প্রিয়জনেষু মা, যে গাছ যত বড় হয় তাকে তত ঝড় সামলাতে হয়, বলেছিলে তুমি
Mother's Day 2023: আমি এখন চল্লিশের দোরগোড়ায়। দশটা-চারটের অফিস আর সাত বছরের পৃথার পিছনে দৌড়ঝাঁপেই আমার সূর্যাস্ত হয়।
প্রীতিভাজনেষু মা,
বহুবছর পর গ্রামের ভিঁটেতে ফিরলাম আমি। আমাদের মাঠকোঠা বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে সহসা বুকটা টনটন করে উঠল তোমার আঁচলের ছায়াটুকুর জন্য। বিশ্বাস করো, মাকড়সার জাল আর ঝুলন্ত ঝুলের রাশ সরিয়ে সারাটা বাড়ি হাতড়ে ফিরলাম তোমাকে; খুঁজে বেড়ালাম আমার শৈশব, কৈশোর; তোমাকে ঘিরে কাটানো দিনগুলোকে। বুকের মধ্যে বুদবুদ হয়ে উঠে আসছিল কত ছবি, কত কথা। তোমাকে সরাসরি বলার সুযোগ নেই আর। তাই পরপারের ঠিকানাতেই পোস্ট করলাম এ চিঠি।
“এক আকাশে চিরদিন অমাবস্যা থাকে না। অন্ধকার যখন ঘোর হয়ে আসবে জানবি আলো খুব কাছেই,” ঠাকুর ঘরের ঝমকাটে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিল দাদামণি। তুমি কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলে। তোমার মনে আছে মা? একমাত্র জামাইয়ের শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার পর মেয়ে ও নাতনিকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তিনি, নাকি নিজেকে! আমি তখন চৌদ্দ পেরিয়েছি তুমি ছত্রিশ।
কেবল পায়ে ধরতেই বাকি রেখেছিল দাদামণি। তুমি বলেছিলে স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না। যেখানে হারায় সেখানেই নাকি খুঁজতে হয়। দুই সন্তান আর বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে শুরু হয়েছিল তোমার সংসার যাত্রার দ্বিতীয় পর্ব। সম্বল বলতে একখানা টিমটিমে মুদিদোকান আর একফালি দো-ফসলি জমি।
আট বছরের টুবাই ছোট থেকেই বড্ড ফাঁকিবাজ। কিছুতেই অংক করতে চাইত না। শুধু বলতো, “ধুর, আমার দ্বারা এসব অংক টংক হবে না!” তুমি বলতে, “চেষ্টা কর, চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই পৃথিবীতে। মানুষ চেষ্টা করে চাঁদে চলে যাচ্ছে। আর তুই একটা পরীক্ষা পাস করতে পারবি না?” টুবাই এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর মা ! তোমার কথার মান রেখেছে তোমার ছেলে। শুধু তুমি যা দেখে যেতে পারলে না!
তোমার মনে পড়ে মা, যেদিন আমি উচ্চমাধ্যমিকে জেলার মধ্যে নজরকাড়া নম্বর নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ঢুকেছিলাম, পিঠে আলতো হাত রেখেছিলে তুমি। বলেছিলে, “আমি জানতাম তুই পারবি।” চওড়া হাসিটাকে ছাপিয়ে তোমার সেদিনের চিকচিকে চোখের কোণ দুটোই আজও আমার মনে পড়ে।
হাল ছাড়ার মানুষ তুমি কোনওদিনই ছিলে না। বাবার অবর্তমানে শক্ত করে ধরেছিলে সংসারের রাশ। আমাদের মাছি ভনভন করা মুদি দোকানটাকে বদলে প্রথমেই এর একপাশটাতে উদ্যোগ নিয়ে বসালে টেলিফোন বুথ। আর একপ্রান্তে চালু করলে সেলাই মেশিন। আমি ও টুবাইও হাত লাগালাম। লম্বা লাইন পড়তে লাগল বড় রাস্তার ধারে আমাদের টেলিফোন বুথটাতে। ঘুরতে লাগল ভাগ্যের চাকা। ফুটো টিনের চালটা বদল হলো। ঠাম্মার হাঁপের টানের ওষুধ এল শহর থেকে। ইস্কুল যাওয়ার জন্য জুটল আমার একটা চকচকে সাইকেল। ফাঁকিবাজ টুবাইও পরিশ্রমী হয়ে উঠল তোমাকে দেখে। যদিও ওই পরিশ্রমই তোমার কাল হলো! তবে আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কতগুলো কথা তোমার কাছে বড্ড জানতে ইচ্ছে করে মা গো! জানি হয়তো উত্তর পাব না। তবু তোলা রইলো প্রশ্নগুলো। এত মনের জোর তুমি পেলে কোথায় মা? এত দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা টানতে গিয়ে কখনও কি ক্লান্ত লাগত না তোমার? রাগ হতো না বিধাতার প্রতি? মুখের হাসিটি তুমি ধরে রাখতে কীভাবে বলতো?
আমি এখন চল্লিশের দোরগোড়ায়। দশটা-চারটের অফিস আর সাত বছরের পৃথার পিছনে দৌড়ঝাঁপেই আমার সূর্যাস্ত হয়। জীবনে কোনও স্বাচ্ছন্দের অভাব রাখেনি তোমার জামাই। তবে সংসারের এই ঘানি টানতে গিয়ে ধৈর্য হারিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। জানো মা, আমার এই মনগরমের দিনগুলোতে নিজেকে জাগিয়ে রাখি শুধু তোমার স্মৃতি চেয়ে। প্রথম জীবনে দেখা তোমার সেই অসীম ধৈর্য, দায়বদ্ধতা ও আত্মত্যাগের ছবি আমি ভুলব না কখনও। আজ বুঝতে পারি, তোমার হাসিমুখের আড়ালে কত ক্লান্তি, কত বিষাদ তুমি লুকিয়ে রেখেছিলে নীলকণ্ঠের মতো। “সমস্যার মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। যে গাছ যত বড় হয় তাকে তত ঝড় সামলাতে হয়,” মাঝে মাঝেই বলতে কথাগুলো। সংসার সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আজ যখন ক্লান্ত লাগে নিজেকে, দুর্বল হয়ে পড়ি ক্ষণিকের জন্য, মনে করি কথাগুলো! আশীর্বাদ করো মা, যেন সব ঝড় সামলাতে পারি; বড় গাছ হতে পারি। যেখানেই থেকো, ভালো থেকো।
প্রণামান্তে,