আয়ু কমছে তিলোত্তমার, উন্নয়নের তোড়ে কলকাতারও অবস্থা জোশীমঠের মতোই!
Kolkata Cracks: মানুষ চেয়েছে সুবিধাকে পর্বতচূড়ায় নিয়ে যেতে, উন্নয়নকে জলের তলায় ঢুকিয়ে দিতে, যাদের জন্য এই উন্নয়ন- বিপদে আসলে পড়ছেন তাঁরাই।
জোশীমঠ যে কোনও মুহূর্তেই হুড়মুড়িয়ে ধসে যেতে পারে। বাসিন্দারা ঘরছাড়া, বাড়িতে, রাস্তায় বিশাল ফাটল। এতদিন নানা চিঠিপত্র দিয়ে আশঙ্কার কথা জানালেও টনক নড়েনি। এবার ফাটল দেখা দিতেই তড়িঘড়ি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে নির্মাণকার্য। সবাইই জানেন, পার্বত্য অঞ্চল দুর্বল। সেখানে পাথর ফাটিয়ে, মাটি খুঁড়ে চাইলেই বড় বড় বিল্ডিং গড়া বা বিশাল নির্মাণকার্য চালানো যায় না। সবাই জানলেও, সবাই মানেন না। প্রকৃতিজাত হলেও, প্রকৃতিকে ১০ গোল দেওয়া বাসনা রয়েছে মানুষের। প্রকৃতিকে বেচেই দাঁড়িয়ে আছে কত কত জায়গার অর্থনীতি! তবু, উন্নয়নের কথা ভাবতে গিয়ে আর মানুষ নিজেদের সুরক্ষার কথাই ভাবছে না। শুধু তো জোশীমঠ নয়, কলকাতা, রানিগঞ্জের মতো শহরগুলিও হামেশাই ধসছে। মাসখানেক আগেও রানিগঞ্জের বাজার এলাকায় মূল সড়ক ধসে যায়, কলকাতার কেন্দ্রে বাড়িতে বাড়িতে ফাটল। যে কোনওদিন তবে তলিয়ে যাবে তিলোত্তমাও? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশঙ্কা অমূলক নয়।
জোশীমঠের মতো দুর্যোগ দু'ভাবে তলিয়ে দিতে পারে কলকাতাকে। হিমালয়ে যদি কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের জলস্তর দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলি জলের তলায় যেতে পারে, বিশেষত সুন্দরবন। এই ঘটনা ছাড়াও বিপদের কারণ লুকিয়ে আছে মানুষেরই হাতে। সাম্প্রতিককালে জোশীমঠের মতো মানুষের সৃষ্ট বিপর্যয়ের নজির দেখেছে কলকাতা। মেট্রোর উন্নয়ন করতে গিয়ে বাড়িছাড়া হয়েছেন মানুষ। গতবছর অক্টোবরেই ফের ফাটল দেখা দেয় বউবাজারে। এর আগে, ২০১৯ সালের ৩১ অগাস্ট, বউবাজারের বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, বউবাজার স্ট্রিট, দুর্গা পিতুরি লেনের বাসিন্দাদের ঘরছাড়া হতে হয়েছিল। মেট্রো রেলের কাজের জন্য একের পর এক বাড়িতে বিশাল ফাটল দেখা দেয়। বিশাল বিশাল বাড়ি ধসে গিয়ে হেলে পড়ে। জোশীমঠের মতোই, এখানেও সারা বাড়ি থরথর করে কেঁপেছে, ভোর রাতে বাসিন্দারা দেখেন যত্নে গড়া বাড়িতে বিশাল ফাটল। যে কোনও মুহূর্তেই তলিয়ে যাবে আস্ত বাড়িই।
আরও পড়ুন- গঙ্গার নীচেই ছুটবে ট্রেন, নতুন বছরেই শুরু হতে চলেছে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো পরিষেবা?
মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, টানেল বোয়িং মেশিন দিয়ে মেট্রো রেলের জন্য সুড়ঙ্গ কাটার সময় মাটির ২২ মিটার গভীরে জমে থাকা জলস্তর ভেঙে পড়েছিল। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মাটি বসে গিয়ে বউবাজারের দুর্গা পিতুরি লেন ও স্যাঁকরাপাড়া লেনের ৭৪টি বাড়ি হয় ধসে পড়ে অথবা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬৭৪ জন বাসিন্দাদের অন্যত্র সরাতে হয় প্রশাসনকে। মেট্রোর সুড়ঙ্গে জল ঢুকে যায় মোট ১১টি জায়গা দিয়ে। ফলে দুর্বল হয়ে যায় মাটি। সেই কারণেই বাড়িতে ফাটল ধরে।
উল্লেখ্য, নদীর তলা দিয়ে মেট্রোর পথ তৈরির কাজ চলছে। হুগলি নদীর তলা দিয়ে হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত রাস্তা হবে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর। মোট দৈর্ঘ্য ১৬.৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে ১০.৮ কিলোমিটার পথ মেট্রো যাবে মাটির তলা দিয়েই। নদীর তলা দিয়ে মেট্রো চালানোর পরিকল্পনা শুনতে যতটাই দুর্দান্ত মনে হোক না কেন, এর ফলে কী কী বিপদ হতে পারে, তার পূর্বাভাস কলকাতা ইতিমধ্যেই পেয়েছে। নদীর মধ্যেকার জমি স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল। সেখানে যত উন্নত কৌশলই আমদানি করা হোক না কেন, নদীর জলস্তর বা জলের চাপ কখন কীভাবে বদলায়, কোন টেকটনিক প্লেটের গতি কী হবে, প্রকৃতির কোন বিপর্যয় কখন কীভাবে ছাপ ফেলে আগাম বলা সম্ভবই নয়।
আরও পড়ুন- একা জোশীমঠ নয়, তলিয়ে যেতে চলেছে হিমালয়ের এই বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্রগুলিও!
খনি অঞ্চলের জমি ভেতরে ভেতরে ফাঁপা হয়ে গিয়েছে। কয়লা তোলার পরে খাদান পর্যাপ্তভাবে ভরাটের কোনও সুব্যবস্থা থাকে না। রানিগঞ্জ এবং লাগোয়া এলাকায় তাই প্রায় প্রতিবছরই সড়ক ধরে যাওয়া, বাড়িতে ফাটল নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার মতো নদী লাগোয়া দুর্বল শহরে ইতিমধ্যেই যা উন্নয়ন, যা প্রকাণ্ড বাড়ি, যা মানুষের বাস, তা কী ব্যাপক চাপ ফেলে জমির উপর বলা বাহুল্য। কলকাতায় নির্মাণের বিরাম নেই। জোশীমঠেও ছিল না। মানুষ চেয়েছে সুবিধাকে পর্বতচূড়ায় নিয়ে যেতে, উন্নয়নকে জলের তলায় ঢুকিয়ে দিতে, যাদের জন্য এই উন্নয়ন- বিপদে আসলে পড়ছেন তাঁরাই। কলকাতাও একদিন ধসে যেতে পারে, সমস্ত গৌরব ঐতিহ্যকে নিয়েই। জোশীমঠের কারণ আর কলকাতার কারণকে আলাদা করা যাবে না সেখানে, খুব চেষ্টা করলেও।