একটি গ্রন্থাগারের জন্ম, অনেক গ্রন্থাগারের মৃত্যু

মহাদ্যুতি চক্রবর্তী: এই শহরের সমস্ত মানী লোকই তাঁকে চেনেন। বাবা সুনীত বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের নামকরা অধ্যাপক। মেজোদাদা সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও দেশের বিদগ্ধ সমাজবিদ। তবে এসব কিছুই তাঁকে পরিচিত করানোর জন্য প্রয়োজনীয় নয়। নাট্য গবেষণা, গ্রন্থচর্চা, শিল্পকলার ইতিহাস চর্চা, সম্পাদনা- যে পথেই তাকিয়ে দেখা যাক না কেন, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই নিজের তুলনা, তিনি সম্ভবত এই শহরের শেষ দুচারজন পলিম্যাথের (বিবিধ বিষয় সমান দক্ষতায় বিষয়চর্চাকারী) একজন। তাঁর প্রতিটি নতুন কাজই শহরের চোখ টানবে তা তো বলাই বাহুল্য। তবে তাঁর সাম্প্রতিকতম অভিযানটি দুঃসাহসিক, একার্থে অভিনব। ৪০ হাজারেরও বেশি গ্রন্থ, দুষ্প্রাপ্য পত্রিকা-সম্বলিত নিজস্ব গ্রন্থাগারের দরজা, শমীক সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে চলেছেন। শমীক নানা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন এই গ্রন্থাগারটি, সর্বসাধারণের জন্য একটি সংগ্রহশালা হবে। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে ডিজিটাল ক্যাটালগিং। পাঠক একটি নির্দিষ্ট গ্রন্থচর্চা করার সময়ে সেই গ্রন্থে রেখে যাওয়া পূর্ববর্তী পাঠক অর্থাৎ শমীক বা তাঁর পরিবারের অন্য বিদগ্ধজনের অনুসন্ধানের ছোঁয়াচ পাবেন অচিরেই। এমন অভিনব খবরে শিহরিত হই, এ তো আসা নয়, মহাসমারোহে আবির্ভাব। আর

ঠিক এই সময়ে মন চলে যায় কলকাতার পুরনো গ্রন্থাগারগুলিতে। এ শহরে যখন এমন একটি সম্ভাবনার জন্ম হচ্ছে ঠিক তখনই যেন নিঃশব্দে সমাধিস্থ হচ্ছে বহু গ্রন্থাগারের। কোনও সংবাদমাধ্যমের পাতায় গ্রন্থাগারের মৃত্যু সেভাবে জায়গা পায় না। এই স্বল্প পরিসর, তাই টুপি খুলে শমীককে কুর্ণিশ আর দু’ফোটা চোখের জল রইলো কলকাতা ও সংলগ্ন শহরাঞ্চলের গ্রন্থাগারগুলির জন্য। এ লেখাতেই ঘুরে আসতে চাই এমনই একটি লাইব্রেরিতে যা পায়ে পায়ে ১০০ বছর পার করে ফেলেছে।

১৯২১ সাল কলকাতা শহরের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই বছর মহাত্মা গান্ধী অসহযোগের বার্তা নিয়ে কলকাতা এলেন প্রথমবার। গ্রাম নগর মাঠ পাথার ভেঙে পড়ল একবার বাপুকে ছুঁয়ে দেখতে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই নেতাজি সুভাষ হরতালের ডাক দিলেন। স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ল রোষানল।দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে একেরপর এক ব্রিটিশ বিরোধী সংগঠিত আন্দোলন মাথাচাড়া দিল। এই এতসব নাটকীয় ঘটনার আবহে মধ্য-কলকাতার কপালিটোলা অঞ্চলে একটি অকিঞ্চিৎকর লাইব্রেরির গড়ে ওঠা অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের শুক্তি ভেঙে মুক্তাফল খুঁজতে নেমে দেখি বিগত ১০০ বছরের রণ-রক্ত সফলতার বীতশোক গাঁথা বুকে নিয়ে আজও জীবন্ত জীবাশ্মের মত দাঁড়িয়ে আছে এই বইঘর, যা দূর থেকে সামান্য তবু স্মরণযোগ্য, অন্তত বইপোকাদের জন্য।

 

একটি গ্রন্থাগারের জন্ম, অনেক গ্রন্থাগারের মৃত্যু ছবি সৌজন্যে: লেখক

উনিশ শতকে, যখন গ্রামীণ মানুষ রুজি রোজগারের খোঁজে কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ছিল গোষ্ঠীবদ্ধভাবে, কলকাতায় নানা ছোট বড় টোলা গড়ে ওঠে পেশার নিরিখে। টোলা শব্দটি এসেছে টোল নামক সংস্কৃত শব্দটি থেকে। এর আক্ষরিক অর্থ অস্থায়ী আবাস। এই কারণেই গুরুগৃহকে টোল বলা হত। জীবিকার রকমফের অনুযায়ী কলকাতায় প্রান্তিক মানুষের তৈরি এই কৌমগুলিকেই টোলা হিসেবে চিহিত করা হতো। যেমন শ্যামবাজারে কম্বুলেটোলা (শীতবস্ত্রের কারিগরদের বাসস্থান), আহিরীটোলা (পাখি শিকারিদের বাসস্থান),পটুয়াটোলা তেমনই পূর্বে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি এবং উত্তরে চিৎপুর কালীবাড়ি থেকে প্রায় সমদূরত্বে তৈরি হল তান্ত্রিক জড়িবুটি তাবিজ কবজ বিক্রেতাদের থাকার জায়গা কপালিটোলা। এই কাপালিটোলারই বাসিন্দা গিরিশচন্দ্র দাশের ইচ্ছেয়, আত্মীয় বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় শ’খানেক বই নিয়ে যাত্রা শুরু করে 'কপালিবান্ধব গ্রন্থাগার'।

