প্রিয়জনেষু মা, বারবার বলেছো, "রান্না নিয়ে এত মেতে থেকো না, পুটুকে পড়াও"

Mother's Day 2023: জীবন যে কী আর মা কীভাবে তার সূত্র ধরে রাখে তা বুঝতে বুঝতেই জীবনের ড্রপসিন নামে।

মা, আমার মা,

ছোটবেলায় বড়দের চিঠি লেখার যে সম্বোধন তুমি শিখিয়েছিলে প্রথমেই তা উড়িয়ে দিলাম। চরণপূজা তোমার ধাতে ছিল না। তোমাকে কখনও চিঠি তো লিখিনি তাই চিঠিতে এই রীতি তুমি পছন্দ করো কিনা তাও জানা হয়নি। বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী ছাত্রী, যে কোনও বিষয় পড়ানোতে দক্ষ, সাবধানী, খুঁতখুঁতে তুমি (যেমন আমার ক্লাস ফাইভে ছিলে) হয়তো হালকা চোখ পাকাবে। আবার আমার পরিণত বয়সের তুমি, মানে মারোয়ার মাম্মাম হয়তো বলবে এটাই ঠিক আছে।

তোমার সঙ্গে আমার গল্পের রিয়েল টাইম আটত্রিশ বছর। মনের ক্যালাইডোস্কোপে তা হয়তো আরও সংক্ষিপ্ত। যে নৈর্ব্যক্তিকতায় তুমি জীবনকে যাপন করতে চেয়েছিলে বা করতে বাধ্য হয়েছ তা নিতান্তই সরলরৈখিক হওয়ার কারণে তাতে টিভির মেগাসিরিয়ালের মতো ডালপালা জুড়ে গল্পের কিলবিলানি নেই। ঈশ্বরী পাটনীর মতো সন্তানকে খাইয়ে পরিতৃপ্ত রাখার পাশাপশি তুমি চেয়েছিলে আমাদের সারস্বত বিকাশ। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টে খুশি হলেও তোমার একান্ত গর্ব ছিল সন্তানের সারল্যে ও বুদ্ধিমত্তায়, জীবনের উৎসবমুখরতায়, সবাইকে নিয়ে পথ চলার আনন্দে। এত সব আপাত সহজ কিন্তু বহুমাত্রিক লক্ষ্য পূরণে তুমি বারবার ক্লান্ত হয়েছ, খিন্ন অপরিতৃপ্তিতে মন, শরীর ভেঙেছে। নিজের জন্য তোমার বাঁচা হয়নি। তাই হয়তো আমার মধ্যেই সেই সব না পাওয়াকে আকার দিতে চেয়েছিলে। আমার স্বনির্ভরতা, স্বাধীন, সরব জীবন তোমাকে কী দিয়েছিল? জানতে চাইনি কখনও। আসলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তোমার মৃত্যুর আগে তোমার মধ্যে থাকা মানুষটাকে নিয়ে কখনও ভাবিনি! ভেবেও যে বড় আহত লাগে। আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হই।

জীবন যে কী আর মা কীভাবে তার সূত্র ধরে রাখে তা বুঝতে বুঝতেই জীবনের ড্রপসিন নামে। মঞ্চনাটক, নাচ তোমার খুব প্রিয় ছিল। সেই ভালোলাগা ছুঁয়ে আজও নিয়ম করে নাটক দেখি, লিখি, পড়ি, ভাবি। রান্নাঘর তোমার সাম্রাজ্য ছিল। কিন্তু স্বেছায় রান্নাবান্নার কলাকৌশল আমাকে শেখাওনি কখনও। পাছে আমি তা নিয়েই মেতে থাকি। অভিমান হতো, খুব। শ্বশুরবাড়িতে এসে রান্নাবান্না নিয়ে খুব উৎসাহী হয়েছিলাম। তোমার কাছে তা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও তুমি বিরক্ত হয়েছো। বারবার বলেছো, "রান্না নিয়ে এত মেতে থেকো না, পুটুকে পড়াও। গানের রেওয়াজ করো।" তোমার শাসন, মেজাজ, গাম্ভীর্যকে ভয় পেয়েছি, সমঝে চলেছি। এখন মনে হয় ভাগ্যিস তুমি এমন ছিলে তাই সকলসহার বিপ্রতীপে থাকা মানুষটার ভালোবাসার আঁচ পেয়ে মানুষী থেকে শুধু মানুষ হবার রাস্তায় স্বতঃস্ফুর্ত পা ফেলেছি। রান্নাঘরের বাইরে রান্নাখাওয়ার সংস্কৃতিগত চরিত্র, মনস্ত্বাত্তিক দিক নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছি।

লীলা মজুমদার তোমার খুব পছন্দের লেখিকা ছিলেন। বাতাসবাড়ির সেই পাহাড় চুড়োর অনেক উঁচুর ঘর, ছুরপি খেতে খেতে দম নিয়ে যেখানে উঠতে হয়, সেখানেই তুমি থাকো এখন? নাকি দেবযানের কোনও এক লোকে? কেউ জানে না। আমার স্মৃতির সত্ত্বা জুড়ে যে আঁধার আলোর জগত যার অনেকটা এখনও অচেনা সেখানেই তোমার বাস। যদি কখনও কোথাও দেখা হয় তখন এসব নিয়ে অনেক কথা হবে। সঙ্গে থাকবে শিঙ্গাড়া, জিলাপি, ডায়েট কোক আর এক খিলি একশ বিশ জর্দ্দা দেওয়া মিঠাপাতির পান।

                                                                                                    ইতি,

                                                                                                    তোমার রিমি

 

More Articles