বর্ধমানে মৃত্যু শের আফগানের! রূপের আগুনে পোড়া এক অবিশ্বাস্য প্রণয়ের গল্প...

এ এক প্রেমের গল্প। তবে আর পাঁচটা মামুলি প্রেমের গল্পের চেয়ে হয়তো কোথাও গিয়ে একটু হলেও আলাদা। এই প্রেমের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে ইতিহাসের এক অবিসংবাদিত অধ্যায়। নিখাদ সম্পর্কের আখ্যানটির গভীরতা কতটুকু, রাজনৈতিক অভিসন্ধি কী ভাবে এখানে মিশে গিয়েছে এই প্রেমের গল্পের সঙ্গে, তার বিচার করবেন পাঠকগণ। 

কাবুল কান্দাহারের  রুক্ষ-শুস্ক পথ। এই পথেই জনৈক এক ইরানি ভাগ্যান্বেষী চলেছেন ভারতের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে তার পরিবার। সালটা ১৬১১ -র আশেপাশে। কান্দাহারের পথে-পথে ফেরা সেই এই ইরানি ভাগ্যান্বেষী  ভাগ্যান্বেষীর কোল আলো এল এক কন্যাসন্তান। কাবুল-কান্দাহারের রুক্ষ নিষ্প্রাণ মাটিতে সেই কন্যাসন্তান যেন এক পশলা বৃষ্টির বিশ্বাস। কান্দাহার থেকে দিল্লি এই সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে করতে সেই ইরানি ভাগ্যান্বেষী কি একবারের জন্যও বুঝতে পেরেছিলেন বর্তমান পৃথিবীর এই অবোধ একরত্তি শিশু ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে ইতিহাসের অন্যতম সাড়াজাগানো চরিত্র? 

কাট টু দিল্লি

 সালটা ১৫৫৬। সময়টা উত্তাল। দিল্লির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। কিছুদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে হুমায়ুনের। সিংহাসনে অভিষিক্ত হয়েছেন হুমায়ুনের নাবালক সন্তান আকবর, মাত্র তেরো বছর বয়সে। আকবরের অভিষেকের কিছুকালের মধ্যেই দিল্লি আক্রমণ করলেন হিমু। মুঘল শাসন তো কোন বড়োসড়ো প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। হিমু কিছুদিনের জন্য দিল্লি দখল করলেও পরবর্তী সময়ে বৈরাম খাঁ কর্তৃক পরাজিত হন। শেষপর্যন্ত ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে বৈরাম খাঁকে সরিয়ে আকবর সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতা দখলে সমর্থ হন।

কাট ব্যাক টু ইরানের মরুভূমি

ফেরা যাক সেই ইরানি ভাগ্যান্বেষীর গল্পে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তাকে কতটা প্রভাবিত করতে পেরেছিল তা জানা যায় না, তবে তিনি ইতিমধ্যেই পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন কান্দাহার থেকে দিল্লির দীর্ঘ পথ।' লেডি লাক ' বোধহয় একেই বলে, দিল্লি আসার কিছুদিনের মধ্যেই পরের রাজসভায় চাকরিতে বহাল হয়েছেন সেই ইরানি ভাগ্যান্বেষী। তবে সঙ্গে তার কন্যা। স্থিতাবস্থা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তার জীবনে। বলতে গেলে আকবরের রাজসভায় বহাল হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই একপ্রকার শনির দশা শুরু হয় সেই ইরানি ভাগ্যান্বেষীর জীবনে। এর মূলেও ছিল তার সেই পরমা সুন্দরী কন্যাসন্তান।

মেহেরুন্নেসার রূপের আগুন

অনেকে হয়তো বা বুঝেও গেছেন সেই ইরানি ভাগ্যান্বেষী আসলে কে। হ্যাঁ, তার নাম গিয়াসউদ্দিন বেগ। আর তার কন্যাসন্তানের নাম? মেহেরুন্নেসা।  আকবরের দরবারে বহাল হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে আকবর পুত্র জাহাঙ্গীর দেখলেন মেহেরুন্নেসাকে। প্রথম দর্শনেই প্রেম, অর্থাৎ love at first sight। মেহেরুন্নেসা ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। এই রূপের আগুনই বোধহয় পরবর্তীকালে পতঙ্গের মত দগ্ধ করে মেরেছে তাকে। প্রেম তো হলো, কিন্তু তার শুভ পরিণয়? না বাস্তবে ঘটল এর উল্টো। আকবর আলি কুলির সঙ্গে বিবাহ দিলেন মেহেরুন্নিসার। আলি কুলি ছিলেন আকবরের বিশ্বস্ত অনুচর। বিবাহের পর আকবর তাকে বর্ধমানের জায়গীরদার করে পাঠালেন বর্ধমানে।

আরও পড়ুন-চা-চরিত আসলে এক কালো কাব্য, কুঁড়ি তোলা ফাটা হাতদুটো কে আর দেখে

না এতেও হয়নি সমস্যার সমাধান। আকবরের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসলেন তার পুত্র জাহাঙ্গীর। অপূর্ণ প্রেমকে কোনোদিনই ভুলতে পারেননি তিনি। সুতরাং সিংহাসনে বসার কিছুদিনের মধ্যেই ছলে-বলে-কৌশলে মেহেরুন্নেসাকে জয় করার চেষ্টা করলেন জাহাঙ্গীর। আলি কুলি তার পথের কাঁটা। এই পথের কাঁটা সরাবার জন্যই একদিন আলি কুলিকে শিকারে আমন্ত্রণ জানালেন জাহাঙ্গীর। জঙ্গলের মধ্যে আলি কুলি পড়লেন বাঘের সামনে। জাহাঙ্গীর ভাবলেন এতদিনে তার প্রেমে পরিপূর্ণতা পেল। মেহেরুন্নেসা এবার চিরদিনের জন্য তার হবেন। কিন্তু আলি কুলি যেন জাহাঙ্গীরের বাড়া ভাতে ছাই দিলেন। তিনি বীরবিক্রমে লড়লেন বাঘের সঙ্গে। আলি কুলি ভূষিত হলেন নতুন নামে - শের আফগান।

এরপরেও অবশ্য হাল ছাড়েননি জাহাঙ্গীর। মেহেরুন্নেসাকে পাওয়ার জন্য তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে রাজি। শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরের নির্দেশে কুতুবউদ্দিন আক্রমণ করলেন শের আফগানকে। প্রবল লড়াইয়ে মৃত্যু হল কুতুবুদ্দিন এবং শের আফগান উভয়েরই। মেহেরুন্নেসার বয়স তখন তেত্রিশ। এর ঠিক চার বছর পরে জাহাঙ্গীর বিবাহ করলেন মেহেরুন্নেসাকে। মেহেরুন্নেসা পেলেন নতুন নাম - নুরজাহান, অর্থাৎ জগতের আলো।

এরপরেও প্রশ্ন ওঠে, জাহাঙ্গীর কি সম্পূর্ণভাবে পেয়েছিলেন তার প্রেমিকাকে? বর্ধমানের বুকে আজও রয়েছে শের আফগানের সমাধি। না বলা হাজারো কথা আর অব্যক্ত কান্না আজও গুমরে মরে সেখানে।

এভাবেই শেষ হলো এক রক্তমাখা প্রেমের অধ্যায়। শের আফগান নাকি জাহাঙ্গীর? নুরজাহান নাকি মেহেরুন্নিসা? বিচারের ভার রইল পাঠকের কাঁধে।

More Articles