যৌন হেনস্থার ভিডিও কেড়েছে ঘুম! মেয়েদের এখনও স্কুলে পাঠাতে ভয় পান মণিপুরের বাবা-মায়েরা
Manipur Education after Violence: যে স্কুলে একসময় ৩০০ জন পড়ত, মণিপুরের সেই স্কুলে এখন ৫০ জন আসে মেরেকেটে! বাকিরা?
মণিপুর কেমন আছে আমরা কেউ জানি না। মণিপুরে ঠিক এক বছর আগে কী কী হচ্ছিল, তা আমরা ভুলতে বসেছি কারণ আমাদের বিনোদনের জন্য ভোট-সিনেমা-বিয়ে-রিলস নানাবিধ বিষয় আঙুলের ডগায় হাজির। আমরা ভুলে গেছি, মণিপুরের হিংসায় এখনও পর্যন্ত ২০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। অনেকেই নিখোঁজ। ক্যাম্প করে রয়েছেন মানুষ। বাড়ি তাঁদের পুড়ে গেছে। স্বপ্ন তাঁরা দেখেন না। শিশুরা জানে না বইয়ের পাতার গন্ধ ফিরবে কিনা জীবনে। জানে না সহজ স্বাভাবিক স্কুলজীবন তারা পাবে কিনা। যুব সম্প্রদায় জানে না চাকরি হবে কিনা। আমরা জানি না মণিপুর কেমন আছে। মণিপুর আমাদেরই দেশের রাজ্য, সেখানে আগুন জ্বলেছিল, মানুষ একে অন্যকে ধাওয়া করে ছুটেছিল, মেয়েদের নগ্ন করে হাঁটানো হয়েছিল। মণিপুরের মানুষ আমাদেরই সহনাগরিক।
মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ রয়েইছে একে অন্যের প্রতি। তা সীমা ছাড়ায় গতবছরের মে মাসে। এক বছর অতিক্রান্ত। মেইতেই এবং কুকি ও নাগাদের মধ্যে হিংসা কমেছে, থামেনি। খবরে সেসব টুকরো মণিপুর আর জায়গা পায় না বলে মণিপুরের অশান্তি আমাদের মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তবে মণিপুরে শান্তি ফেরেনি। আর এই অশান্ত রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে মহিলা এবং শিশুরাই, যেমনটা চিরকাল থাকে।
গত অগাস্ট মাসেই, কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী রাজ্যসভায় একটি লিখিত বিবৃতিতে বলেছিলেন, মণিপুরের হিংসার ফলে ১৪,৭৬৩ জন স্কুলপড়ুয়া শিশু বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মণিপুর সরকারের তথ্য বলছে, মণিপুরের ৩৫১ টি ত্রাণ শিবিরে ২২,০০০-এরও বেশি শিশু বাস করছে। তাদের মধ্যে, ৭৬ জন অনাথ। বাস্তবের তথ্য বলছে, সংখ্যা ঢের বেশি। কুকি সম্প্রদায়ের বেশ বড় সংখ্যক পড়ুয়ারা স্কুলে যেতেই পারছে না কারণ যে স্কুলগুলিতে তাদের পড়ার কথা ছিল, বর্তমানে সেগুলির অধিকাংশই ত্রাণ শিবির হয়ে গেছে। বেসরকারি স্কুলগুলি টিউশন ফি অর্ধেক করে দিয়েছে ঠিকই, তবে মণিপুরের মানুষ গত এক বছরে অর্থনৈতিকভাবে যে সংকটে আছে তাতে সেই অর্ধেক ফি দেওয়ার সঙ্গতিও তাঁদের নেই। একটা ছোট্ট রাজ্যে বহু বহু প্রজন্মের জীবন, স্বপ্ন, ইচ্ছা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভোট চলছে দেশে। মণিপুরে মাত্র দু'খানা লোকসভা আসন। মণিপুরের জন্য ১০০ শব্দও বরাদ্দ না থাকাই স্বাভাবিক, এমনটাই দস্তুর।
আরও পড়ুন- মণিপুর অসুস্থ, রোগের খোঁজ রাখে না ভারতবর্ষ
কলেজের পড়ুয়ারা সত্যিই জানে না, যে স্বপ্ন তারা দেখে এসেছে জীবন নিয়ে তা আর কোনও দিনও এই পাঁক থেকে বেরিয়ে মুক্ত আকাশ দেখবে কিনা। স্কুলের শিশুরা জানেই না সহপাঠীদের সঙ্গে এক বেঞ্চে বসা হবে কিনা কোনওদিন আর। গত বছরের মে মাসে মণিপুরে হিংসা শুরু হওয়ার পর থেকেই মেইতেই এবং কুকি দুই সম্প্রদায়ের ২৩ জন পড়ুয়ার একটি দল ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি-কাম-এন্ট্রান্স পরীক্ষা (আন্ডারগ্র্যাজুয়েট), জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা সহ অন্যান্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ত্রিপুরায় এসে থাকা শুরু করে। তাদের মধ্যে ১০ জন মেইতেই, ১০ জন মিজো এবং কুকি সম্প্রদায়ের, একজন অসমের ছাত্র এবং দুইজন ত্রিপুরার। প্রায় এক বছর পর তারা