জন্ম থেকেই নেই দু'হাত, পায়ে চালান বিমান! চাইলেই হয় অসাধ্যসাধন, প্রমাণ করেছেন তিনি
Jessica Cox: জন্মগতভাবে দু'হাত নেই, তাতে কী! তবু আকাশে বিমান ওড়ানোর মতো দুঃসাধ্য কাজ করছেন জেসিকা।
প্লেন চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। পাইলট হতে গেলে শুধু প্লেন চালানোর কৌশল জানলেই তো হবে না, তার পাশাপাশি দৃষ্টিশক্তি-শারীরিক সক্ষমতার মতো অনেকগুলি জরুরি বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত আছে। এমন বহু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা নানাভাবে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। শারীরিক দুর্বলতা বা অক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁরা হাল না ছাড়ার মনোভাব দেখিয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে উদাহরণ হয়ে উঠেছেন যে, ইচ্ছে থাকলেই যে কোনও বাধাকে জয় করা সম্ভব। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বাংলার মাসুদুর রহমান বৈদ্য। বাংলার এই সাঁতারু পা না-থাকা সত্ত্বেও ইংলিশ চ্যানেল পার করেছেন, উঠেছেন পাহাড়েও। তেমনই একজন হলেন আমেরিকার এক হার না-মানা মহিলা, যার দু'হাত না থাকা সত্ত্বেও তিনি একের পর এক অসম্ভব কাজকর্ম করে দেখিয়েছেন। নাম জেসিকা কক্স।
প্রতিভা এমন এক গুণ, যেখানেই থাকুক তা বিকশিত হবেই। ঠিক যেন আলোর মতো। তেমনই এক প্রতিভা জেসিকা কক্স। জন্মগতভাবে দু'হাত নেই, তাতে কী! তবু আকাশে বিমান ওড়ানোর মতো দুঃসাধ্য কাজ করছেন জেসিকা। মানুষ চাইলেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। আর সেটা করে দেখিয়েছেন জেসিকা। তবে তার পথটা মোটেই মসৃণ ছিল না। ১৯৮৩ সালে আমেরিকার অ্যারিজোনায় তাঁর জন্ম। পরিবারে নতুন সদস্যর আগমন হলে সাধারণত খুশির ধুম পড়ে যায়, কিন্তু জেসিকার জন্মের সময় এমন হয়নি। সবাইকে হতাশ করে জন্ম নেন জেসিকা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন তাঁর মা, যখন দেখলেন, তাঁর মেয়ে জন্ম নিয়েছে দুটো হাত ছাড়া। আর এটাও আশ্চর্যজনক যে, তাঁর মাতৃত্বকালীন কোনও জটিলতা ছিল না, তাহলে গর্ভে থাকাকালীন জেসিকার হাতদুটো কেন তৈরি হয়নি? ডাক্তাররা এটাকে বিরল জন্মগত ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করেন।
তিন ভাইবোনের মধ্যে জেসিকা কক্স মেজো। হাত নেই বলে তাকে কখনও আলাদা করে দেখা হয়নি। হাত না থাকলেও জেসিকাকে তাঁর দুই ভাইবোনের মতো অর্থাৎ স্বাভাবিক মানুষের মতো করে বড় করেন তাঁর বাবা-মা। ১১ বছর বয়সে কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দিয়েছিল তাঁর বাবা-মা। কিন্তু এই কৃত্রিম হাতটিকে মেনে নিতে পারেনি জেসিকা। ১৪ বছর বয়সে কৃত্রিম হাতদুটো খুলে প্রথম ডানা মেলে ওড়ার প্রয়াস শুরু করেন জেসিকা কক্স।
আরও পড়ুন: বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকুতি! বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে লাইফ জ্যাকেটের এই পাহাড়!
