার মধ্যে রয়েছে একটি খলিস্তান, একটি উর্দুস্থান, যেটিকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে চায় এই নেতা।
পুন্নুনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে গোয়েন্দাদের রিপোর্টে। কাশ্মীরে মৌলবাদ ছড়ানোর কাছে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছে সে। কাশ্মীরকেও আলাদা রাষ্ট্র করার দাবি নিয়ে স্থানীয় মানুষদের মগজধোলাইয়ের ভার ছিল পুন্নুনের কাঁধে। একবার দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে খলিস্তানি পতাকা তোলারও হুমকি দিয়েছিল এই এসএফজে নেতা। আপাতত আমেরিকাতেই রয়েছেন পুন্নুন।
তবে এই খলিস্তানপন্থি পুন্নুনের জন্ম কিন্তু ভারতেই, পঞ্জাবের অমৃতসরে। পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক পাশ করে সে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাকিস্তান থেকে অমৃতসরের খানকোট গ্রামে এসেছিল পুন্নুনের পরিবার। পঞ্জাবের একটি সংস্থায় কাজ করতেন তাঁর বাবা।
২০১৯ সালে এনআইএ কালো তালিকাভুক্ত করে পুন্নুনকে। সেই বছরই শিখস ফর জাস্টিসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারত। ২০২২ সালের জুলাইয়ে পুন্ননকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করা হয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে। তবে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে রেড কর্ণার নোটিস জারি করেনি ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে। গত বছর হিমাচল প্রদেশ বিধানসভা ভোটের আগে দেওয়ালে দেওয়ালে 'খালিস্তান' ব্যানার এবং গ্রাফিতি আঁকার অভিযোগ ওঠে। সেই কাজের নেপথ্যে ছিল পুন্নুন ও তার দলবল। তার বিরুদ্ধে ভারতে দায়ের হওয়া ষোলোটি মামলার ভিতরে ন'টিতেই রয়েছে বেআইনি কার্যকলাপের অভিযোগ। চারটি দিল্লিতে, দুটি পাঞ্জাবে (একটি অমৃতসরে এবং অন্যটি সিরহিন্দে), একটি হরিয়ানার গুরুগ্রামে এবং একটি হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায়। এছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা।
আরও পড়ুন: হিংসা মানবে না কিন্তু হরদীপের পক্ষেই ঝুঁকে কানাডা
ইন্ডিয়া গেটে খালিস্তানি পতাকা উত্তোলন করতে পারলে আড়াই মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা করেন একবার পুন্নুন। ২০২১ সালে স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লায় ভারতের পতাকা উত্তোলন আটকানো পুলিশকর্মীকে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। পাঞ্জাব, দিল্লি, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ এবং হরিয়ানার বিভিন্ন স্থানে খালিস্তানি পোস্টার এবং পতাকা লাগানোর চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যেই অমৃতসরে পুন্নুনের বাড়ি ও তার কৃষিজমি বাজেয়াপ্ত করেছে এনআইএ। হরদীপ কাণ্ড এবং কানাডার সঙ্গে অশান্তির পর থেকে ভারতের নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। কানাডা-ভারত দ্বন্দ্বে হরদীপের মতোই নতুন কোনও কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না তো পুন্নুন, তার মধ্যে আবার জড়িয়ে রয়েছে আমেরিকার নামও। ফলে ব্যাপারটি বেশ ভাবাচ্ছে ভারতের কূটনৈতিক মহলকে।