প্রিয়জনেষু মা, হৃদয়খোঁড়া ভালোবাসা, শর্তহীন মমতা আমায় বড় করে তুলেছিল সেদিন

Mother's Day 2023: দু'বছর আগের এক সন্তপ্ত রাতে যখন স্ট্রেচার থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে তোমায়, নিথর-ক্লান্ত ঘুমে লীন হয়ে আছ তুমি…

প্রিয়জনেষু মা,

চার পেরিয়ে পাঁচে পা রেখেছি সবে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বেজেছে অনেকক্ষণ। একে একে প্রায় সবাই বাবা-মায়ের হাত ধরে বাড়ির পথে। দারোয়ান কাকু বিল্ডিংয়ের ঘরদোরে সশব্দে তালা ঠুকছে। এদিকে হাত ঘামছে আমার। কাঁপছে পা। গলা শুকিয়ে কাঠ। এমন তো আগে হয়নি কখনও! কেউ নিতে আসছে না কেন? স্কুলের মাসি রাগে গজগজ করছে। দুয়ো দিচ্ছে দায়িত্বজ্ঞানহীন অভিভাবকদের। আর আমি গলায় ঝোলানো বোতলের স্ট্র‍্যাপে আঙুল পেঁচিয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে চলেছি।

তখনই… ঠিক তক্ষুনি আমার দিশেহারা নজর গেল মূল দরজায়। কাঁধে লেদারের ব্যাগ সামলে পড়িমরি রিকশা থেকে নামলে তুমি। ছুটে এলে। তারপর ছোট গেটের হাতল নামিয়ে হাত নেড়ে ডাকলে আমায়। ক্লান্ত মুখে এক আঁজলা হাসির আলো। খুশির রোদ। অভিমানে আমার চোখ ভরে এল জলে। মুহূর্তে, অজান্তে। এই আমার প্রথম তুমি… প্রথম ভাসমান স্মৃতি।

দু'বছর আগের এক সন্তপ্ত রাতে যখন স্ট্রেচার থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে তোমায়, নিথর-ক্লান্ত ঘুমে লীন হয়ে আছ তুমি… এক লহমায় কিন্ডারগার্টেনের রোদেলা দুপুর, সেই অপরাধ-কবুল-হাসিমুখ পাতাঝরা হাওয়ার টানে ভেসে ভেসে আসছিল। বার বার। চাইছিলাম ভুলে যেতে। চাইছিলাম সশব্দ ঝনৎকারে স্মৃতির দুয়ারে তালা এঁটে দিক কেউ। নিস্ক্রিয় হয়ে যাক এই খরশাণ চেতনা, উৎসুক অনুভূতিমালা। কিন্তু অভিমানের ঠেউ তখন উথলে উঠছে ছলাৎছল। চোখ ভরে এসেছে জলে৷ মুহূর্তে, অজান্তে।

"কাকিমা নয়, বলো ছোটমা'— পাখিপড়া বুলির মতো কোনওদিন শেখায়নি কেউ। একটিবার কানে এসেছিল মাত্র। তারপর মিটিমিটি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলাম। প্রশ্ন জেগেছিল নিশ্চিত। ছোট মানে তো অল্প। তাহলে নতুন এই মা কি আমার 'অল্প-মা'? ঠিক নিজের নয়? কিছুদিন যেতে-না-যেতে এর উত্তর পেয়েছিলাম। কোনও কাটছাঁটের বালাই নেই। কমতির প্রশ্ন নেই। বাড়ির নতুন অতিথি ঠিক মায়ের মতোই 'বেশি'। মায়ের মতোই 'বড়'। আদর, আঁচলে, শাসনে, চুমুতে, লাল টিপে, সাদা শাঁখায়, খোলা চুলে…মা। মা-ই।

শীতের বিকেল। আলুথালু 'কোলের ছেলে'-কে জড়িয়ে-জাপ্টিয়ে বাড়ি ঢুকছ তুমি৷ চারপাশে সঘন আনন্দ-গুঞ্জন। আমি ভেতর ঘরের দরজার আড়ে দাঁড়িয়ে। দু'চোখ কুয়াশা। দমচাপা অস্বস্তি। অজানা বিষাদ। নতুন কষ্ট। হায়! সব কিছু শেষতক ব্যক্তিগত রাখতে পারলাম কই? মুখোমুখি হতেই আড়ষ্ট হাসির প্ল্যান মাঠে মারা গেল। গলা ছেড়ে কেঁদে ফেললাম হাভাতে বোকার মতো। তুমি কোলের ছেলেকে আর কারও হাতে দিয়ে জড়িয়ে ধরলে আমায়। ছাইচাপা ঈর্ষার সে কান্না ভোলাতে হৃদয়খোঁড়া ভালোবাসা, শর্তহীন মমতার ওম আমায় এক লহমায় অনেকটা 'বড়' করে তুলেছিল সেদিন।

ঘন ডালের সুবাস, ধোঁয়া ওঠা ভাতের ঘ্রাণ, উদ্বায়ী আতরের মেদুরতা, ঠান্ডা করতলের স্পর্শ, চিরুনি-জড়ানো-চিকুরের জটিলতা, পাটভাঙা শাড়ির পবিত্র আলো, স্কুলের দিদিমণির পেশাদারি গমক, খাতার অঙ্কে বিহ্বল ভ্রূ-ভঙ্গি, হারমোনিয়ামের রিডে স্বচ্ছন্দ চলন, নজরুলের গানে নিমীলিত চক্ষুপল্লব… এই নিয়েই তো তুমি। আমার ছোটোমা… আমার মা।

 

More Articles