স্কুলে গিয়ে দূর থেকেই দেখতেন বন্ধুরা খেলা করছে মাঙ্কিবারে, চড়ছে দোলনা। অথচ শৈশবের এইসব অধ্যায় ব্রাত্য থেকে গেছে তাঁর জীবন থেকে। তার মধ্যেই ভেসে আসত বন্ধুদের টিটকিরি, হাসি-ঠাট্টা। মানসিকভাবে সেই আঘাত ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী করে তুলত জেসিকাকে, করে তুলত আরও জেদি। অনেকটা সেই জেদের বশেই শুরু হয়েছিল লড়াই। প্রথমে ট্যাপ ড্যান্সিং শেখা। তারপর নাম লেখানো মার্শাল আর্টের খাতায়। অবাক লাগছে? হ্যাঁ, ঠিকই বলছি, মার্শাল আর্ট। তাইকোণ্ডুতে তৃতীয় পর্যায়ের ব্ল্যাকবেল্ট অধিকারী হয়েছিলেন অ্যারিজোনার বাসিন্দা। পা দিয়ে অনায়াসেই চালাতে পারেন নানচাক। শুধু তাই নয়, প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে পিয়ানো বাজানো- স্কুল-কলেজে পড়ার সময় সবটাই শিখেছেন জেসিকা। শুধু বাকি ছিল একটা স্বপ্নপূরণ। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকেই জেসিকা ভেবে এসেছিলেন, একদিন উড়ান দেবেন ককপিটে বসে। তবে বড় হয়ে জেসিকা বুঝতে পারেন, তাঁর রয়েছে অ্যাক্রোফোবিয়া, অর্থাৎ উচ্চতায় উঠলে তাঁকে আঁকড়ে ধরে আতঙ্ক।
তবে নিজে প্রাথমিকভাবে পিছিয়ে এলেও তাঁর সেই স্বপ্নের কথা মনে রেখেছিলেন তাঁর বাবা। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই উড়ানের ভয়কে ইতিবাচক দিকে পরিণত করার লড়াই শুরু হয় জেসিকার। মনোবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করার পর ‘রাইট ফ্লাইট’ নামের একটি অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন জেসিকা ও তার বাবা। প্রাক্তন যুদ্ধবিমানচালক ও সংস্থার মালিক রবিন স্টেডার্ড তাঁর এই অদম্য ইচ্ছা দেখে নিজেই দায়িত্ব নেন প্রশিক্ষণের। প্রাথমিক শিক্ষার পর ‘অ্যাবেল ফ্লাইট’ নামে আরও একটি সংস্থায় ভর্তি হন জেসিকা। সেখান থেকেই শেষ অবধি বিমানচালকের পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর আদায় করে নেন পাইলট হওয়ার পূর্ণ লাইসেন্স। তার তিন বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান চালক হিসেবে সেনাবাহিনীতে নাম লেখান জেসিকা। বর্তমানে সেখানেই কর্মরত ৩৭ বছরের এই মহিলা পাইলট।
তিনি একজন আন্তর্জাতিক মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন এবং বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যেতে থাকেন। যখন সকলকে অনুপ্রেরণা দিতে ব্যস্ত ছিলেন জেসিকা, তখন তাঁর জীবনে আসে ভালবাসার মানুষ, প্যাট্রিক ছেইম্বালেন। ২০১২ সালে প্যাট্রিককে বিয়ে করেন তিনি। বিয়েতে তাঁর তিনজন বিশেষ অতিথি ছিলেন, যাঁদের হাত নেই। জেসিকা সেই বিশেষ অতিথিদের ব্যাপারে বলেন, “হাত না থাকলে জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। হাত না থাকলেও মানুষ মনের মানুষ খুঁজে পায়, ভালবাসা পায়। হাতহারাদেরও স্বাভাবিক জীবনযাপন করার পূর্ণ অধিকার আছে। এটা দেখানোর জন্যই আমি ওদের তিনজনকে ডেকে এনেছি।"
জেসিকা দুই পা দিয়ে কীভাবে বিমান চালান জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাম পা দিয়ে জেসিকা থ্রোটল সামলান আর ডান পা দিয়ে ইওক। এভাবে দিব্যি এরকুপ মাটিতে নামিয়ে নেন হাতবিহীন এই পাইলট। পা দিয়ে প্লেন চালাতে সমস্যা হয় কি না, এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সিএনএন-কে এক সাক্ষাৎকারে জেসিকা বলেন, “সমস্যা হবে কেন! অন্য পাইলটরা হাত দিয়ে যে কাজগুলো করে, আমি দুই পা দিয়ে সেগুলো করি।" তিনি আরও বলেন, “আমি ছোটবেলায় প্লেনে উঠতে ভীষণ ভয় পেতাম। প্লেনে উঠলেই প্রার্থনা করতাম, যেন কেউ আমাকে এখান থেকে নামিয়ে দেয়। তবে একটা ডুয়েল ফ্লাইট আমার জীবনটা বদলে দিয়েছে। আমার পাশে বসা পাইলট হঠাৎ প্লেনের কন্ট্রোল ছেড়ে দিয়ে আমাকে বললেন, কন্ট্রোল করতে। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তবে ভয়ের চেয়ে বেশি আনন্দ লাগছিল।”
দুই হাত নেই— ছোটবেলা থেকে বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়েই বেশ খেলোয়াড়সুলভ স্পৃহায় বেড়ে উঠেছেন জেসিকা। জিমন্যাস্টিকস, নাচ ও সার্ফিং শিখে ফেলেছেন অনায়াসে। শুধু তাই নয়, এবার পা দিয়ে অনায়াসে তিনি বিমানও চালাচ্ছেন। পাইলট হিসেবে বিমান চালিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। তবে এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীদের অনুপ্রেরণা দিতে মাঝেমধ্যেই সভার আয়োজন করে থাকেন তিনি। এখনও পর্যন্ত ২৩টি দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন জেসিকা কক্স। অনুপ্রাণিত করেছেন হাজার হাজার মানুষকে। মনের জোর থাকলে যে সবকিছুই জয় করা সম্ভব, তারই উদাহরণ তিনি।