সুচিত্রা বলতেন 'দুষ্টু ছেলে', ডার্লিং মুনের প্রেমে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলাম আমি...
Moon Moon Sen: মুন, ডার্লিং মুন! স্ট্রিং থিওরি বলছে, আমরা নাকি পরস্পরকে ছুঁয়েই আছি।
মুনমুন আমার মধ্য যৌবনের বিদ্যুৎলতা। আমার প্যাশন-মেঘে এখনও জুড়িয়ে যায়নি মুনমুনের সেই অনন্য ঝিলিক। মুন তখন সবে কিশোরী। প্রথম ধরেছে কলি তার মল্লিকাবনে। ‘আজকাল’ সংবাদপত্র বেরিয়েছে সবে। আমি হয়েছি আজকালের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। আমার বন্ধুনি মুন কেমন যেন নেশার মতো গ্রাস করেছে আমাকে। মুনের প্লাবনের সঙ্গে চাঁদের প্লাবনের পার্থক্যটা হল, চাঁদের প্লাবনে শুধুই শরীরের রূপ। মুনের প্লাবনে শরীরের রূপের সঙ্গে মিশেছে ভাবনা, বাক্য, বুদ্ধির রূপ। মুন আমার জীবনে বুদ্ধিমতী, রূপবতীদের একজন। যার সঙ্গে যেকোনও সংলাপি সন্ধ্যা আমার মনকে জোগায় রস, আমার উপভোগে নিয়ে আসে কত রকমের রঙ আর ইশারার বুনন! কী যে ভালো কেটেছে আমার মুন-আভাসিত যৌবনের দিনগুলি। আমি কি মুনের প্রেমে পড়েছিলাম? সত্যি কথাটা হল, মুনের প্রেমে আমি খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলাম। একদিন মুন এল হঠাৎ আজকালের দপ্তরে। তখন আর্মহাস্ট স্ট্রিটে, রামমোহন রায়ের বাড়ির পাশেই আরও এক প্রসিদ্ধ বাড়িতে আজকালের দপ্তর। মুন এল কোনও এক শীতের বিকেলে। শার্ট আর জিন্স পরে। কাঁধে ক্যামেরা। ওর স্মার্ট ছিপছিপেমি সারা দপ্তর জুড়ে তুলল সাড়া, জ্বালল আলো। আমি মুনের হাত ধরে ঢুকলাম গৌরদার (আজকালের প্রধান সম্পাদক গৌরকিশোর ঘোষ) ঘরে। গৌরদা বুদ্ধিমতী, ঝাড়বাতি জ্বালা সুন্দরীদের বিশেষ চোখে দেখতেন। "আজকালে নিয়মিত লেখো তুমি। তোমার লেখার সঙ্গে তোমার তোলা ছবিও ছাপবো আমরা”, বললেন গৌরদা।
- আমি তো বাংলা লিখতে পারি না। তবে রঞ্জন যদি লিখে দেয়, তাহলে আমি লিখব।
আমার মনে হল, আমার হাতে চাঁদ আর মুন একসঙ্গে এল। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
- কিন্তু তোমার লেখার বিষয় কী হবে মুনমুন? প্রশ্ন করলাম আমি।
- আমার মা!
- এর থেকে ভালো কিছু হতে পারে না, বললাম আমি।
শুরু হল মুনমুনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ আলাপের দিনগুলি। মুন বলে। আমি লিখি। মুনমুনের তোলা সুচিত্রা সেনের ছবির সঙ্গে বেরোতে লাগল সেইসব লেখা।
কিন্তু মুনমুনের সঙ্গে প্রেমে পড়া থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম নিজেকে। আত্মসংযমের সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ করল মুনমুনের আবেদন, প্লাবন এবং তাঁর সংলাপের শহুরে দীপন। মুনমুনের স্বামী ‘হাবি’ হয়ে উঠল আমারও বন্ধু। মুনমুন, হাবি, আর আমি, কোহলদীপিত পানসন্ধ্যা, আহা কী জীবন! আর ফিরবে না কোনওদিন।
আরও পড়ুন- বসন্তকালেই ঋতুপর্ণার সঙ্গে ভাব! ওর শরীর-বিছানো তেপান্তর আমাকে টানে
মুন তখন থাকত হ্যারিংটন স্ট্রিটের এক উদাত্ত অ্যাপার্টমেন্টে। চওড়া কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হতো সেই বিলিতি অ্যাপার্টমেন্টে। বিশাল লিভিং রুম। পাশেই টানা বারান্দা। বিলিতি কায়দায় সাজানো। কিন্তু বাড়ির প্রধান আকর্ষণ মুনমুন। আমি কতবার বলেছি মুনমুনকে, এমন ডাবল-চাঁদের পূর্ণিমা আমার জীবনে আসেনি কোনওদিন। আর কখনও আসবেও না। আজ পিছন ফিরে তাকিয়ে ভাবি, এই যে পরস্পরের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেলাম আমরা, তাই মুনমুন তাঁর সমস্ত পূর্ণিমা নিয়ে এত বছর থেকে গেল আমার মুগ্ধ মেদুরতায়। সোহাগ বিচ্ছেদেই থেকে যায়। মরে মিলনে!
