একুশের ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ তিনি, রফিকের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও

Rafiq Uddin Ahmed 21 February Language Movement : হিসেব বলে, বাংলা ভাষার আন্দোলনে প্রথম গুলিটি ছুটে এসেছিল তাঁর দিকেই। হ্যাঁ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ রফিক।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ জুড়ে তখন বিধ্বস্ত অবস্থা। কিছুক্ষণ আগেও এমন পরিবেশ ছিল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে চেহারাটার ছবিটাই বদলে যায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাসপাতাল চত্বর। ভেতরে যেখানেই দেখা যাচ্ছে, কেবল লাশ আর লাশ। কারও আবার চিকিৎসা চলছে। সেখানেই কয়েকজন যুবক ধরাধরি করে নিয়ে এল একজনকে। শ্যামলা বর্ণের রোগা এক যুবক। হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তিনি পড়েছিলেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা শরীর। মাথায় গভীর একটা ক্ষত; এক নজরেই বোঝা যায় ঘাতক গুলি ওখানেই লেগেছে। যুবকটি যে বেঁচে নেই, সেটা তখনই বুঝে গেলেন সবাই। অ্যানাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে শুয়ে রাখা হয় তাঁকে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলেন ডাঃ মশাররফুর রহমান খান। হাতে ধরা রক্তাক্ত মস্তিস্কের অংশ। গুলির আঘাতে যুবকের খুলি ফেটে ছিটকে পড়েছে সেসব…

খানিক পর সেই যুবকের দেহটির সামনে এসে দাঁড়ালেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। ঢাকা কলেজের এই ছাত্র, অনুবাদক, লেখক দেখলেন, এক দোহারা যুবকের শরীর থেকে নদীর মতো বেরিয়ে যাচ্ছে রক্ত। চোখে নিভে গিয়েছে অজস্র স্বপ্ন। ইনিও তো আমার ভাই! আমারই আপন মায়ের পেটের সন্তান হতেই পারতেন। সে না হোক, তবুও এই যুবক আমার ভাই। আবদুল গাফফার চৌধুরী ভেবে ফেললেন দু’টি লাইন – “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি”। সামনে শুয়ে রয়েছেন সেই যুবক, নাম রফিকউদ্দিন আহমদ ওরফে রফিক। দিনটা? ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।

আরও পড়ুন : ছত্রে ছত্রে লেগে রয়েছে একুশের রক্ত, যেভাবে তৈরি হল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি

সালাম, বরকত, জব্বর… এরকম অজস্র তরুণের লাশ দেখেছিল সেদিনের ঢাকা। দেখেছিল রক্তে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত তল্লাট। অথচ এঁরা প্রত্যেকেই স্রেফ বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য লড়াই করছিল। মিছিল করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের জুলুমনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। তারই প্রতিদান এল গুলি আর বেয়নেটে। এই অগুনতি তরুণ পড়ুয়াদের মধ্যেই অন্যতম ছিলেন রফিকউদ্দিন আহমদ। মাত্র ২৫ বছর বয়স ছিল তখন। পাকিস্তান সরকার ও পুলিশের গুলি চালনার ঘটনায় ২১ ফেব্রুয়ারি দেখেছিল তাঁর মৃত্যু। ইতিহাস অবশ্য সালাম-বরকত-জব্বরদের সঙ্গেই তাঁর নাম উচ্চারণ করে। হিসেব বলে, বাংলা ভাষার আন্দোলনে প্রথম গুলিটি ছুটে এসেছিল তাঁর দিকেই। হ্যাঁ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ রফিক।

১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর। মানিকগঞ্জের পারিল গ্রামে জন্ম রফিকউদ্দিন আহমদের। এখন অবশ্য তাঁর সম্মানে এলাকাটির নাম হয়েছে রফিকনগর। ছোট থেকেই দুরন্ত রফিক পড়াশোনায় যে দুর্বল ছিলেন, তা একদম নয়। কিন্তু দুরন্তপনার জন্য প্রায়ই চোট আঘাত নিয়েঘরে ফিরতেন। একবার সেই চঞ্চলতার জন্য গাছ থেকে পড়ে যান তিনি। ভাঙা হাত নিয়ে চিকিৎসার জন্য সোজা চলে আসেন কলকাতায়। শিয়ালদহের কাছে মিত্র ইনস্টিটিউশনে লেখাপড়াও শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই কাজে বাধা দিল তৎকালীন পরিস্থিতি। ১৯৪৬ সাল। দেশভাগের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। বাংলা জুড়ে চলছে ভয়ংকর দাঙ্গা। দিকে দিকে জ্বলছে আগুন। সেই দাঙ্গার পরই কলকাতা ছাড়েন রফিক। এরপর ওপার বাংলাই হয়ে যায় ঠিকানা।

