উন্নয়নের নামে যেভাবে বিপর্যয় ডেকে আনা হলো উত্তরবঙ্গে
North Bengal: দার্জিলিং পাহাড়ের নিজস্ব বনে ছিল ওক, বার্চ, ম্যাপল, ম্যাগনোলিয়া, রডোডেনড্রন, চেস্টনাটের মতো গাছ। ১৮৩০-৪০ সাল নাগাদ সেসব কেটে ইংরেজরা পাহাড় জুড়ে লাগাল পাইন। ফলে পাহাড়ে ধস বাড়ে। পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্র সংকটে পড়ে...
এখনও ভাবলে মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা! ২০২৩ সাল। রাজকুমারদা, নকশালবাড়ির রাজকুমার রিজাল, বেশ কয়েকদিন ধরেই হোয়াটস্যাপে নানা ভিডিও পাঠাচ্ছিল। ক্রমাগত বৃষ্টিতে তিস্তায় জল বাড়ছে। একের পর এক গ্রামের জমি খেয়ে নিচ্ছে তিস্তা, তারই ভিডিও। আমরা ঠিক করেছিলাম, তিস্তাপাড়ের ভাঙন নিয়ে একটা ছোটোখাটো ছবি বানাব। রাজকুমারদা রঙিন মানুষ, কর্মোদ্যোগী। বনাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলনের লোক, নানা জায়গায় দৌড়তেও পারে। তাঁকেই বলা হলো যদি ভিডিও করে পাঠায়। মোবাইলে তোলা সেইসব ভিডিওয় রাজকুমারদার হাত কেঁপেছে, ফ্রেমের বালাই নেই। কিন্তু কোনো ভিডিওই ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। চোখের সামনে দেখছি একটা আস্ত মাঠ জলের তলায় চলে গেল। লোকজন আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠছেন। সে খুবই অস্বস্তিকর সব দৃশ্য।
দেখতে-দেখতে ঠিক করলাম, হাতের কাজকম্ম সামলে পুজোর পরে যদি একবার সরেজমিনে দেখে আসা যায় সবটা। কিন্তু, তার আগেই বিষয়টা এক্কেবারে অন্য দিকে বাঁক নিয়ে নিল। এমনই এক অক্টোবর, এবং মাসের একদম গোড়াতেই সিকিমের দক্ষিণ লোনাক হৃদের বাঁধ ভেঙে তিস্তায় হড়পা বান এল। বিজ্ঞানের ভাষায় ‘গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ (GLOF)। খবরে দেখছি, বিধ্বংসী তিস্তা চোখের পলকে চুংথাং-এর ১,২০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ড্যাম গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কতজন যে তলিয়ে গেছেন হিসেব নেই। সিকিমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে বয়ে আসা তিস্তাও তখন ভয়াল। নদীর জলে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র ভেসে আসছে। সামরিক ক্যাম্প তলিয়ে গেছে। শুনতে পাচ্ছি, পনেরোটার বেশি সেতু নাকি ভেঙে পড়েছে। বিপর্যয়ের কোনো আগাম আভাস না থাকায় লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। আসল সংখ্যাটা কেউ জানে না। কারো কারো সর্বস্ব গেছে। শুনছি, আরেকটু হলেই নদীর