বাড়িতে ফিরছে। এই এক বছর একইসঙ্গে থেকে পড়াশোনা করেছে মেইতেই ও কুকি পড়ুয়ারা। মণিপুর জ্বলেছে এই দুই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ইস্যুতে। মণিপুরের ইম্ফলের রনিতা থাউনাওজাম মেইতেই। কুকি পড়ুয়ারা কি তবে তাঁর শত্রু ছিল? রনিতা বলছেন, একসঙ্গে যখন পড়তে বসেছেন, প্রস্তুতি নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কোনও জাত-পাত, ধর্ম, ভেদাভেদ টেরই পাননি তারা। রনিতারা বিশ্বাস করেন, সংকট একদিন ঠিকই কেটে যাবে। মানবতাই একমাত্র অমর।
রনিতাদের ভাবানো হয় 'শত্রু' আসলে কারা। বিভেদে রাষ্ট্রের চিরকালীন লাভ। গাঞ্চুইনা গ্যাংমেই কুকি সম্প্রদায়ের। রনিতাদের সঙ্গে থাকাকালীন কোনও হিংসা, বিভেদ, ক্ষোভ বিন্দুমাত্র উঁকি দেয়নি মনে। মণিপুরের এই পড়ুয়ারা পরিবারের মতো বেঁচেছেন। তবে এই সুযোগ সকলে তো পাননি। অধিকাংশই দেখেছেন প্রদীপের তলার অন্ধকারটুকুই। জোনাকিহীন সে আঁধার। যে আঁধারে মণিপুরের ছাত্রসমাজ তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
সতেরো বছর বয়স মারভিন মঙ্গলেনথাংয়ের। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। অন্তত ২০২৩ সালের ৩ মে-র আগে অবধি সে এমনটাই চাইত। এখন হাতে অস্ত্র, মানুষ মারার প্রশিক্ষণ পাচ্ছে মারভিন। গত বছরের ৩ মে মণিপুরে যখন প্রথম হিংসা শুরু হয়, তখন নিহতদের মধ্যে ছিলেন মারভিন মঙ্গলেনথাংয়ের বাবাও। মাঙ্গলেনথাং আর পড়াশোনা করে না। জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এখন বদলা। পরিবারের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বদলা, মণিপুরের সঙ্গে হওয়া বঞ্চনার বদলা।
কাংপোকপি জেলার নয় বছরের শিশু লালবোই। ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিল। গত এক বছরে সামান্য অঙ্ক কষতে গিয়ে চোখে জল আসে তাঁর। দিনের বেশিরভাগটাই কেটে যায় মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে। লালবোইয়ের পরিবার যখন কাংপোকপি থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল, সেই হিংসার মধ্যে পড়ে চোখের সামনে মারা যায় এই শিশুর মা। লালবোই বেঁচে আছে গত এক বছর মায়ের কোল ছাড়া, মায়ের ভরসা ছাড়া। মায়ের সঙ্গেই তাঁর যত ভালোবাসা, খুনসুটি। বাবা তো মদ্যপ। বাড়ি ঘর যখন উত্তাল, মা যখন মরে যাচ্ছে বাবা ছিলও না গ্রামে। কিছুতেই মন বসে না আর লালবোইয়ের, সে শুধু বোঝে মা ফিরবে না আর। জীবনও কি স্বাভাবিক হবে আর? কখনও?
কাংপোকপি জেলায় হিংসা শুরু হওয়ার আগে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল মিলে পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল ৫৫,৯৫০। পরিস্থিতি সামান্য স্বাভাবিক হওয়ার পরে সেই শিশুদের কতজন স্কুলে ফিরেছে তার তথ্য নেই। কাংপোকপি জুড়ে ত্রাণ শিবিরে ৩,৫৩২ জন পড়ুয়া আছে। যাদের মধ্যে ৩,৩৫১ জন জেলার স্কুলগুলিতে ভর্তি হয়েছে। কাংপোকপির ৪২১টি সরকারি স্কুলের মধ্যে মাত্র ৩৬৬টি চালু আছে।
স্কুল নেই, ত্রাণ শিবিরের অনিশ্চিত অনিরাপদ জীবনের ফাঁকতালে কখন যে শিশুদের জীবনে ঢুকে পড়ছে মাদকের হাতছানিও। মণিপুর জুড়ে প্রায় ১০৫ টি মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র কাজ করছে। সাম্প্রতিককালে সেখানে মাদকাসক্তদের গড় বয়স উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। আগে সাধারণত ২০-২১ বয়সের ছেলেরাই মাদকমুক্তি কেন্দ্রে যেত। এখন ১৪-১৫ বছরের ছেলেদের ভিড় বাড়ছে। অশান্ত পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সহজ পন্থা হিসেবে ছোট শিশুরাও মাদকে মুক্তি খুঁজছে।
