হিজড়েরা আসলে হিজড়েই নন! ভয়ানক মাফিয়াচক্রের যোগ তুলে ধরছে লোম খাড়া করা সত্য
Hijra in India: প্রতি এক লক্ষের মধ্যে মোটে একজন জন্মগতভাবে হিজড়ে। অপহরণের আগে ব্রাউন সুগার কিংবা হাসিস খাওয়ানো হয়েছে অনেককেই।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন, এককথায় যাঁদেরকে সমাজ হিজড়ে হিসেবেই মনে করে তাঁদের জীবন নানান সমস্যায় জর্জরিত। বিশেষত মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। ভারতে হিজড়ে সম্প্রদায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। হিন্দু সম্প্রদায়ের সন্তানের জন্ম কিংবা বিয়ের পরে হিজড়েদের ডাকা হয় মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের জন্য। ওঁদের নাচগানে সম্পন্ন হয় মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। নবজাতককে আর্শীবাদ করেন ওঁরা। হিজড়েদের অনেকে যেমন এভাবে মর্যাদা দেন, আবার অনেকে ভয়ও করেন। হিজড়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ওঁরা বেপরোয়া। মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করাতে মোটা টাকা দাবি করেন অনেক সময়েই। না পেলে ক্ষুব্ধ হয়ে গোলমাল পাকান। আর অভিশাপ দেন। অথচ ভারতীয় সমাজে প্রাচীনকাল থেকেই হিজড়েদের গুরুত্ব রয়েছে। যুগ যুগ পেরিয়েও সেই গুরুত্ব আজও নানাভাবে অব্যাহত। হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষই বিশ্বাস করেন হিজড়েদের দৈবশক্তি রয়েছে।
এ সত্ত্বেও সমাজের মূলস্রোতে যুগ যুগ ধরেই ঠাঁই নেই হিজড়েদের। হিজড়েদের নিয়ে গবেষণা রয়েছে নানা সময়ে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে, হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষজন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দরিদ্র। আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বহু মানুষই দু'বেলা দু’মুঠো অন্নের তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষ গোটা সমাজে আজও অবহেলিত এবং ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। হিজড়ের সম্প্রদায়ের মানুষ প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ থেকে কেবল বঞ্চিতই নন, সুস্থ জীবনযাপন করার মতো কাজও ওঁদের জোটে না।
আরও পড়ুন- কৃত্রিম উপায়ে বানানো হচ্ছে ‘হিজড়ে’! খোদ রাজধানীতে যে অন্ধকারে বাঁচছেন রূপান্তরকামীরা
গোটা ভারতজুড়েই ছড়িয়ে রয়েছেন হিজড়েরা। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলি, উত্তর ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হিজড়ের বসবাস। হিজড়েরা ভারতীয় সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত।
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট হিজড়েদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ওঁরা যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, তা ঠেকাতেই এই স্বীকৃতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে মৌলিক অধিকারগুলি হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষের প্রাপ্য অধিকার। সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৬, ১৯, ২১ নম্বর ধারায় হিজড়েদেরও অন্য ভারতীয় নাগরিকদের মতো সমানাধিকার প্রাপ্য। যদিও সেসব খাতায়-কলমেই থেকে গিয়েছে।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আদায় করতে পারেননি কোটি কোটি ভারতীয় নাগরিক, হিজড়েরা তো বটেই। তবে সমানাধিকারের আইন-কানুনগত সুযোগগুলি দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে কিছু ক্ষেত্রে আদায় করেছেন ওঁরা। যেমন, ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০১১ সাল থেকে জনগণনারও অন্তর্গত করা হয়েছে ভারতের হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষকে।
এছাড়া, ২০১৯ সালে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনের আর্থ-সামাজিক সুরক্ষার জন্যে আনা হয়েছে ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস প্রোটেকশন রাইটস অ্যাক্ট। এই আইন প্রণয়ন করে তৃতীয়লিঙ্গের মানুষজনকে বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আদতে কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।
