একই মঞ্চে পুরুষ ও নারী চরিত্রে অভিনয়, 'ভালোমানুষ' কেয়ার মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত

সুসেন: সেই সময়ে মাঝগঙ্গায় শ্যুটিং করার অনুমতি ছিল? অভিনেত্রী স্বয়ং কেন ডামি ছাড়াই ঝাঁপ দিলেন জলে? জাল পাতা ছিল কি? ব্যবস্থা ছিল লাইফবোটের? সাঁতার না-জানা কেয়া এরকম ঝুঁকি নিলেন কেন? তাঁকে কি জোর করা হয়? না কি তিনিই চাপ দেন পরিচালককে? নিছক দুর্ঘটনা? না কি আত্মহত্যা? হত্যা নয় তো? কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল কি? নাকি পরিবার ,কেরিয়ার , দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে তিনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন জলে? আর তারপর শাড়ি জড়িয়ে যায় লঞ্চের প্রপেলারে৷ লঞ্চ এগিয়ে যায়, যাওয়ার পথে মারণ আঘাত করে যায় তাঁর মুখে ,মাথায় ! ১৯৭৭ সালের ১২ মার্চে বাংলা রঙ্গমঞ্চের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীর ওই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার প্রায় ৪৫ বছর পরেও বহু প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে যায় ৷

একই মঞ্চে পুরুষ ও নারী চরিত্রে অভিনয়, 'ভালোমানুষ' কেয়ার মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত

চিত্রঋণ : Google

বিরল প্রতিভার নাট্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন কেয়া। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় করতে ভালবাতেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে ছাত্রাবস্থায় আন্তঃকলেজ নাট্যপ্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের জন্য পুরস্কার পান। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় যুব উৎসবে দিল্লি এবং মহীশূরে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন নাট্য প্রদর্শনে। অবশ্য বাংলা রঙ্গমঞ্চে নান্দীকার গোষ্ঠীর প্রযোজিত নাটকগুলিতে অভিনয়ের মাধ্যমে কিংবদন্তি অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন তিনি। সম্ভবত গ্রুপ থিয়েটারে তাঁর প্রথম অভিনয় ১৯৬১ সালে ‘চার অধ্যায়’ নাটকে। এরপর ১৯৬৬ সাল থেকে নিয়মিত অভিনয়ের কাজে জড়িয়ে পড়েন। ‘তিন পয়সার পালা’ অভিনয়ের পর তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ব্রেখটের নাটকের বাংলা সংস্করণ ‘ভালো মানুষ’ নাটকে দ্বৈত- চরিত্রের অভিনয় তাঁকে প্রবল সুখ্যাতি এনে দেয়। ‘আন্তিগোনে’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’ র পুরস্কার পান। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে বিনা বেতনে তিনি নান্দীকারের সর্বক্ষণের কর্মী হন। তাঁর শেষ অভিনীত নাটক ‘ফুটবল’। তার প্রায় শতাধিক বেতার নাটক রয়েছে |

একজন বিদগ্ধ অধ্যাপক ও সুলেখক কেয়া স্কটিশ চার্জ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপনায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন | কি রকম জনপ্রিয়তা? বিশিষ্ট লেখক অনিল আচার্য্য-র কথায়, কেয়াদি যখন আমাদের অধ্যাপক হয়ে এলেন তখন আমরা তাঁর নাটক-সম্পর্কিত প্যাশন জানতাম না ৷ শেক্সপিয়রের বহু নাটকের সংলাপ তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল ৷ কয়েকবার এই সব সংলাপ বলে প্রশ্ন করতেন শেক্সপিয়রের কোন নাটক থেকে এটি নেওয়া হয়েছে ৷ নাটকের নাম বললে রেহাই মিলত না ৷ চরিত্রের নাম বলতে হত ৷ একবার এই সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারায় তিনি আমাদের কফি হাউসে খাইয়েছিলেন ৷ কিন্তু নাটকের জন্য অধ্যাপনার ভাল মাইনের চাকরিও ছেড়ে দেন।