গতিপথও নাকি বদলে যেতে পারত। তাহলে কী হত, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রীতিমতো। সেই ঘটনার ক্ষত শুকোতে সময় লেগেছিল দীর্ঘদিন। ডিসেম্বর বা তারও পরে, মার্চে যখন তিস্তাবাজার যাচ্ছি, তখনও তিস্তার দু’পাশে ধ্বংসের চিহ্ন। কালিঝোরার সামান্য আগে দোকানের দেওয়ালে পলির দাগ। জল অতখানি উঠেছিল। লেপচা ভাষায়, এর একটা তর্জমা হয়, ‘রঙ্গারুন’। ‘জল ওই অবধি উঠেছিল’। সে অবশ্য লেপচা উপকথার গল্প। আজ, এই লেখায়, উপকথা টেনে আনা খুব শালীন বা শোভন হবে না সম্ভবত।
কেন জানি না সেদিন মনে হয়েছিল, ওই ঘটনা থেকে আমাদের রাষ্ট্র, প্রশাসন, স্থানীয় মানুষ, ঠিকাদার, সাধারণ মানুষ খানিক শিক্ষা নেবে। এত বড় একটা বিপর্যয়! এর কারণ খোঁজার ও সেইমতো পদক্ষেপ নেওয়ার একটা চেষ্টা নিশ্চয়ই শুরু হবে। ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। দ্রুত বুঝতে পারলাম, উন্নয়ন, মুনাফা আর ভোগের ভাগশেষে এমন অনেক বিপর্যয়ই ঐকিক নিয়মের মতো জমতে থাকে। ভাঙা বাঁধ, ভাঙা সেতু, ভাঙা রাস্তা, ভাঙা বাড়ি, ভাঙা দোকানপাট, তলিয়ে যাওয়া মানুষের ভাঙা সংসার। এসবের ওপর ক্ষতিপূরণ আর মেরামতির তাপ্পি পড়ে। ঝড়ের বেগে সব ‘সারানো’ শুরু হয়। ক্ষতস্থান যত দ্রুত ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে ফেলা যায়। তারপর, রাস্তার একধারে পড়ে থাকা ধ্বংসের ‘ভিউপয়েন্ট’-কে পাশ কাটিয়ে ফের গাড়ি ছোটে কালিম্পং, রংপো, গ্যাংটক, পেলিং কিংবা পেশক রোড হয়ে তাকদা-তিনচুলে-লামাহাটা-দার্জিলিং। খবরে বলা হয়, জনজীবন ‘ছন্দে ফিরছে’। ছন্দে ফিরতেও হয় বৈকি! নাহলে বাঁচাই তো যাবে না। কিন্তু স্মৃতি? যা হলো, যা গেল— তার কিছুই কি অবশেষ রাখল না চৈতন্যে? দেওয়ালে ওই পলির দাগের মতো? তিস্তাবাজারের এক স্থানীয় মানুষ বলছিলেন, ‘সরকার রাস্তা-টাস্তা সারিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকেই এখনও ক্ষতিপূরণ পাইনি। যদিও হোটেলগুলো খুলে গেছে। ট্যুরিস্টও আসছে। আপাতত এভাবেই চলবে। যা আসছে লুফে নাও। আর কী!’
আরও পড়ুন- ১৯৬৮ থেকে ২০২৫: যেভাবে বারবার বন্যায় লণ্ডভণ্ড উত্তরবঙ্গ
ধ্বংসস্তূপকে নতুন করে সারিয়ে তোলারও নিশ্চয়ই লোভনীয় বিনিময়সাপেক্ষ অর্থনীতি আছে। সেখানেও হয়তো রাস্তা সারাই বা সেতু সারাইয়ের টেন্ডার ডাকা হয়। এবং সে নিশ্চিতভাবেই কয়েকশো কোটি টাকার কারবার। এতে অনেকেই ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। জিডিপিও বাড়ে নিশ্চিত। দেশের ‘বৃদ্ধি’ চকচক করে। বালাই ষাট!