এলাকার সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে ন্যূনতম শিক্ষা দেওয়া ও ক্লান্তি অপনোদন, এই ছিল গিরিশচন্দ্রের লক্ষ্য। ১৯২১ এর ১-লা জুলাই নিজের বাড়ির নীচেই একটি ঘরে এই গ্রন্থাগারের দ্বার খুলে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে কলকাতায় তখনও রেডিও আসেনি, রেডিও পরীক্ষামূলক ভাবে আসবে ১৯২৩-এ, এবং পাকাপাকিভাবে ১৯২৭ এর আগস্ট মাসে, টিভি ৬০ এর দশকে, ফলে শিক্ষিত মানুষের বইপড়া ব্যতীত অন্য অনুষঙ্গ তেমন ছিল না বললে ভুল হবে। স্বাভাবিক ভাবে অন্য লাইব্রেরিগুলির মতই অচিরেই এটিও অল্পদিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বাড়তে থাকে

বইয়ের সংখ্যা। এক সময়ে (১৯৬৭) স্থান সংকুলান অসম্ভব পড়লে কর্পোরেশানের বদান্যতায় লাইব্রেরিটি উঠে আসে তাঁর আজকের ঠিকানা ২/১ বি কপালিটোলা লেনের ঠিকানায়। কাপালিটোলা গ্রন্থাগারের ভৌগলিক অবস্থান খুব অদ্ভুত। শহরের অন্য সব লাইব্রেরিগুলি সাধারণত থাকে লোকালয়ের ভেতরে বা স্কুল-কলেজের গায়ে। এই গ্রন্থাগারটি দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন রাস্তার মোহনায় ব-দ্বীপ হয়ে। তাকে ঘিরেই লোকালয়। জ্ঞানের পিলসুজের সঙ্গে সভ্যতার সম্পর্কের আদিমতম রূপকের মত এর অবস্থান।

 

বাবা গিরিন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর শ্রী কেদারনাথ দাশ এই গ্রন্থাগার দেখভালের দায়িত্ব নেন। আজীবন সেই দায়িত্ব নিয়ে পালন করেছেন। আশির দশক পর্যন্ত এই বই-কেন্দ্রটি ছিল সম্পূর্ণ অনুদানের ওপর নির্ভরশীল, পাঠক-সদস্যদের থেকে, পাঠের জন্য কোনও চাঁদা নেওয়া হত না। নব্বইয়ের শুরুতে মূলত খরচ তোলার জন্যে মাসিক এক টাকা চাঁদা বরাদ্দ করা হয়, এখন এসে তা মাসিক পাঁচ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কাপালিটোলা গ্রন্থাগারে মোট বই আনুমানিক বারো হাজার (বাংলা দশ হাজার, ইংরেজি ২০০০)। ছাই ঘেঁটে যেমন পরশপাথর মেলে, তেমনই সার সার বইয়ের মাঝে একা চুপ করে পড়ে আছে গিরিশ্চন্দ্র বসুর 'ইওরোপ ভ্রমণ' বা 'ক্রনিক্যাল অফ ক্যালকাটা'-র মত দুস্প্রাপ্য বই। লাইব্রেরির মহিলা সদস্যরা নিজেদের উদ্যোগে স্রোতস্বিনী নামক একটি কৃশকায় লিটল ম্যাগাজিন চালান।

 

এতসব আলোকিত ফুলেল গল্পের পাশে জেগে আছে কিছু নিষ্ঠুর সত্যও। গত তিন দশকে খোলনলচে বদলে ফেলে এই অঞ্চল ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। তার মাঝে গ্রন্থাগারটি যেন বেমানান। এই গ্রন্থাগারের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য স্কুল কলেজ, অথচ বিকেল বেলা স্কুল ফেরত একটি ছেলেমেয়েকেও লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেখা যায়নি কত না বছর-কাল, কেউ উৎসাহিত করার জন্য তেমন কোনও উদ্যোগও নেননি। আমাদের পোড়া দেশে চিরকালই বেনে আর বিদ্বানের জীবনযাত্রার

 

মান এক নয়। ফলে গ্রন্থাগারিক নির্মল ভট্টাচার্যকে মাসিক বেতনটুকুও দেওয়া যায় না। এই গ্রন্থাগার নিয়মিত না খোলার বড় কারণ হলো এই রাহাখরচ জোগাড়ের সমস্যা। বারো হাজার বইয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যে প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত আর্কাইভিং (নিয়মিত পেস্ট কন্ট্রোল এবং অন্যান্য ব্যবস্থা)। সদস্যদের মাসিক পাঁচ টাকা চাঁদায় সেই কাজ নিয়মিত করা অসম্ভব। প্রয়োজন অনুদান। গত ৯৫ বছরে দু’বার এক লক্ষ টাকা করে মোট দুই লক্ষ টাকা পাওয়া গিছে অনুদান বাবদ। নতুন করে গ্রন্থকীটরা এগিয়ে না এলে এই প্রাচীন গ্রন্থাগারটি অচিরেই পরিণত হবে উইপোকাদের পিকনিকস্পটে।

 

সেদিন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিদ্বান, দিলখোলা মানুষদের এই শহর কী জবাব দেবে?

More Articles