বিরহ শুধুই বিলাপ নয়, বেদনায় যেভাবে শিউলির মতো হয়ে উঠেছেন রামচন্দ্র, যক্ষ
Love and Longing: বিরহ তো সবার জন্য নয়, বিরহ তো বিলাপের বিস্তারের জন্যও নয় – বিরহ নিজের ভেতরে ধরে রাখার জন্য।
বিরহী কি কেবল বিলাপ করবেন? সেই বিলাপের-বিস্তারেই কি ধরা যায় তাঁর বিরহবেদনা? সীতাকে ধরে নিয়ে গেলেন রাবণ। অপহৃত সীতার বিরহবেদনায় রাম কাতর। সীতাহারা রামের বর্ষাযাপনের বিবরণ দিয়েছিলেন বাল্মীকি। সেই বর্ষাবিরহের বিলাপ সংস্কৃত সাহিত্যের পরমসম্পদ। বাংলায় কৃত্তিবাসী রামায়ণেও আছে রামের বিলাপ। তবে রসিক সাহিত্য পাঠকেরা বলেন বাল্মীকির কাব্যের সঙ্গে কৃত্তিবাসের পাঁচালীর বিলাপের তুলনাই হয় না। কৃত্তিবাসের বিলাপরত রাম যে কান্না কেঁদেছেন তা একেবারেই সাধারণ বাঙালির কান্না। একথা আরেক রকম ভাবে বঙ্কিমচন্দ্রও শুনিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে। বিদ্যাসাগর রামকথা থেকে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর গদ্যগ্রন্থ ‘সীতার বনবাস’। সীতার বনবাসে রাম, প্রজানুরঞ্জক রাম, কেবলই কাঁদছেন – মূর্ছিত হয়ে পড়ছেন। এমন বিলাপরত রাম বঙ্কিমের না-পসন্দ। মহাকাব্যের বীরনায়ক যিনি তাঁর বিলাপের মধ্যে তো আভিজাত্য থাকবে! বঙ্কিম এই কান্নাকাটি করা রামের সূত্রে বিদ্যাসাগরকে এক হাত নিয়েছেন। এ কী মেয়েলিপনা! রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বিলাপকে মেয়েলি বলে মনে করেন না। তাঁর ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে পত্নী বিমলা বন্ধু সন্দীপের দিকে ঝুঁকলে নিখিলেশের মনখারাপ। সেই মনকেমনের প্রকাশ তাঁর অভিজাত বেদনা-বিলাপে। সেও বিলাপ, তবে কৃত্তিবাসী রামের মতো নয়।
বিলাপের মধ্যে অবশ্য কেবল কান্না নাও থাকতে পারে। বিরহ বিলাপ-বিস্তারের আয়তন না পেলে তো লেখাই হত না কালিদাসের মেঘদূত কাব্য। যক্ষ কাজে ফাঁকি দিয়েছে বলে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বাসন দিলেন তাকে। কাজে ফাঁকির শাস্তি। রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত সে। সেখানে বর্ষা এল। মেঘ আলিঙ্গন করল পাহাড়কে। আর সেই দৃশ্য দেখে বিরহী যক্ষ কামমোহিত। চেতন-নিশ্চেতনের জ্ঞান তার চলে গেল। মেঘকে দূত করে সে পাঠাল তার প্রিয়ার কাছে। মেঘ তো জানেনা বিরহী যক্ষের প্রিয়ার ঠিকানা। তাই দীর্ঘ-বিস্তারে বলে চলে যক্ষ – পথের কথা। উজ্জয়িনীর দিকে যেতে যেতে কী কী দেখতে পাবে মেঘ তারই বিবরণ প্রথমে, তারপরে এল উজ্জয়িনীর কথা। এই বিবরণে অবশ্য কেবল কান্না মিশে ছিল না, মিশে ছিল পথের বিস্ময়। রাধার বিরহের কথা জ্ঞাপন করেছেন যে বৈষ্ণবকবিরা তাঁরা অবশ্য কালিদাসের যক্ষের মতো দীর্ঘ-বিস্তারে পথের কথা বলেননি, জানাননি পথের দৃশ্য-বৈচিত্র। অভিসারিকা রাধার যাত্রাপথ বিপদ-কঠিন। পথে কাঁটা আছে, বৃষ্টির অনিবার ধারায় পিচ্ছিল অন্ধকার পথ অতিক্রম করতে হচ্ছে তাঁকে, সর্পসঙ্কুল পথে ঘন-ঘন বাজ পড়ছে। এই দুর্গম পথ ডিঙিয়ে কৃষ্ণকে পাওয়ার আশায় চলেছেন। একমুখী এই যাত্রা। কালিদাসের যক্ষের মতো ধীর লয়ে, নানা বিষয়-আশয় দেখতে দেখতে তাঁর যাত্রা নয়।
আরও পড়ুন- প্রেমে খুনই শেষ সত্য নয়, ‘রক্তকরবী’-র বিশু পাগল তার প্রমাণ
