ঘর থেকে দু'পা গেলেই কাশ্মীর! সাধ্যের মধ্যে শিকারা-ভ্রমণ করা যাবে পাহাড়ে-ঘেরা এই জায়গায়
মিরিকের লেকে শিকারা চললে স্থানীয়রা যেমন উপার্জনের এক নতুন দিশা পাবেন, তেমনই পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণ আরও বাড়বে।
If there is paradise on Earth, it is here, it is here, it is here.
কাশ্মীর দেখে এমনই ছিল মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের প্রতিক্রিয়া। আর ডাল লেককে বলা হয় "Srinagar’s jewel"। কাশ্মীরের বুকে আক্ষরিক অর্থেই একটুকরো সম্পদ ঝিলম নদী ও তার অশ্বক্ষুরাকৃতি হৃদ ডাল লেক। ভূস্বর্গের মনজুড়ে ডাল লেক। হাউসবোট, শিকারা বুকে নিয়ে ডাল লেক দেখে পর্যটকদের আসা-যাওয়া। ডাল লেক প্রতিদিন কাশ্মীরের মানুষের কথা শুনতে পায়। কাশ্মীরের থমথমে পরিস্থিতিতে ডাল লেকের মন ভালো ছিল না। এখন অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টেছে। তাও সকলের পক্ষে কাশ্মীরে পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয় না সব সময়। একে পোড়া গরম। তার মধ্যেই যদি টুক করে দু'-একটা দিনের ছুটি মিলে যায়, তাহলে একটুকরো কাশ্মীরের স্বাদ নিতে চলুন মিরিক। পাবেন অনাবিল শিকারা ভ্রমণের নৈসর্গিক সুখ।
মিরিক যেন একটুকরো ডাল লেক। দার্জিলিং পাহাড়ের মধ্যে একটুকরো লেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে রং-বেরঙের শিকারা। ঠিক যেন কাশ্মীরের ডাল লেক। লেকের টলটলে জল ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পর্যটকের দল। ডাল লেক মানেই পর্যটকদের ভিড়। দেবদারু, কাঠের হাউসবোটে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা। ফুলে ফুলে সাজানো শিকারায় দিন কাটানো। কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের আগে থেকেই পরিস্থিতি থমথমে। কারফিউ আর ১৪৪ ধারার চোখরাঙানিতে মন খারাপ ছিল ভূস্বর্গের সম্পদের। তার ওপর আরও পরে করোনার চোখরাঙানি। তাই অনেকেই কাশ্মীর সফরের স্বাদ বাতিল করতে বাধ্য হন। আর পকেট ফ্রেন্ডলি ট্যুর কে না চান? তার ওপর যদি দুয়ারে পেয়ে যান ডাল লেক, তাহলে হঠাৎ করে মনের কোনায় যেন ফেলা আসা স্বপ্নগুলো ভিড় করে।
আরও পড়ুন: দূরপাল্লার যাত্রায় আজও শেষ কথা, কেন লাল-নীল-সবুজ হয় রেলের কামরা?