তবে হিজড়েদের আর্থ-সামাজিক ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন গোটা ভারতজুড়েই অব্যাহত। এটাই আশার কথা বলা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে মহাত্মা গান্ধীর এক বক্তব্য। জাতির জনক বলেছিলেন, “প্রথমে ওরা তোমাকে অবজ্ঞা করবে, তারপর ওরা তোমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে, এরপর ওরা তোমার সঙ্গে লড়াই করবে, আর শেষে তুমিই জিতবে।”
অধিকারের লড়াইয়ে হিজড়েদের জয়ী বলা না গেলেও হিজড়ে সমাজ সমানাধিকার আদায়ে গত ৯০-এর দশক থেকে জোরদার লড়াই করছে। আশা করা যেতে পারে, একদিন জয়ের হাসি হাসবেন ওঁরাই।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণের পরে শিশু ক্রমশ টের পায় তাঁর শরীর আর পাঁচজনের মতো নয়। এ কথা অভিভাবকদের জানানোর পরে প্রায় সবক্ষেত্রেই তাদের ঘর ছাড়তে হয়। আশ্রয় জোটে সমাজের প্রান্তবাসী হিজড়েদের ডেরায়। হিজড়ে হিসেবে যাঁদের দেখা যায়, তাঁদের অধিকাংশই জন্মগতভাবে তৃতীয়লিঙ্গের মানুষ নন। যে সমীক্ষায় এই তথ্য জানা গিয়েছে সেটি অল ইন্ডিয়া হিজড়ে কল্যাণ সভার তরফেই করা হয়েছে।
ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মোটে এক শতাংশ হিজড়ে জন্মগতভাবে হিজড়ে হন। অধিকাংশকেই অপহরণ করে তারপর খোজা করে দিয়ে হিজড়ে বানানো হয়েছে। এও দেখা গিয়েছে, প্রতি এক লক্ষের মধ্যে মোটে একজন জন্মগতভাবে হিজড়ে। অপহরণের আগে ব্রাউন সুগার কিংবা হাসিস খাওয়ানো হয়েছে অনেককেই। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে দেশের রাজধানী দিল্লিতেই ৩০ হাজারের উপর হিজড়ের বসবাস। এছাড়া প্রতি বছর অন্তত এক হাজার মানুষকে খোজা করে দিয়ে রাজধানীতে হিজড়ে বানানো হচ্ছে। অল ইন্ডিয়া হিজড়ে কল্যাণ সভার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যাদেরকে অপহরণ করে হিজড়ে বানানো হচ্ছে তার মধ্যে বেশিরভাগই পুরুষ।
আরও পড়ুন- রূপান্তরকামীদের আরাধ্য মোরগবাহন বহুচরা দেবী, অচেনার তালিকায় এক রহস্যময় সংযোজন
হিজড়েদের নিয়ে কাজ করছে এমন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি জানিয়েছে, জোর করে হিজড়ে বানাতে সারা দেশজুড়ে জাল বিছিয়ে রেখেছে মাফিয়াচক্র। এদিকে মাফিয়াদের এই দৌরাত্ম্য সম্পর্কে মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে খবরাখবর তেমন প্রকাশিত হয় না। ফলে দেশের সাধারণ নাগরিকরা জানেন না প্রকৃত সত্য।
যে সমস্ত নাবালক এবং তরুণকে অপহরণের পরে খোজা করে দিয়ে হিজড়ে বানানো হচ্ছে তাঁরাও এই তথ্য চেপে রাখছেন প্রাণভয়েই। কারণ তথ্য ফাঁস হলে খুন করা হতে পারে ওঁদের। স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া এই তথ্য যে উদ্বেগজনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া যে সমস্ত মানুষকে হিজড়ে করে দেওয়া হচ্ছে এঁদের ভিতর একাংশ বিবাহিত তরুণ এবং সকলেরই পরিবার রয়েছে। হিজড়েতে রূপান্তরিত করার জন্য যে অস্ত্রোপচার করা হয় তাও অতি গোপনে করা হয।
ডাক্তারদের একাংশ এই বেআইনি অস্ত্রোপচারের সঙ্গে যুক্ত। অল ইন্ডিয়া হিজড়ে কল্যাণ সভা গঠিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। সংগঠনের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, যে ডাক্তাররা নাবালক অথবা প্রাপ্তবয়স্কদের খোজা করে দিচ্ছে প্রতি অস্ত্রোপচার পিছু ফি হিসেবে ওঁরা নেন ২,৫০০ টাকা থেকে ৩,০০০ হাজার টাকা। আর অস্ত্রোপচার করার আগে গুরুর নির্দেশ বাধ্যতামূলক।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিজড়েদের আস্তানাতেই থাকেন এই গুরু। গুরুই হিজড়ে সম্প্রদায়ের চালক। তবে অন্য হিজড়াদের তুলনায় গুরুর বয়স সবসময়েই বেশি। প্রাচীনকাল থেকেই হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষের কাজে লাগানো হয়েছে রাজারাজড়া কিংবা নবাবদের হারেম পাহারা দেওয়ার জন্য। জীবন ও যাপনের উন্নতির পথ সম্ভবত সেইকাল থেকেই খুঁজে চলেছেন এই নাগরিকরা।