এই সব পড়তে পড়তে মনে হয় বিরহ-বিলাপের প্রকাশ কেমন হবে, কেমন হওয়া উচিত তা ভাবা খুব সহজ নয়। চণ্ডীদাসের পদে কবি যে বিরহিনীর ছবি এঁকেছেন তিনি তো বিরহে যোগিনী। সর্বত্রই তিনি কল্পনা করছেন তাঁর কাছ ছাড়া প্রিয় কৃষ্ণকে। রাধা কৃষ্ণ-বিরহে মেঘপানে চেয়ে থাকেন। শ্যামল মেঘে তিনি শ্যামল কৃষ্ণের রূপ দেখেন। সেই মেঘকে দূত করে কৃষ্ণের কাছে পাঠানোর ইচ্ছে হয় না তাঁর। সেই ইচ্ছে হতে গেলে অন্তত বিরহ-বিপন্নতা থেকে খানিকটা বাইরে আসা প্রয়োজন। কালিদাসের যক্ষের মতো নিজের বিরহদশাকে সবাক-সরবতায় নিয়ে যাওয়া চাই।
তাহলে কি বিরহ-প্রকাশের দু'রকম ধরন? মগ্নবেদনায় কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না, কিছু করতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে সর্বস্ব রিক্ত একা বলে মনে হচ্ছে। আর সেই রিক্তা একাকিনীর অসংলগ্নতাকে প্রকাশ করছেন কবি। বিরহের আরেক রকম প্রকাশ সশব্দ – দীর্ঘবিস্তৃত সেই বাকলতা হতে পারে কেবলই ক্রন্দন-কোমল। পড়ে পড়ে যাচ্ছে। আর সেই পড়ে যাওয়া দেখতে-দেখতে শুনতে-শুনতে মনে হচ্ছে পাঠকের বড্ড অসংযত কথন। বিরহের অনুভবের গাঢ়ত্ব হারিয়ে যাচ্ছে প্রকাশের তরলতায়। যা বেদনার অনুভব তা প্রকাশ বাহুল্যে হয়ে উঠছে চপল। বিরহ-কাতরতাকে চটুল-চপল-হাস্যের বিষয় তো করেই তোলেন কবি-লেখকেরা। রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অলীকবাবু’ নাটক পড়লে টের পাওয়া যাবে তা। সেখানে হেমাঙ্গিনী নামের মেয়েটি যেভাবে প্রেম-বিরহের বিলাপ করে তা হাস্যকর। সবই আসলে প্রকাশের মাত্রাগত পার্থক্যের উপর নির্ভর করে।
আরও পড়ুন- গৃহী রবিঠাকুর ও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ; প্রেমের অলিন্দে অচেনাই রয়ে গেলেন স্বামীজি
আর্যা ছন্দে লেখা প্রকীর্ণ কবিতার এক নায়িকা ক'টি কথা বলেছিল তার সখীদের। বলেছিল,
"এখন রাত্রি তিন-প্রহর। তোমরা কেন জেগে আছ? এই যে বাইরে একে একে ফুটে উঠছে ভোররাতের শিউলি ফুল তারই গন্ধে ঘুম আসছে না আমার। তোমরা নিদ্রা যাও।"
এর বেশি একটি কথাও বলেনি সে। বলার কী দরকার। সখীরা নায়িকাকে বিনিদ্র দেখে বিচলিত। কেন নিদ্রাহারা সে? প্রিয়বিরহেই হয়তো ঘুম আসছে না তার। নিজের বিরহের কথা অবশ্য বলেনি সে, প্রকাশই করেনি। তার জেগে থাকার সম্পূর্ণ অন্য একটি কারণ নির্দেশ করেছে সে। বলেছে শিউলি ফুটে উঠছে আর তার গন্ধে সে নিদ্রাচ্যুত। বিরহ তো শিউলি ফুলের মতো। ফুটে ওঠে – নরম উজ্জ্বল শিশিরসিক্ত তারপর আলো উঠতে না উঠতে দিবালোকের প্রকাশ্যতায় আর কোলাহলে শিউলি হারায় তার সৌন্দর্য। শিউলি ফুল আসলে নিভৃতির, শিউলি ফুল দীর্ঘক্ষণের নয়। সে সকালবেলার, সে ঊষালগ্নের। তখন তাকে দেখার জন্য বেশি কেউ থাকে না।
বিরহ তো সবার জন্য নয়, বিরহ তো বিলাপের বিস্তারের জন্যও নয় – বিরহ নিজের ভেতরে ধরে রাখার জন্য। মন্দিরের শূন্যতার কথা, মনমন্দির আর দেহমন্দিরের শূন্যতার কথা সকলকে বলতে যাবে কেন বিরহী! বিরহ ঐকান্তিক, বিরহ ‘প্রাইভেট’ – তোমরা নিদ্রা যাও। এটুকুই শুধু আকুতি।
শুধু তাই পবিত্র বিরহ যা ব্যক্তিগত একথাও মনে হতে পারে কারও। মনে হয় যাঁর তিনি বিরহে ফুটে ওঠা শিউলিফুল।
শিউলিফুলের লিঙ্গ হয় না।