তিস্তাও একইসঙ্গে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে বারবার। গতবছরও সিকিমের বলুয়াটার, সিংথামের কাছে ধস নেমে ৫১০ মেগাওয়াট তিস্তা স্টেজ ৫ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাঠামো গুঁড়িয়ে গেছে। অসংখ্য গ্রামের জমি বা আস্ত গ্রাম তলিয়ে গেছে নদীর পেটে। বনভূমি গেছে। তরাই-ডুয়ার্স জুড়ে যে-হাতির পাল ঘুরে বেড়ায়, তারা সবাই একজোট হয়ে সেভকের ভাঁটিতে লালটং গ্রামের কাছাকাছি তিস্তা পেরিয়ে মহানন্দা জঙ্গলে ঢুকে পড়ত। সেই লালটং গ্রামটাও শুনেছি তিস্তার পেটে চলে গেছে গতবছর। গ্রামবাসীদের পুনর্বাসন হয়েছে শহরের কাছে একটা বস্তিতে। এবং এত ক্ষয়-ক্ষতির উল্টোপিঠে নির্মাণও বজায় থেকেছে। দগদগে ক্ষতমুখে মেক-আপ সাঁটানো চকচকে উন্নয়ন। নিসর্গ, প্রকৃতি, ভারসাম্যের মতো শব্দগুলো যেন অবান্তর। বিপর্যয়ের আসল কারণ নিয়ে আলোচনা নেই, পদক্ষেপ নেই। কেবল বিপর্যয়ের স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়া মসৃণ আর নিরবচ্ছিন্ন মুনাফার গল্পগুলো ঠেসে আছে চারপাশে। পুঁজির অবাধ উন্মেষের দৃশ্যাবলি।
স্মৃতি নানাভাবে মোছা যায়। নানাবিধ স্মৃতি। দুর্যোগের স্মৃতি। তার মূলে থাকা কারণের স্মৃতি। সেই কারণের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ইতিহাসের স্মৃতি। আমরা উত্তর খুঁজতে ভুলে যাই। বিপর্যয়ের পর সমাজমাধ্যমে কিলবিল করতে থাকা নানা উদ্বায়ী তত্ত্বে বুঁদ হয়ে পড়ি। তাৎক্ষণিক রাগ-ক্ষোভ-হতাশা-অসহায়তা তাৎক্ষণিক ভিলেন ও তার নিকেশ খুঁজে বের করে। উত্তরবঙ্গের এই সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের মধ্যে এখন যেমনটা ঘটছে। কেউ দুষছেন নির্বিচার পর্যটনকে, কেউ বলছেন নেপাল আর ভুটানের দোষ। অথচ, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ছিল না কি! দু’বছর আগের সেই ধ্বংসের স্মৃতি কারো মনে কি উজিয়ে আসছে না? মনে পড়ছে না, প্রকৃতি ভয়ঙ্কর সব ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত? দীর্ঘদিন ধরেই। আজ যা ঘটেছে, তা যে-কোনোদিন ঘটতে পারত। যে-কোনোদিন ফের ঘটবে। ঘটবেই।
বারংবার অতিবৃষ্টি বা তার পিছনে থাকা জলবায়ু পরিবর্তন একটা বড়ো ব্যাপার। তা একদিনে ঘটে না। স্থানীয় কারণেও ঘটে না। অকাতরে গাছ কেটে হোটেল বা স্থানীয় ঝোরার মুখ বন্ধ করে কংক্রিটের নির্মাণের জন্য কয়েকশো কিলোমিটার জুড়ে দুশো-তিনশো মিলিমিটার বৃষ্টি হয় না। এমনকি গোটাটা আমাদের দেশের ব্যাপারও না। আবার সবটাই কোনো না কোনোভাবে একসুতোয় বাঁধা। একটা আবহমান সুতো, তাতে টান লাগলে নানাদিকে ঢাল-উপুড় হয়। এই বছরে কখনও উত্তরাখণ্ডে, কখনও হিমাচলে বা পঞ্জাবেও এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে। শয়ে-শয়ে মানুষ মারা গেছেন। বন্যপ্রাণ তলিয়ে গেছে। এহেন সব দুর্যোগের পটভূমিকাও একদিনে তৈরি হয়নি। তার পিছনে দীর্ঘ প্রকৃতি-ধ্বংসের ইতিহাস আছে। উত্তরবঙ্গের নিসর্গ-ধ্বংসের ইতিহাসটাও যেমন আজকের নয়। ইংরেজরা তরাই-মোরাং আর পাহাড়ের নিসর্গটাকে আগাপাশতলা বদলে নিয়েছিল। সেই ১৮৩০-৪০ সাল নাগাদ উত্তরবঙ্গের নিজস্ব বনভূমি সাফ করে গাছ কাটা শুরু হলো। দার্জিলিং পাহাড়ের নিজস্ব বনে ছিল ওক, বার্চ, ম্যাপল, ম্যাগনোলিয়া, রডোডেনড্রন, চেস্টনাটের মতো গাছ। সেসব কেটে ইংরেজরা পাহাড় জুড়ে লাগাল পাইন বা ধুপি। ক্রিপ্টোমারিয়া জাপানিকা। একটা বানানো নিসর্গ তৈরি হলো পাহাড় জুড়ে। পাইনগাছের শিকড় পাহাড়ের ভঙ্গুর মাটিকে আরো দুর্বল করে দেয়, মাটির নিচের জলস্তর খেয়ে নেয় দ্রুত। ফলে পাহাড়ে ধস বাড়ে। সারাবছর জল থাকা ছোটো-ছোটো নালা ও নদীগুলো শুকিয়ে আসে ক্রমশ। পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্র সংকটে পড়ে।
আরও পড়ুন- পাহাড় কেটে হোমস্টে নির্মাণ! কেন হলো উত্তরাখণ্ডের এই ভয়াবহ দুর্যোগ?