কেয়া চক্রবর্তীর বন্ধু কাজল চৌধুরীর লেখায় পাওয়া যায় কেয়ার দল বেঁধে সিগারেট খাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া-র মত ঘটনার উল্লেখ ৷ শেষের প্রসঙ্গটি তো যথেষ্ট দুঃসাহসিক। কাজল লিখেছেন,‘ তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি ৷ একদিন কেয়া এসে বলল, ‘কাজল, একটা জায়গায় আমার না ওদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, ওরা কেমন করে থাকে? কেমন করে দিন কাটায়?’ আমি বললাম, ‘যাব কিন্তু কোথায়?’ কেয়ার ঝটপট উত্তর, ‘কলেজের কাছেই৷ সোনাগাছি বলে একটা জায়গা আছে, ওখানে না বেশ্যা মেয়েরা থাকে ৷ চল না দেখে আসি ৷ একটু ভাবটাব করি, ওদের সঙ্গে কথা বলে আসি ৷ ওরাও তো আমাদের মতোই মেয়ে, কী আর করবে?’…কেয়ার দুঃসাহসী অভিযানের কথা শুনে চমকে উঠেছিলাম- ‘সাহস তো তোর কম নয় ! তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? তুই যা, আমি যাব না ৷’ কিন্তু কে শোনে কার কথা, জেদ চেপেছে কেয়ার, যাবেই আর আমাকেও নিয়ে যাবে৷ ফলে শেষ পর্যন্ত যেতে হল…৷ অভিযান সফল হয়নি৷ তাড়া খেয়ে চলে আসি দু’জনেই৷’

একই মঞ্চে পুরুষ ও নারী চরিত্রে অভিনয়, 'ভালোমানুষ' কেয়ার মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত

চিত্রঋণ : Google

পরিচিত নাট্য ব্যক্তিত্ব অশোক মুখোপাাধ্যায় তাঁর একটি স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ১৯৬৬ সাল থেকে কেয়া নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন নান্দীকারে। তারপর অচিরেই স্বীয় ক্ষমতায় কেয়া হয়ে ওঠেন নান্দীকারের অন্যতম মুখ। অজিতেশ ও রুদ্রপ্রসাদের পাশাপাশি কেয়ার নামও জড়িয়ে যেতে থাকে নান্দীকার নেতৃত্বে। ১৯৬৯ সালে রঙ্গনা মঞ্চে নিয়মিত অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নেয় নান্দীকার। তিন পয়সার পালা দিয়ে শুরু হয় সেই অভিযান। জনপ্রিয় সেই নাট্যে কেয়ার অভিনয়ও স-প্রশংস নজর কেড়েছিল। এরপর ৩/৪ বছর অনেকগুলি প্রযোজনা তেমনভাবে সাড়া না পাওয়ায় নান্দীকার প্রযোজনা করে ভালোমানুষ। এর অসাধারণ সাফল্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে ছিল নারী-পুরুষের দ্বৈত চরিত্রে কেয়ার দারুণ অভিনয়। অবশ্য মঞ্চ অভিনয়ে বরাবরই গুরু হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে রেখেছেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

খানিকটা আবেগতাড়িত হয়েই অশোকবাবু জানিয়েছেন , যেদিন রঙ্গনায় প্রথম দেখতে যাই নাটকটি, অভিনয় শেষে ব্যাকস্টেজে গিয়ে দেখি ইংলিশ চ্যানেল জয়ী মহিলা সাঁতারু আরতি সাহা কেয়াকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন আর বলছেন, ‘ কী করে যে তোমরা পারো ! আমি তো স্টেজে উঠলে কথাই বলতে পারব না।‘ এর প্রায় বছর তিনেক বাদে যেদিন গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ গেল কেয়ার, তখন আমার ওই কথাগুলো মনে পড়েছিল। মনে হয়েছিল, জলে পড়লে আরতি সাহা-র কিছুই হত না। পাকা সাঁতারু। বেরিয়ে আসতেন ঠিক। যেমন মঞ্চে কেয়ার ছিল সাবলীল সন্তরণ প্রণালী। যার যেথা স্থান !