যে স্কুলে একসময় ৩০০ জন পড়ত, মণিপুরের সেই স্কুলে এখন ৫০ জন আসে মেরেকেটে! বাকিরা? কেউ রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছে, কেউ ভিটেমাটিহারা, কেউ বা গ্রামের স্বেচ্ছাসেবক হয়েছে। স্কুলের বই তাঁদের পুড়ে গিয়েছে গতবছরের হিংসায়। এখন বিভিন্ন এনজিও যা বইপত্র দেয়, তার উপর নির্ভর করেই পড়াশোনা করে কেউ কেউ। স্কুলের পোশাক নেই, জুতো নেই। কেনার সামর্থও আর নেই।
আরও পড়ুন- মণিপুরের বুকে এখনও জমাট চাপ চাপ অন্ধকার
জেসিকা চানুর বয়স ১২। ইম্ফলের একটি ত্রাণ শিবিরেই পড়ছে সে। কিন্তু বেশিদিন যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে সে, এমন বিশ্বাস রাখে না। এখন যে ভাষাতে শিক্ষকরা পড়ান, সে বোঝে না, আগে অন্য এক ভাষায় পড়াশোনা করত সে। তার উপর মাঝে সাঝেই হিংসার ভয়ে, কারফিউয়ের জন্য স্কুল বন্ধ থাকে৷ ইম্ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইরাই কিন্তু পরিস্থিতি একই রকম সেখানেও। ১২ বছররের জেসিকা চানু এখনও প্রিয় বন্ধুর অপেক্ষা। জেসিকার পাড়াতেই সে থাকত। জেসিকা বহুবার বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতেও চেয়েছে। করতে চেয়ে বকাও খেয়েছে ত্রাণ শিবিরে। কেন তাকে বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে বকা দেওয়া হচ্ছে প্রথমে বোঝেনি সে। পরে জেসিকাকে তাঁর গ্রাম মোরেতে তাঁদের বাড়িতে আগুন দেওয়া এবং লোকজনকে মেরে ফেলার ভিডিও দেখানো হয়। বলা হয়, প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আর কখনই যোগাযোগ না করতে কারণ জেসিকা চানু মেইতেই, আর তার প্রিয় বন্ধু কুকি। বন্ধু এখন শ্রেণিশত্রু! ১২ বছরের বাচ্চার বন্ধু, শ্রেণিশত্রু।
সতেরো বছরের কিমহোইলহিং যে গ্রামে থাকে, সেই গ্রামের দুই মহিলাকে প্রকাশ্যে নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানো হয়েছিল। সেই ঘটনা দেখার পর থেকে স্কুলে যেতে পারে না কিমহোইলিং। মৃত্যুর ভয় নয়, হিংসার ভয় নয়। যৌন নির্যাতনের ভয় তাঁকে শেষ করে দিয়েছে ভেতরে ভেতরে। শেষ হয়ে গিয়েছে তাঁর বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। কিমহোইলিং কিছুতেই ভুলতে পারছে না, কোনও বহিরাগত শত্রু নয়, ওই মহিলাদের হেনস্থা করেছে তাঁদের নিজেদের লোকই। যৌন নির্যাতনের এমন বিভিন্ন ঘটনা সারা মণিপুর জুড়ে মেয়েদের মধ্যে আতঙ্কের বিষাক্ত বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে। বাবা-মা তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। যৌনলাঞ্ছনার চেয়ে অশিক্ষাও ভালো!
ঘর বা ত্রাণ শিবির থেকে স্কুলে পৌঁছনোর পথে প্রতিদিন অস্ত্রধারী মানুষদের আনাগোনা চোখে পড়ে। অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে এই ব্যক্তিরা কমান্ডো, জঙ্গি, নাকি সাধারণ লোক, তাও জানেন না বাসিন্দারা। তারা শুধু ভয় পান, মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে, হাসতে, স্বপ্ন দেখতে ভয় পান। আর বাকি ভারতবর্ষ? ভোট, বয়কট, গণতন্ত্রের নিকুচি, ভাইরাল রিলস, আম্বানি পুত্রের বিয়ে, রচনা ব্যানার্জির হাসিতে ভেসে চলে গিয়েছে বহু বহু দূর। সেখানে মণিপুরের আগুন পোড়া গন্ধ আসে না, সেখানে নগ্ন হাঁটানোর ভিডিও ট্রেন্ডিং নয় আর, সেখানে মণিপুরকে কেউ মনেও রাখে না। ভারতবর্ষের মানচিত্রে দগদগে ঘা হয়ে থাকে একটি রাজ্য। যে রাজ্যের প্রজন্ম কেন বন্দুক তুলে নিচ্ছে বলে ভবিষ্যতে তরজা হবে ঘণ্টাখানেক, কেন ছোট শিশুরা স্কুলে যায় না বলে গ্লিসারিন গড়িয়ে পড়বে পার্লার চর্চিত গালে। মণিপুরের জন্য এতটাই। যত অশান্তি, তত ভয়, তত কম শিক্ষা, তত আনুগত্য, তত দখল, এই সমীকরণে আমরা রাষ্ট্রকে বারবার জেতাতে ভালোইবাসি।