ঢাকায় আসার পর শুরু হয় নতুন জীবন। স্কুল পাশ করার পর ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন তিনি। এদিকে রফিকের বাবার ছিল প্রিন্টিংয়ের ব্যবসা। সেই কাজে বাবাকে সাহায্যও করতে হতো। তাই কলেজের সান্ধ্য বিভাগে ভর্তি হন তিনি। একটু একটু করে শুরু হয় কবিতা চর্চাও। সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গেও জুড়ে যান তিনি। আর এখান থেকেই শুরু হয় রাজনৈতিক দীক্ষা। সেই সময় বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) টালমাটাল পরিস্থিতি। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের সঙ্গে চলছে বিরোধ। তাদের রীতি নীতি কিছুই বুঝতে পারছেন না ওপার বাংলার মানুষরা। মাতৃভাষা বাংলাকে দমিয়েরেখে জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া – এর বিরুদ্ধে একটু একটু করে ক্ষোভ বাড়ছিল। ক্ষোভ বাড়ছিল রফিকের মনেও। মায়ের ভাষাকে অপমান করার এত সাহস পায় কী করে এরা!

আরও পড়ুন : আমার বোনেরও বর্ণমালায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি! ভাষা আন্দোলনে অনুচ্চারিত মেয়েদের কথা

ঢাকায় বাবার দেখাদেখি নিজের ব্যবসা শুরু করার দিকেও মন দেন রফিকউদ্দিন। ‘কমার্শিয়াল আর্ট প্রেস’ নামে শুরু হয় আরও একটি নতুন যাত্রাপথ। ব্যবসা বেশ ভালোই এগোচ্ছিল। সেইসঙ্গে চলছিল পড়াশোনা, রাজনীতি, প্রতিবাদ। এদিকে জীবনে এগিয়ে আসে আরও একটি অধ্যায়। পারিল গ্রামেরই একটি মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই ভাব ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল রফিকের। মেয়েটির নাম রাহেলা খাতুন পানু। একটু একটু করে ২৫ বছর বয়স হয়ে গেল রফিকের। এবার তো বিয়েশাদি করতে হয়! বাড়িতে রাহেলার কথা বলেন রফিক। দু’পক্ষই রাজি। এবার তো বিয়ের কেনাকাটা করতে হয়!

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাতে রফিক তাঁর ভগ্নিপতি মোবারক আলি খানের কারখানায় যান। তখনই গোলমালের খবর কানে আসছিল। তখন ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সেই আইন ভঙ্গ করে নাকি ছাত্র-যুবরা মিছিল বের করবে! সমস্ত তল্লাটে শুরু হয় কানাঘুষো। রফিকের শিরায়ও আগুন জ্বলে ওঠে। মোবারক আলি খান কি কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন? ওইদিন রাতেই তিনি রফিককে মিছিলে যেতে নিষেধ করলেন। রফিক জানান, তিনি পরদিন ঢাকায় যাবেন বিয়ের কেনাকাটি করতে। সেসব সেরেই চলে আসবেন।

আরও পড়ুন : বিশ্বের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন ঘটেছিল এই বাংলায়, জানেন কীভাবে জন্ম হয়েছিল পুরুলিয়া জেলার

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বিয়ের কেনাকাটির ফর্দ নিয়ে ঢাকায় হাজির হন রফিক। এদিকে ততক্ষণে ছাত্র-যুবকদের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য এই মিছিল, শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এই মিছিল। রফিক সবকিছু ভুলে সেই মিছিলেই যোগ দিল। হঠাৎ ওই তল্লাটে চলে এল অজস্র পুলিশ। কাঁদানে গ্যাস, লাঠির পাশাপাশি বন্দুকও তৈরি রাখল তারা। একসময় ঝাঁকে ঝাঁকে শুরু হল গুলিবর্ষণ। রফিক তখন মিছিলে, ঢাকা মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে। প্রথম গুলিটিই সোজা এসে তাঁর মাথায় লাগে। খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে যায় বুলেট। বিয়ের ফর্দে এসে মিশল রক্ত। বাংলা অক্ষর স্নান করল শহিদের রক্তে।

শোনা যায়, সমস্ত ‘কাজ’ হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানি পুলিশবাহিনী রফিকের নিথর দেহ তুলে নিয়ে যায়। এই মৃতদেহগুলি ঘিরে প্রবল প্রতিরোধ হতে পারে, এই আশঙ্কায় তড়িঘড়ি আজিমগঞ্জের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনও ফলক নেই, চিহ্ন নেই… কিচ্ছু নেই! ঠিক কোথায় রফিকউদ্দিন আহমদকে কবর দেওয়া হয়েছে, তা আজও জানা যায়নি। অজস্র কবরের মাঝেই লুকিয়ে থেকে গেলেন ১৯৫২-র প্রথম ভাষা শহিদ।

More Articles