বিয়ে হয়েছিল নান্দীকারের আর এক সহকর্মী অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে। কিন্তু দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল কোনও সূত্রেই এরকম সুখবর পাওয়া যায়নি। মিসেস আর পি সেনগুপ্ত ' ৷ এই শিরোনামেই এক নাট্যপত্রিকায় রম্যরচনা লিখেছিলেন কেয়া ৷ তিনি লিখেছেন , 'এই নিয়ে ৬ বার উঠলাম- - মানে এই লিখতে বসে আধ ঘণ্টাটাকের মধ্যে৷ একবার গয়লা এল, সদর দরজা খুললাম ৷ স্বামী গেঞ্জি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, খুঁজে দিলাম .. . টেলিফোন এল দুটো' ৷ কিংবা , 'আজ সন্ধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির একটা ছবি দেখতে যাব ভেবেছিলাম ৷ অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস- এ ৷ উনি মানা করেছেন. .৷' 'অধ্যাপনার চাকরি ছাড়ার পর উপার্জনের মূল উপায় বাটা কোম্পানির জন্য বিজ্ঞাপন লেখা। নাটক থেকে তো উপার্জন প্রায় কিছুই হয় না। বেতার নাটকে সামান্য উপার্জনের সুযোগ ছিল। কিন্তু মায়ের চিকিৎসার জন্য অর্থের প্রয়োজন পড়ে। আর সে কারণেই সিনেমায় অভিনয়। চলচ্চিত্রের নাম, 'জীবন যে রকম', চরিত্রটি এক অন্ধ মায়ের। লঞ্চে করে মা-ছেলে যেতে যেতে জলে পড়ে যায় ছেলে। তাকে বাঁচাতে মা’ও ঝাঁপ দেন মাঝ দরিয়ায়। এই দৃশ্যেরই শ্যুটিং করতে গিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান বছর পঁয়ত্রিশের কেয়া।

১৯৭৭ সালের ১৪ মার্চ। শহরের সব নাট্যমোদীদের গন্তব্য সেদিন উত্তর কলকাতার ২০এ, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিট। সন্ধে নামার একটু আগে শববাহী কাচের গাড়িতে ওই বাড়ির সামনে আনা হল অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীকে। শ্যাওলা রঙা মুখটুকু তখন জেগে শুধু। সারা শরীর ফুলে মোড়া। দু’দিন আগে ‘জীবন যে রকম’ ছবির শ্যুটিংয়ে গিয়ে মাঝগঙ্গায় তলিয়ে যান তিনি। পর দিনই সকালে সাঁকরাইলের ঘাটে ভেসে ওঠে তাঁর দেহ। রাস্তায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ভিড় ঠেলে কোনওরকমে আনা হয়েছিল ওঁর মা লাবণ্য দেবীকে।

অভিনেত্রীর ওই রহস্যজনক মৃত্যুর পর শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘‘কেয়ার মৃত্যুর পরদিন সকালে কোনও এক বাড়ির পরিচারিকা তার কর্ত্রী গৃহিণীকে এসে বলেছিল, শুনেছেন কেয়া চক্রবর্তী মারা গেছেন? একটু অবাক হয়ে গৃহিণী তাকে জিজ্ঞেস করেন: শুনেছি, কিন্তু তোমরা জানলে কী করে? বাঃ আমরা শুনব না? খবর পেয়ে আমাদের বস্তিসুদ্ধ লোক কেঁদে সারা। আমরা যে সব দল বেঁধে ওর ‘ভালোমানুষ’ দেখতে গিয়েছিলাম। উনি তো আমাদের কথা বলতেন। উনি তো আমাদেরই লোক ছিলেন। আমরা জানব না?’’

 

তথ্যসূত্র - কেয়া চক্রবর্তী মৃত্যু - হত্যা ? দুর্ঘটনা ? আত্মহত্যা ? -অঞ্জন দত্ত, কেয়াঃ জীবন ও মৃত্যুতে স্বাতন্ত্রে চিহ্নিত - অশোক মুখোপাধ্যায়, অভিনয়ের মাঝখানে তলিয়ে গেলেন কেয়াদি - অনিল আচার্য্য, এই সময়, ৩ আগস্ট, ২০১৩, কেয়ার মতো- আনন্দবাজার পত্রিকা - ৯ জুলাই, ২০১৫

 

More Articles