বন্যেরা কেবল বনেই সুন্দর? আইন এসে ভেঙে দিল মানুষ আর সারসের বন্ধুত্ব-ভরসা!

UP Man and Crane Friendship: সারস সাধারণত ছোট পোকামাকড় এবং শিকড়ের খেয়েই বেঁচে থাকে। অথচ আরিফ যা খেতেন, ডাল, ভাত আর রুটি… তাই-ই খেত সারসটি।

ভাষাহীনতার সম্পর্ক সবচেয়ে বাঙ্ময়! নির্ভরতার ভাষা, বিশ্বাসের ভাষা। সে ভাষা সকলের বোধগম্য নয় ঠিকই, তবে সম্পর্কে থাকা দুইজনের মধ্যেকার প্রাণভোমরা। মানুষ আর অন্য সমস্ত প্রাণীর সম্পর্ক এমনই নীরব অথচ এমনই প্রবল। তবে মানুষ সম্পর্ককে আইনে বাঁধে। আইনবিরুদ্ধ সম্পর্ক এখানে মান্যতা পায় না। সে ভালোবাসা যত নিবিড়ই হোক না কেন, আইনের কাছে সে নিয়মবিরুদ্ধ। যে কোনও মুহূর্তে আইন এসে সেই ভালোবাসাকে তছনছ করে দিতে পারে, ভাষাহীন ভরসাকে নিমেষে তলিয়ে দিতে পারে। যেমন ভাবে তলিয়ে গেল আহত সারস আর মহম্মদ আরিফের ভালোবাসার টান। মানুষ আর পাখির ভালোবাসার গান হারিয়ে গেল। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে, উত্তরপ্রদেশের আমেথি জেলার মান্ধকা গ্রামের বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী মহম্মদ আরিফ এক আহত সারস পাখি নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। তারপর তেরো মাস ধরে সারসের যত্ন নেন, ভালোবাসেন দু'জনে দু'জনকে। বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে আরিফের বিরুদ্ধে, আরিফ আর সারসের ভালোবাসার বিরুদ্ধে। বন্যপ্রাণী কর্তৃপক্ষ আরিফের বাড়ি থেকে সারসটিকে তুলে নিয়ে গিয়েছে রায়বরেলির অভয়ারণ্যে। মানুষ আর পাখির বন্ধুত্ব সেইখানেই সাঙ্গ। আরিফের আশ্রয় ছেড়ে কানপুর চিড়িয়াখানায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে সারসটিকে। যে বন্যপ্রাণ ঘরোয়া আরামে অভ্যস্ত, এই চিড়িয়াখানায় সে কীভাবে মানিয়ে নেবে?

সারস সাধারণত জলাভূমিতে পাওয়া যায়। উত্তরপ্রদেশের রাজ্য পাখি হচ্ছে সারস এবং ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনের ৩ নম্বর সূচির অধীনে এই পাখি সুরক্ষিত। বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা উড়ন্ত পাখি সারস প্রায় ১৫০ সেন্টিমিটার লম্বা। আরিফ একদিন মাঠের মধ্যে পা ভাঙা এই পুরুষ সারসটিকে খুঁজে পান। বাড়িতে নিয়ে এসে যত্নআত্তি শুরু করেন। সারসের ক্ষতস্থানে হলুদ এবং সরষের তেলের মিশ্রণ লাগিয়ে দেন। ভাঙা পা সোজা রাখার জন্য পায়ে একটি লাঠি বেঁধে দেন। আসলে নতুন কিছু না। পেশায় আরিফ একজন কৃষক। বাড়ির পোষ্য মুরগির জন্যও তাই করেন তিনি। বাড়িতে প্রায় এক ডজন মুরগি, একটি কুকুর, গরু এবং ছাগলও রয়েছে আরিফের৷

আরও পড়ুন- মানুষ কম, বিড়াল বেশি! রাস্তা, বাড়ি, অফিস সর্বত্রই এক ছবি, কোথায় রয়েছে এমন আজব দেশ?

আরিফ কি সারসটিকে আটকে রেখেছিলেন, বনের পাখিকে ঘরে জোর করে ধরে রেখেছিলেন? সপ্তাহ খানেক যেতেই পাখিটি সুস্থ হতে শুরু করে। তারপরে সে উড়তেও শুরু করে। কিন্তু বাড়ির বাইরে উঠোনে সে রয়েই গেল। আর কখনই নিজের জঙ্গলে ফিরে গেল না। আরিফ যখন মোটরসাইকেলে করে গ্রামে যেতেন সারসটি তাকে অনুসরণ করে পিছনে পিছনে যেত। সেই সময়টুকু জঙ্গলে নিজের ইচ্ছামতো থাকত। তারপর সন্ধ্যাবেলা আবার আরিফের সঙ্গেই বাড়িতে ফিরে এসে তাঁর সঙ্গেই খেত। আরিফ ভালোবাসায় বেঁধেছিলেন সারসটিকে, এই বন্ধন গ্রন্থিহীন, অথচ দৃঢ়। সারস সাধারণত ছোট পোকামাকড় এবং শিকড়ের খেয়েই বেঁচে থাকে। অথচ আরিফ যা খেতেন, ডাল, ভাত আর রুটি… তাই-ই খেত এই সারসটি।

