প্রিয়জনেষু মা, তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম 'প্রেম' মানে কী?

Mother's Day 2023: আজ যখন আয়নায় নিজেকে দেখি, তখন আমার মুখের আদলে তোমাকেই তো খুঁজে পাই মা!

শ্রীচরণেষু মা,

আশা করি খুব ভালো আছো তুমি। আমিও ভালো আছি। সাত সাতটা বছর কেটে গেল, তোমাকে স্পর্শ করিনি, তোমার গায়ের গন্ধ পাইনি। এই হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের যুগে আজ তোমাকে চিঠি লেখবার এই সুযোগ পেয়ে মনে হলো কিছু কথা তোমাকে বলি। সত্যি বলতে কী, জীবনের কত কথাই যে তোমাকে আর বলাই হয়ে উঠল না, আজ তার হিসেব মেলে না মা!

ছোটবেলা থেকেই আমি বড্ড বেশিই বাবার নেওটা ছিলাম। বাবার ব্যাক্তিত্ব, বাবার সৌন্দর্য্য, বাবার গান সবসময় আমাকে মুগ্ধ করে রাখত। ছোটবেলায় কেউ আমাকে যদি বলত, আমাকে বাবার মতো নয়, তোমার মতো দেখতে, সেটা শুনে খুউব রাগ হতো জানো মা! খুব জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বলতাম, "না না আমাকে আমার বাবার মতো দেখতে।" আজ জীবনের এই মধ্য বয়সে এসে উপলব্ধি করলাম, একজন মেয়ের জীবনের সূচনাকাল থেকে শুরু করে, অজান্তেই তার মাকেই সে নিজের মধ্যে সবথেকে বেশি করে যাপন করে, বয়ে নিয়ে চলে। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে কখন যে তুমি আমার মধ্যেই তোমার স্বত্তার বীজ বপন করে দিয়েছিলে, তা আমি নিজেও টের পাইনি।

আসলে একটা সময়ের পরে, মা আর মেয়ে পরস্পরের দোসর হয়ে ওঠে। আমিও তেমনই অজান্তেই তোমার ছায়া হয়ে উঠেছিলাম। খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠার সূত্র ধরে, সেই কোন শৈশবেই বুঝেছিলাম একজন মা ঠিক যেন এক বহমান নদীর মতো। সংসারের নিয়ম-অনিয়মের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে সে তার জীবনের প্রকৃত 'আমি'টাকে কখন সেই জীবন-নদীর স্রোতেই ভাসিয়ে দেয়, আলাদা করে টের পাওয়ার জো নেই। তুমি সবার মতো, তবু কোথাও যেন তুমি বাকি সবার থেকে আলাদা। তোমার ওই একটা হালকা হাতখোঁপা, পাটভাঙা ধনেখালি শাড়ি আর কপালের মাঝে একটা লাল টিপ, তোমাকে আমার কাছে সবার থেকে আলাদা করে দিত প্রতিদিন।

তোমার মনে আছে মা, খুব ছোটবেলায় আমি যখন কবিতা আবৃত্তি করার চেষ্টা করতাম, তুমি একদিন গীতবিতান আমার হাতে দিয়ে বলেছিলে, "আগে এই গানগুলো ভালো করে পড়।" তখন ভাবতাম গান আবার পড়তে হয় নাকি! গান তো গাইতে হয়। কিন্তু তুমি বলেছিলে, "তুমি তখনই কোনও গান বা কবিতা নান্দনিকভাবে পরিবেশন করতে পারবে, যখন তুমি সেই লেখার প্রকৃত অর্থ বুঝবে। আর গীতবিতান তোমাকে আসল জীবনবোধের মানে বুঝতে শেখাবে যদি তুমি ভালোভাবে পড়ো।" আজ বুঝি কী ভীষণ সত্যি ছিল সেই সব কথাগুলো। একবার কিশোরী বয়সে এসে, তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মা 'প্রেম' মানে কী? তুমি বলেছিলে, তোমার জীবনে যে বা যা তোমাকে মহৎ প্রেরণা দেবে, জানবে সেই হলো প্রেম! কত সহজে, প্রেমের মানে আমাকে বুঝিয়েছিলে, আজও ভাবলে বিস্ময় লাগে!