একদিকে জলের অভাব, অন্যদিকে অবিরত ধস— পাহাড় জুড়ে এই দুই বিপর্যয়ের মূলে ছিল ইংরেজদের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত। কমবেশি একইসঙ্গে তরাইয়ের সমতলের আদি বনভূমি নিকেশ করেও তৈরি হচ্ছিল নতুন বাগিচা-বন। সেখানেও খয়ের, শিমূলের মতো স্থানীয় প্রজাতির গাছ কেটে বসল সেগুন। সেও ক্ষতিকর গাছ, কিন্তু বাজারমূল্য অনেক। সঙ্গে পাহাড় ও তরাইয়ের বনভূমি, পশুচারণভূমি উড়িয়ে দিয়ে শুরু হলো মনোকালচার— চা-বাগিচা। উত্তরবঙ্গের প্রকৃত নিসর্গের শবদেহের ওপরে যে নতুন নিসর্গ তৈরি হলো, তার ভিতরেই ভবিষ্যতের আসন্ন সংকটটা বোনা হয়ে গেল।
স্বাধীনতার পরে সেই সংকটের ক্ষতি কমানো যেতে পারত। কিন্তু তার বদলে ঔপনিবেশিক প্রভুদের দেখানো পথেই নিসর্গ-নিধন বজায় থেকেছে আজ পর্যন্ত। ঔপনিবেশিক প্রভুদের উত্তরাধিকার মেনেই বন-পাহাড়-নদীকে দেখা হয়েছে মুনাফাভাণ্ডার হিসেবে। উলটে, সেই দেখা আরও অতিকায় হয়েছে। আরও বিকৃত ও নির্মম হয়েছে। ইতিউতি বেঁচেবর্তে থাকা দার্জিলিঙের আদি অরণ্যকে নিকেশ করেও ধুপি লাগানো হয়েছে যত্রতত্র। বাকিটা নির্বিচার উন্নয়নের গল্প। উন্নয়নের নামে অমিত দুর্নীতির গল্প। নির্বিকার ও আত্মঘাতী প্রকৃতি-নিধনের গল্প। একটা ভঙ্গুর পাহাড় জুড়ে অনন্ত প্রোমোটিং-এর গল্প। ট্যুরিজমের নামে নদী-নদীর খাত-বনভূমি গিলে নেওয়ার গল্প। ছোটো-বড়ো নালা-জলপ্রবাহ বুজিয়ে দেওয়ার গল্প। পাহাড়-বন কেটে বিরাট সব চওড়া রাস্তা বানানোর গল্প। পাহাড়ের বুকে গর্ত খুঁড়ে ব্রডগেজ রেললাইন বসানোর গল্প। হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা তৈরির গল্প। এমন গল্প, যাকে কোনোভাবেই টলানো যায় না। এমনকি, মামলা করলেও সে মামলা কিছুদিন পরে খারিজ হয়ে যায়। দেশের স্বার্থকে যে টলানো যাবে না কিছুতেই।
দেশের স্বার্থ বিষয়টা কেমন? সেবক থেকে রংপো পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিমি রেলপথ বসবে। টয়ট্রেন না, পুরোদস্তুর ব্রডগেজ লাইন। তাতে পর্যটন বাড়বে, ব্যবসা বাড়বে, চিনের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার মতো পরিবহনব্যবস্থা হবে। আর তার জন্য পাহাড়ের বুকে গর্ত করে ১৪টা টানেল হবে। প্রায় ৩৯ কিমি দীর্ঘ টানেল। সঙ্গে ২০-২২টা সেতু। সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে প্রায় ১০০ হেক্টর বনভূমি নিকেশ হবে, যার প্রায় ৮৭ শতাংশ বনভূমিই আমাদের রাজ্যের। এবং এই বিপুল কর্মকাণ্ডের জন্য প্রকৃতি-পরিবেশের