হাই কোর্টের সঙ্গে সংঘাতে জয় মমতারই! 'দুয়ারে রেশন' যেভাবে ছিনিয়ে নিল রাজ্য
Duare Ration: যতদিন না এই মামলার চূড়ান্ত নির্দেশ আসছে, ততদিন সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ বহাল থাকবে।
"জোর করে কেউ দুয়ারে রেশন প্রকল্প বন্ধ করতে পারবেন না!'' ২৫ নভেম্বর, রাজ্যের বিধানসভায় দাঁড়িয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলে দিয়েছিলেন, "প্রয়োজনে বিধানসভার মাধ্যমেই আদালতে আবেদন করব, যাতে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে!'' সোমবারের ঘটনা পরম্পরা মমতার দুয়ারে কি রেশন জয়ের বার্তা দিচ্ছে?
অনেকে বলছেন, অবশেষে পারলেন তিনি পারলেন! জিতেই গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! তাঁর সাধের প্রকল্পের দুয়ারে এল আদালত-স্বস্তি! অবশেষে দেশের শীর্ষ আদালতের তরফে এল কলকাতা হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে জানিয়ে দেওয়া হলো, 'দুয়ারে রেশন' প্রকল্প নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ আপাতত লাগু হবে না, ওই নির্দেশে বন্ধ হচ্ছে না প্রকল্প। চলবে দুয়ারে দুয়ারে রেশন দেওয়ার মমতা-প্রকল্প। যতদিন না এই মামলার চূড়ান্ত নির্দেশ আসছে, ততদিন সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ বহাল থাকবে।
কী নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট?
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি চিত্তরঞ্জন দাশ এবং বিচারপতি অনিরুদ্ধ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয়, 'দুয়ারে রেশন' প্রকল্প বেআইনি। আদালত জানায়, আইনের চোখে এই প্রকল্পের কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। ২০১৩ সালের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের পরিপন্থী এই প্রকল্প।
আরও পড়ুন: কারাগারে ১০০ দিন! বাংলার রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ অনুব্রত
সেই রায়ের বিরুদ্ধেই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে রাজ্য সরকার। এই রায়ের বিপক্ষেই মূলত আবেদন করে সরকার।
কারা করেন এই মামলা?
অগাস্ট, ২০২১। 'দুয়ারে রেশন' প্রকল্প নিয়ে মমতা-সরকারের একাধিক নির্দেশ এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে না, এই অভিযোগ তুলে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা দায়ের করে রেশন ডিলারদের সংগঠন। তাঁদের দাবি ছিল, এই প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত সাহায্য ১০ হাজার টাকার বিষয় এবং দু'জন অতিরিক্ত কর্মী নেওয়ার অনুদান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। সেই বিষয়েই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় এই সংগঠন।
দাবি ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'দুয়ারে রেশন' প্রকল্প চালু করার সময় রেশন ডিলারদের মাসে এককালীন ১০ হাজার টাকা করে বিশেষ কমিশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কেননা 'দুয়ারে রেশন' প্রকল্প সফল করার জন্য অন্তত দুজন অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করতে হয়। সরকারের ওই টাকা থেকেই তাঁদের বেতন দেওয়ার কথা। তাহলে এখন কেন সেই টাকার অঙ্ক কমিয়ে অর্ধেক করা হল?
এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েও কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা এই মামলার খারিজ করেন। তারপর ফের আদালতের দ্বারস্থ হয় ওই সংগঠন। মামলা ওঠে ডিভিশন বেঞ্চে। ২৮ সেপ্টেম্বর এই মামলায় ঐতিহাসিক নির্দেশ দেয় আদালত।
২৮ নভেম্বর, ২০২২
ফের এই প্রকল্পের চলমানতা ফের নিশ্চিত করল দেশের শীর্ষ আদালত। রাজ্যের সরকারকে স্বস্তি দিয়ে ফের নজিরবিহীন পর্যবেক্ষণের কথা জানাল আদালত। যেখানে আপাতত জানানো হল, এই প্রকল্প ২০১৩ সালের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের পরিপন্থী বলে এখনই কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি শীর্ষ আদালত।
জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন, ২০১৩
তখন কেন্দ্রে মনমোহন সিংয়ের সরকার। মোদি ঝড় উঠেছে লোকসভা নির্বাচনের আগে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের তরফে জারি হল জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন। দেশের সব মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করতে ২০১৩ সালে এই আইন চালু হয়। এই বছরের ৫ জুলাই থেকে দেশের প্রায় ৮২ কোটি মানুষের জন্য চালু হল এই প্রকল্প। যাদের মধ্যে খাদ্যের অভাব রয়েছে, কোনও না কোনও ভাবে। গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৫০ শতাংশ, শহর অঞ্চলের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষের সুবিধার জন্য এই আইনের কথা ভাবা হয়। এই আইনের মাধ্যমে বলা হয়, 'কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দেয়, ২০১৩-র জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য। উপভোক্তা বিষয়ক খাদ্য ও গণবন্টন মন্ত্রকের খাদ্য ও গণবন্টন দপ্তর রাজ্যগুলিকে এই মর্মে একটি চিঠি পাঠিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ২০১৩-র জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের ৩৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন এবং প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনায় যাতে এই সমস্ত নাগরিক সুবিধা পেতে পারেন, দফতর এই মর্মে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলে।'' যে আইনের বলে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল, গম বা আটা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ২ টাকা কেজিদরের বিষয়টি থাকলেও করোনাকালে এই টাকার বিষয়টি উঠে যায়।
রাজ্যের ব্যবস্থা
করোনার সময় থেকেই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রেশনের ব্যবস্থা করে রাজ্য। কেন্দ্রের একাধিক ক্যাটাগরির কার্ডের সঙ্গেই রাজ্যের তরফেও পৃথক ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রকল্পটি মূলত কেন্দ্রের তরফেই চলে বলে দাবি করা হয়।
'দুয়ারে রেশন'
২০২১-এর ১৬ নভেম্বর এই প্রকল্প চালু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দরজার। যা ওই বছরের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময়েই ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, এই প্রকল্পের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কেন্দ্র না রাজ্য, কার এই প্রকল্প? এই নিয়েই তৈরি হয় বিতর্ক। বারবার মমতার সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয় বিজেপি-সহ রাজ্যের বাকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সরব হয় রাজ্যের রেশন ডিলারদের সংগঠনের একাংশও। সেই বিতর্কের আবহ গড়ায় আদালতেও। এবার সেই প্রেক্ষাপটেই দেশের শীর্ষ আদালতের এই পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মত, রাজনৈতিক মহলের একাংশের।
যদিও আজকের পর্যবেক্ষণ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় রাজ্যের বিজেপি নেতারা। গেরুয়া শিবিরের নেতারা বলছেন, "আমরা রেশন ডিলারদের দাবির পক্ষে, রেশন নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ হোক আগে, তারপর সরকার ভাবুক কে জিতলেন আর কে হারলেন!'' আর তৃণমূল নেতারা বলছেন, মমতার স্বপ্নের প্রকল্প। মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আজকের এই পর্যবেক্ষণ, তারই প্রমাণ দিল আবার।''