ইতিমধ্যে একটা দুঃসাহসী কাজ করে ফেললাম। সুচিত্রা সেনকে লিখলাম কয়েকটি লাবণ্যময় প্রেম ও সমর্পণের চিঠি, যাতে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হন। মুনমুনকে একদিন বললেন সুচিত্রা সেন, "তোর বন্ধু রঞ্জন আমাকে প্রেমপত্র লিখছে এই আশায় যাতে আমি ওকে ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়ে যাই। ওকে বলে দিস, কোনওদিন ওকে ইন্টারভিউ দেব না আমি।"
- কেন দেবে না? মুনমুন নাকি তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তরে সুচিত্রা সেন নাকি বলেছিলেন,
- ও ভারি দুষ্টু ছেলে। বেয়াড়া প্রশ্ন করবে।
- তুমি মার সঙ্গে কী করছ বল তো ? মুন হঠাৎ একদিন জানতে চাইল।
- প্রেম, বললাম আমি।
- তাহলে আমার সঙ্গে?
- একটা সাক্ষাৎকারের জন্য, অন্যটা ভালোবেসে।
মুনের সেই চুপকথা এবং তারপর হাসি, ভুলতে পারব না এ জীবনে।
আমি সুচিত্রা সেনকে নিয়ে একটি আস্ত বই লিখে ফেললাম। সেই বইয়ের উদ্বোধন করল মুন, পার্ক হোটেলে। তারপর সুচিত্রা সেনকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখলাম। নাম দিলাম উত্তরণ ও নির্বাসন। সুচিত্রা সেনকে নিয়ে সেই বইটির উদ্বোধনে এল মুন আর হাবি। মুন বলল আমাদের দু’জনের প্রসারী সখ্যের কথা। গহন ইন্টেলেকচুয়াল আদানপ্রদান ও সম্পর্কের কথা এবং হৃদয়কথার কিছু সংকেত ও আভাসও দিল সে। আমার মনে হল, আমার আকাশে সত্যিই জোড়া চাঁদ উঠল!
আরও পড়ুন- পতৌদি-শর্মিলার প্রাইভেট রুমে বজ্রপাত! বিখ্যাত দাম্পত্যের বিস্ফোরক সত্যি
আরও একবার একটি সত্যি কথা বলতেই হবে, মুনকে ভালোবাসি তাঁর সংলাপের ভাব, ভঙ্গি, চর্চিত সভ্যতা, তাঁর ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও লাবণ্য এবং তাঁর রসিক ইশারাময়তার জন্য। মুন ইংল্যান্ডে বড় হওয়া, চর্চিত হওয়া, দীক্ষিত হওয়া সুন্দরী। এই বঙ্গ সুন্দরীর মধ্যে আমি অ্যাংলো-স্যাকসন অ্যাটিটিউডের সংবেদ পেয়েছি। আমি আমার সৌভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ যে মুন আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে!
মুনের স্বামী হাবির মতো উদার অভিজাত মানুষ জীবনে বেশি দেখিনি। আমি আজকাল একাই থাকি। বিশেষ কারও সঙ্গে গলাগলি করি না। যার সঙ্গে প্রায় নিত্য পান করে থাকি সে থাকে আমার থেকে আলোকবর্ষ দূরে। মহাবিশ্বের কিনারে। আমরা কেউ কি জানি এই মহাবিশ্বের প্রান্ত কোথায়? সেই বন্ধুটি উত্তর পাঠাল এখুনি,
শোনো রঞ্জন, আমি সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্য, গ্লাসে গ্লাস লাগিয়ে ঠোকাঠুকি করে ‘চিয়ার্স’ বলব বলে, বেশি দূরে নয় কিন্তু, প্রায় তোমার সঙ্গে গায়ে-গায়ে: মাত্র ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে বন্ধু আমি তোমার। জানি, তুমি জানতে চাইছ কত বছর লাগবে আমার কাছে পৌঁছতে? শোনো, বেশি জোরে ড্রাইভ করো না। যদি ঘণ্টায় ৬৫ মাইল গতিতে কোথাও একবারও হিসিটিসি করার জন্য না থেমে চলতেই থাকো, তাহলে মাত্র ৪৮০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ বছর লাগবে আমার কাছে পৌঁছতে! অর্থাৎ এই মুহূর্তে মহাবিশ্বের যা বয়স তার থেকে ৩৫ মিলিয়ন বছর বেশি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মহাবিশ্ব আলোর গতিতে বেড়েই চলেছে! তাহলে?
এবার বলি, একটা ছোট্ট কথা, এই মহাঙ্কের প্রেক্ষিতে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ এসবের কোনও উত্তর হয়, হতে পারে? আমার সঙ্গে কাঠমান্ডুতে একবার আচমকা দেখা হল মুনের। আমার সঙ্গে আমার বছর দশেকের পুত্র। তখনও সে আমার সঙ্গে থাকে। তাঁর মা ছেড়ে গেছে আমাদের। আমারই দোষে। যাই হোক, মুনের সঙ্গে একটা সকাল মহাবিশ্বের সীমানা পেরিয়ে গিয়ে আলোচনা হচ্ছিল আমার। আমি হঠাৎ মুনকে ছুঁয়ে বললাম, তুমিই আমার মহাবিশ্বের প্রান্ত! মুন আমাকে উত্তরে কী বলেছিল, নাই বললাম! থাক না কিছু আলোকবর্ষ দূরের সমাহিত সমীকরণ! মুন আর আমি, আজও ছুঁয়ে আছি পরস্পরকে, একটিই কারণে। আমাদের দু’জনের শরীর ও বাসনা তারার ধুলো দিয়ে তৈরি। স্টারডাস্ট মিশে আছে আমাদের সখ্যে, সম্পর্কে, সংবেদে। বিজ্ঞানের দোহাই। আর দোহাই স্ট্রিং থিওরির। মুন, ডার্লিং মুন! স্ট্রিং থিওরি বলছে, আমরা নাকি পরস্পরকে ছুঁয়েই আছি।