একান্নবর্তী সংসারের বউ ছিলে তুমি। সংসারের নিত্যকাজ, রান্না-বান্না, পুজো, দায়িত্ব সব পালন করতে করতে, হয়তো ভুলেই গিয়েছিলে, তোমারও কোনও স্বপ্ন ছিল! শুধু বুঝতাম তোমার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন, তোমার সন্তানদের সুস্থভাবে মানুষের মতো মানুষ তৈরি করা। আমরা যখন জীবনের রঙিন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকতাম, তুমি তখন তোমার স্বপ্নের লাটাইয়ের সুতো গুটোতে ব্যস্ত! আচ্ছা মা, সত্যিই কি খুব প্রয়োজন ছিল এতটা ত্যাগের? কেন নিজের প্রতি এত উদাসীন ছিলে তুমি! কী পেলে বলতে পারো?

মা মানেই যে কোনও সন্তানের কাছে এক পরশমণির স্পর্শ। সহজ সরল জীবনবোধ মানেই আমার মা। আত্মত্যাগ মানেও আমার মা। এই এত বড় পৃথিবীতে মাতৃত্বই হল সেই অনুভূতি, যা মানুষকে, জঠর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শুধু আগলেই রাখতে জানে। আজও ভীষণ কঠিন মুহূর্তে সুতীব্র চিৎকারে তোমাকে ডাকতে ইচ্ছে করে জানো মা! জানি ছোঁয়ার সাধ্য আজ আমার নেই, তবু যে অনুভবে তোমাকেই পাই।

আজ যখন আয়নায় নিজেকে দেখি, তখন আমার মুখের আদলে তোমাকেই তো খুঁজে পাই মা! জানো, এখনও তোমার মতোন স্মার্ট হতে পারিনি। তবু চেষ্টা করি, তোমার মতো করে সাজার। দেশ থেকে এত হাজার মাইল দূরে থেকে আজও যখন রান্নায় ভুলে যাই কী ফোড়ন দিতে হবে, তখনও তোমার কথাই মনে পড়ে, কিন্তু চাইলেও আর তোমাকে পাই না। ভীষণ আনন্দ বা খুব মন খারাপের মুহূর্তে ইচ্ছে হয় তোমাকে সবটা বলি। ইচ্ছে করে, খেয়ে উঠে সেই ছোটবেলার মতো তোমার আঁচলে মুখ মুছি। কিন্তু তুমি নেই… কোথাও আজ নেই! তোমার ঘামে ভেজা শরীরের মিষ্টি গন্ধ, তোমার চুড়ির মধ্যে সেফটিপিনের রিনরিন শব্দ, তোমার স্নানের পরে লম্বা চুল বেয়ে নেমে আসা শীতল ধারা আজ আর কোথাও নেই মা!

ছ' বছর আগে প্রথম যখন দেশ ছেড়েছিলাম, এয়ারপোর্টের গেটের বাইরে আমার হাত দুটোকে তোমার হাতের মুঠোয় ধরে বলেছিলে, "চিন্তা করিস না আমি থাকব।" আমি জানতাম এত বছরের অন্তহীন পথ চলায়, তুমি ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলে। তোমার চলে যাবার মুহূর্তে আমি তোমাকে শেষবারের মতো ছুঁতে পারিনি! তবু জানি, তোমার অনন্ত শিখার জ্বলে ওঠা আগুনেই তুমি রেখে গিয়েছ আমার উত্তরণের আশীর্বাদ।

 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                ইতি -

                                                                                                                                                                                       তোমার মামমাম

মণিদীপা দাশ ভট্টাচার্য।

 

More Articles