কলকাতার কাঠফাটা গরম থেকে একটু স্বস্তি পেতে অনেকেরই বেড়ানোর তালিকায় এবারও সুন্দরী দার্জিলিং। আর সেই দার্জিলিংয়ে ঘুরতে যাওয়ার পথে অনেকেই একবার ঘুরে আসেন মিরিকে। পাহাড়ে ঘেরা বাঙালির চির-চেনা মিরিক। চারপাশে শাল, সেগুনের বাগানের ভিড়। লেকের বুক চিরে চলে গিয়েছে কাঠের সেতু। তার উপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলা, মিরিক লেকে বোটিং কিংবা ঘোড়ায় চাপার ছবি এখনও অনেকের স্মৃতির মণিকোঠায় যত্ন করে রাখা রয়েছে। তবে এর সঙ্গেই এবার যুক্ত হয়েছে সেই মিরিক লেকে শিকারায় চাপার আনন্দ। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য এবার মিরিক লেকেও বিশেষ শিকারার ব্যবস্থা করছে জিটিএ। একেবারে কাশ্মীরের ডাল লেকের আদলে শিকারায় ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিরিকের নীল জলে ভাসছে সুসজ্জিত শিকারা। অনেকেই বলছেন, মনের মানুষকে নিয়ে একবার চাপলে সারাজীবন মনে থাকবে এই সুখস্মৃতি।
এখানে শিকারার টানে পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি শিলিগুড়ি থেকে এখানে হর-হামেশা পর্যটকরা আসেন। তাছাড়া আশপাশের এলাকা থেকেও প্রচুর পর্যটক আসেন। এরাজ্যের কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের পর্যটকদের কাছে মেঘের রাজ্য মিরিক আলাদা তাৎপর্য নিয়ে আসে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও এখন বেড়াতে আসেন মিরিকে। এখানকার সুইস বোট তো সবসময়ই বাড়তি আকর্ষণ। কাশ্মীরের ডাল লেকের মতো করে ভাবনা নিয়েই আনা হয়েছে শিকারা। সঙ্গে পর্যটকদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে শিকারায় থাকবেন একজন মাঝি।
এদিকে মিরিক লেককে কেন্দ্র করে পর্যটনের সার্কিট গড়ে তুলতে চাইছে জিটিএ। এই মিরিকের চারপাশে রয়েছে একাধিক হোম স্টে। সেখানে একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে দুইদিন কাটিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসেই। এরপর নাগালের মধ্যে ভারত-নেপাল সীমান্তের পশুপতি বাজার, কুয়াশায় মোড়া একাধিক বৌদ্ধ গুম্ফা তো আছেই।
যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। চারপাশে শাল, সেগুনের ভিড়। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়। মাঝে লেক। মিরিকের সুমেন্দু লেকের এই দৃশ্য বহু ভ্রমণপিপাসুকেই কার্যত উন্মাদ করে তুলেছে। মিরিককে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এতদিন শুধুমাত্র বোটিংয়ের সুব্যবস্থা ছিল। এবার ওই লেকেই শিকারায় চাপার আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন সাধারণ মানুষ। তার জন্য অবশ্য বেশি গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে না কাউকেই।
সুপ্রাচীন মিরিক লেক বরাবরই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। বিশেষত, যাঁরা প্রথমবার দার্জিলিংয়ে যান, তাঁদের মিরিক লেক দেখা না হলে যেন ঘোরাটাই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। সুন্দর ছবির মতো চা-বাগান, জনপদ, লেক-সহ মিরিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নেহাত কম নয়। তবু যেন কিছুটা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পর্যটকদের কাছে এটি ‘দুয়োরানি’ হয়েই ছিল। তাই এবার সেই বদনাম ঘুচিয়ে মিরিককে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার প্রমাণ যে অচিরেই মিলল, তা বলাই বাহুল্য। উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে একাধিক প্রকল্পের ঘোষণার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মিরিকের সৌন্দর্যায়নের ব্যাপারে দার্জিলিংয়ের জেলাশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা যায়। এমনকী, তাঁর সফরসঙ্গী, দুই মন্ত্রীকেও মিরিক পরিদর্শনে পাঠান মুখ্যমন্ত্রী। এও জানা যায় যে, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই রাজ্যের দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও ইন্দ্রনীল সেন মিরিক পরিদর্শনে যান। তাঁরা লেক, চা বাগান-সহ সমগ্র মিরিক ঘুরে দেখেন। তার পর কোথায়, কী সৌন্দর্যায়ন করা যায়, সে ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রশাসনিক আধিকারিকরা মন্ত্রীদের জানিয়েছেন, কাশ্মীরের ডাল লেকের মতো মিরিকের লেকেও শিকারা চালানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মিরিকের লেকে শিকারা চললে স্থানীয়রা যেমন উপার্জনের এক নতুন দিশা পাবেন, তেমনই পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণ আরও বাড়বে। ফলে মিরিকের পর্যটন ব্যবসা জমে উঠবে। এর পর তা কার্যকর হতে বেশি সময় লাগেনি।
শিকারার সৌজন্যে মিরিক কি তাহলে আকর্ষণের নতুন ডেস্টিনেশন হয়ে উঠবে না ভ্রমণবিলাসীদের কাছে?