আরিফের বিরুদ্ধে ৯ মার্চ বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনে মামলা করা হয়। ২ এপ্রিল সকালবেলা তার বক্তব্য রেকর্ড করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে, সহকারী বন সংরক্ষক এবং সাব ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার (গৌরীগঞ্জ) রণবীর মিশ্র জানিয়েছেন, কখন, কীভাবে তিনি সারসটিকে পেয়েছেন সেই সব তথ্য জানতে তাঁর বয়ান রেকর্ড করা হবে। তাঁর বক্তব্য বিশ্লেষণ করার পরেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

১৩ মাস পরে কী এমন ঘটল আরিফের সঙ্গে যাতে আইন এসে বাধা দিল এই সম্পর্কে? আরিফের বোন নাজমা জানাচ্ছেন, কেউ একজন অনলাইনে একটি ভিডিও আপলোড করে দেয় এবং তারপর থেকেই বাড়িতে বাইরের লোকজন আসা শুরু হয় আরিফের। সাংবাদিক, স্থানীয় লোকজন এবং অন্যান্য মানুষ দেখতে আসেন বনে থাকা পাখি কীভাবে মানুষের পরিবারে বসবাস করছে। রাতারাতি মানুষ আর পাখির এই জুটি স্থানীয় সেলিব্রিটি হয়ে ওঠে। একসঙ্গে দুই ‘বন্ধু’র ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। গত ৫ মার্চ, এক হাই-প্রোফাইল দর্শক সারস দেখতে আসেন। তিনি উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব। তিনি পাখি, আরিফ এবং নিজের ছবি ট্যুইট করেন।

পরে সেই ছবি অবশ্য সরিয়ে দেওয়া হয়। অখিলেশ আরিফকে লখনউতে সমাজবাদী পার্টির সদর দফতরে আমন্ত্রণ জানান এবং পাখিটিকে 'বন্দি' করার জন্য বিজেপিকে নিন্দা জানিয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলনও করেন। কর্মকর্তারা বলছেন, অখিলেশের সফরের সঙ্গে এই পদক্ষেপের কোনও সম্পর্ক নেই। আমেথি এই পাখির বিষয়ে যা হয়েছে তা নিয়ম-কানুন মেনেই হয়েছে।

রায়বেরেলির সমাসপুর পাখি অভয়ারণ্যে রেখে দেওয়া হয়েছিল সারসটিকে। কিন্তু এই ঘেরাটোপ ছেড়ে সে পালায়। গত ২২ মার্চ, দিলীপ কুমার নামে এক ব্যক্তি এই বিশাল অভয়ারণ্য থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে সারসটিকে খুঁজে পান। পাখিটিকে তখন ঘিরে রয়েছে অজস্র কুকুর। কুকুরদেরকে তাড়িয়ে পাখিটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি। বনকর্মীদের জানানো হলে, অভয়ারণ্য থেকে কিছুজন এসে পাখিটিকে একটি ই-রিকশায় নিয়ে চলে যায়। চলে যাওয়ার আগে দিলীপদের সঙ্গেই খাওয়া দাওয়া করে সারসটি।

আরও পড়ুন- কীভাবে গৃহপালিত গাধা বদলে দিয়েছিল সভ্যতার ইতিহাস, বিবর্তনের এই কাহিনি আজও অজানা

সারসের এই নিখোঁজ হওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পাখিটিকে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রাখা ভালো। রায়বেরেলি থেকে কানপুর, প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। উত্তরপ্রদেশে প্রায় ১৫,০০০ সারস রয়েছে, যার বেশিরভাগেরই বাস ইটাওয়া, মাইনপুরি এবং কনৌজ জেলায়।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের কাছাকাছি থাকার পরে সারসের অভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। মানুষঘেঁষা এই পাখির এখন জঙ্গলের মধ্যে বেঁচে থাকা কঠিন। তাই এটিকে চিড়িয়াখানায় রাখা হলেই সবচেয়ে ভালো হবে বলে মনে করছেন বনকর্মীরা।

সত্যিই ভালো থাকবে সে? আরিফ বিশ্বাস করেন না। "মুঝে লগতা হ্যায় উসকো আজাদ রাখনা চাহিয়ে," মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন পাখির এই বন্ধু। কানপুর চিড়িয়াখানায় দেখতে যাবেন তিনি সারসটিকে? যদি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন, আরিফ যাবেন, “মুঝে পাতা হ্যায়, মেরা বাচ্চা মুঝে পেহচান লেগা।" কীভাবে চিনে নেবে? ভালোবাসার ঘ্রাণে, বিশ্বাসের পদধ্বনিতে, যে ভাষা কেউ বোঝেনি সেই ভাষাই মিলিয়ে দেবে আরিফ আর এই সারসকে।

More Articles