বিশেষ তোয়াক্কা করা হবে না। এই অঞ্চল হাতিদের করিডর, অসংখ্য দুর্লভ প্রাকৃতিক সম্পদের আঁতুড়ঘর, নানা বন্যপ্রাণের আশ্রয়। তারা অবশ্য চিরকালই খরচের খাতায়। হিমালয়ের যে-অঞ্চলে এই কাজ চলবে, তা বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল, ধসপ্রবণ তো বটেই। পাহাড়ের দু-পাশ লোহার খাঁচায় আটকে কাজ চলছে। তাতেও ধস ঠেকানো যাচ্ছে না। অকাতরে গাছ কাটার ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অবশেষটুকুও টলে যাচ্ছে। এদিকে উন্নয়ন বন্ধ করা যাবে না। তা নিয়ে মামলাও তাই খারিজ হয়ে যাবে। কারণ, এই প্রকল্পের সঙ্গে দেশের স্বার্থ জড়িয়ে। পাহাড়-প্রকৃতি এখানে একটা জীবন্ত বাস্তুতন্ত্র নয়, তা মুনাফার মৃগয়াভূমি। যে বহুমাত্রিক মুনাফা ‘দেশের স্বার্থে’।
আরও পড়ুন- পাহাড় ধ্বংস করে উন্নয়নের ছক ঠেলছে কোন বিপদের মুখে?
স্বার্থ মানে সেই পুরনো ও অতিব্যবহৃত কথা— ব্যবসা। অবাধ পুঁজি। যার সঙ্গে সরকারি যুক্তিক্রমে আসে ‘কর্মসংস্থান’, ‘রোজগার’-এর মতো অত্যন্ত ভারী ভারী সব শব্দ। সত্যিই তো, রোজগার হবে না? মানুষের অবস্থা ভালো হবে না? পর্যটকরা রেলগাড়ি চেপে সিকিম যাবে না? কিন্তু তার জন্য যদি অঞ্চলটাই বিপন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে? যদি বছর-বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে শয়ে-শয়ে প্রাণ উবে যায়, তাহলে?
যুক্তি আর স্মৃতির পিপীলিকার স্বভাবই দংশন করা। একটা আপাত নির্বিকার সামাজিক নির্জ্ঞানের মধ্যেও তাই ভয়ের স্মৃতি, যা গেল তার স্মৃতি ঘুরপাক খেতে থাকে। নেহাতই অযৌক্তিক, তাও। কখনও তা রোমান্টিক স্মৃতিমেদুরতা, কখনও আক্ষেপ, কখনও দগদগে ঘা। কদিন আগে সৌমিত্রদা, একদা ওয়াইল্ড লাইফার, তথ্যচিত্র-নির্মাতা সৌমিত্র ঘোষের সঙ্গে তাকদা যাওয়ার পথে এমনই সব স্মৃতির সঙ্গে ঠোক্কর খেতে হচ্ছিল। যে-নিসর্গটা দেখছি, সেটার অতলে তলিয়ে যাওয়া একটা স্মৃতির নিসর্গ। যা নেই, তাকে দেখা। দেখার চেষ্টা করা। যে নদীটা আর বেঁচেই নেই, তার কথা। তিস্তার বুকে পাঁচ-ছয় খানা বাঁধ বসেছে। আরো বসবে। তিস্তা বারবার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেও বসবে। নদীর দুপাশের পাহাড় ভাঙা হচ্ছে। বন কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। এই অঞ্চলটা আগে কেমন ছিল, তার গল্প বলছিল, সৌমিত্রদা। ওই যে ওইখানে তিস্তা মানে লেপচাদের রং-নিয়্যোর সঙ্গে এসে মিশল রেল্লি আর রিয়াং নদী। আজ ঠিক ওই জায়গাটা জুড়ে এনএইচপিসি-র ‘নিচু বাঁধ’। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। পুরনো রিয়াং স্টেশনের কাছে সাতাশ মাইলের বাঁধ, তারপরে কালিঝোরার বাঁধ। অনেক চেষ্টা করেও এই বাঁধগুলোর নির্মাণ আটকানো যায়নি। বাঁধ হলে তো বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ কারা ভোগ করে? সেই বিদ্যুৎ আসলে কোথায় যায়? হাজার হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎপ্রকল্পে যে নদীটা মরে গেল, যে পাহাড়গুলো মরতে বসল, হেক্টরের পর হেক্টর যেসব বন উজাড় হয়ে গেল— তার ভাগশেষে প্রাপ্তি কতটা? সেই ভাগশেষে কি সাম্প্রতিক বিপর্যয়গুলোও যুক্ত হবে না? তিস্তার বারবার উত্তাল হওয়ার পিছনে কি এহেন নির্বিচার বাঁধের, এহেন নির্বিচার উন্নয়নের কোনো হাত নেই? প্রশ্নের উত্তরগুলো বিপজ্জনক। তাই তা খোঁজা বারণ। সেইসব গল্প বলা বারণ।
অতএব, স্মৃতি ভুলে যেতে হবে। উন্নয়নের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে ভুলে যেতে হবে। দুর্যোগ আসবে, বিপর্যয় আসবে, হড়পা বান আসবে, অতি-বৃষ্টি আসবে। কিছু সেতু ভেঙে পড়বে, কিছু জায়গায় ধস নামবে। ওসব নিয়ে আটকে থাকলে চলবে না। কিছু মানুষ মারা যাবেন, এই যেমন সম্প্রতি তিরিশ-চল্লিশজন গেলেন। সে তো হতেই পারে। মৃতজনদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে। ভাঙা রাস্তা নতুন হবে। ভাঙা সেতু জুড়ে যাবে ফের। এসব চলতেই থাকবে। উন্নয়নের কো-ল্যাটারল ড্যামেজ। ‘দেশের স্বার্থে’ কিছু ক্ষতি, অনেক লাভ। এসব স্মৃতি দ্রুত থিতিয়ে যাবে। যেমনটা আগে গেছে। যেভাবে উত্তরোত্তর দুর্যোগ বৃদ্ধি পেলেও ঋতু-নির্বিশেষে পর্যটকদের ঢল বন্ধ হয়নি উত্তরাখণ্ডে বা হিমাচলে। কোনো আতঙ্কই এই উন্মাদনা কমাতে পারেনি। সেভাবেই গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত-বান-বন্যা-ধস নির্বিশেষে তরাই-পাহাড়ে জনস্রোত উপচে পড়বে। ক্রমাগত। নিরবচ্ছিন্ন। যা চলছিল, সেই নিয়মের পথে যেন ছেদ না পড়ে।
সরকার আসলে জানে, রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটা যন্ত্র আসলে বোঝে— ক্রম-সম্প্রসারণশীল উন্নয়ন আর ভোগের বিভ্রম এ সময়ের অন্যতম ধ্রুবপদ। একে একটা অদম্য নিয়ম এবং অভ্যেসে পরিণত করা গেছে। ভয়াবহ দুর্যোগ, ধ্বংস, ক্ষতি, ক্ষয় কোনোকিছুই যেন এই আত্মবিনাশী প্রবণতাকে টলাতে পারে না। যা খুশি ঘটে যাক, কিন্তু অশালীন উদযাপনের, ভোগের এই ‘শো মাস্ট গো অন’। মাস্ট গো অন...

Whatsapp
