শ্রমিকদের পাওনার দাবিতে প্রথম সই করেছিলেন মৃণাল সেন

মিছিল, ব্যারিকেড, হরতাল আর পুলিশের অত্যাচারের সঙ্গে আগুন-ঝরা কলকাতার অবস্থাকে এক নতুনতর ফিল্মি বাস্তবতার নিরিখে মৃণালদা চিত্রায়িত করলেন একটার পর একটা ছবিতে।


আমাদের বুঝে ওঠার দিনগুলোয়, আমাদের  শিখে ওঠার সহজপাঠে, আমাদের ক্রিয়াশীল হওয়ার ইন্ধনে ও চলচ্চিত্রশিক্ষার বিশ্ববীক্ষায় ছিল তাঁর অনন্য উপস্থিতি, তিনি মৃণাল সেন। আসলে এই 'আমাদের' শব্দটির একটা ব্যাপ্তি আছে। আমার প্রজন্ম তো বটেই, তারপরও একাধিক প্রজন্ম মৃণালদার কাছ থেকেই পেয়েছে চলচ্চিত্রের নয়া ধারাপাত। প্রতিবাদের সিনেমা, সমালোচনার সিনেমা, আর যে সিনেমা  আত্মসমালোচনার। যাঁরা তাঁর ছবিতে 'তাৎক্ষণিকতা' শনাক্ত করে ঢেকুর তোলেন, তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই। ওটা আসলে হলো সাম্প্রতিকতার কৌণিক প্রতিস্থাপন। যা উঠে আসে দ্বন্দ্বমূলক মেধাবৃত্তি থেকে, যা ইতিহাসে জারিত। আবার একই সঙ্গে মৃণালদা ছিলেন সামাজিক তথা রাজনৈতিক বিশেষ বিশেষ  মুহূর্তের একনিষ্ঠ সন্ধানী। যে কারণে কোনও সংবাদের শিরোনাম কিংবা নেহাতই খবরকে তিনি তাঁর ছবির উপাদান হিসেবে বাবহার করেছেন। যেখানে সংবাদ আর সংবাদ রইল না। সেই খণ্ডখবর হয়তো তৈরি করল এক দুরন্ত প্রশ্নমালা (ক্যাটাকিজম), এই সমাজের প্রতি, সরাসরি রাষ্ট্রের প্রতি। আবার কখনও দর্শককে এই এই খবরের কাগজ উদ্ভূত তথ্যাদি টেনে নিয়ে গেছে দীর্ঘ পোলেমিকাল ডিসকোর্সে।

 


জাঁ পিয়েরে গোরিন ও জাঁ লুক গোদারের বাহাত্তর সালে মুক্তি পাওয়া 'লেটার টু জেন' ছবিটি প্রকাশ্যে আসার আগে থেকেই মৃণাল সেন তথ্য, ঘটনা এবং সংবাদ-বিসংবাদকে তাঁর নির্মাণে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ১৯৭১-এ 'ইন্টারভিউ', '৭২-এ 'কলকাতা ৭১' আর '৭৩-এ 'পদাতিক' ও তারপর 'কোরাস' সেই ধারাবাহিকতার কথাই বলে। যেখানে সংবাদ মূলত কাব্য হয়ে ওঠে। যে কাব্য পালাবদলের রঙে প্রতিবাদমুখর বর্ণবৈচিত্রের অভিলাষী এবং তা সাদা-কালো। এই কথা লেখার দু'টি কারণ আছে, একটি হলো, সাধারণ্যে (যাঁদের তথাকথিত সিনেমা সমালোচকও ভাবা যেতে পারে। আমি তাঁদের সাধারণ ও মামুলি বলেই মনে করি) এমন ধারণা আছে যে, মৃণাল সেন ইউরোপীয় ভাবনাকে বাংলায় অনুসরণ করেছেন। তা কতটা ভ্রান্ত, তা বোঝাতে। আরেকটি কারণ হলো, ওপরে লিখিত মৃণালদার ছবিগুলোতে চোখ রেখে আরেকবার সেই সিনে-পরিব্রাজনে ফিরে যাওয়া। যেখানে এই চলচ্চিত্রকার একার কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে বাংলা ছবির মোড় ঘুরিয়ে দেন।

 


একথা কোনওভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, 'ভুবন সোম' নতুন ধারার ছবির অন্যতম পথিকৃৎ। তেমন 'বাইশে শ্রাবণ'-এ যুদ্ধের প্রেক্ষিতে অনাহার আর দুর্ভিক্ষের কাহিনী ও তার পরিসর অথবা 'আকালের সন্ধানে'-র মতো ফিল্ম উইদিন ফিল্ম, যা আকালের সঙ্গে আটের দশকের বাস্তবতার সংশ্লেষে এক দিবারাত্রির গল্প- ইত্যাদি-প্রভৃতি ছবির সম্পর্কে এখানে লিখব না। কেননা, আমার উদ্দেশ্য অন্য। এটা ধরে নিয়েই লিখছি, মৃণাল সেন যে সবসময়ই বিপরীত স্রোতের মানুষ, তা আমার পাঠিকা-পাঠকরা ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটাও ঠিক যে, মৃণালদা সবসময়ই আলোচিত নাম। তা শুধু ফিল্মের কারণে নয়। সিনেমা ও সংস্কৃতির ভিন্ন স্বর হিসেবে, প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসী মনোভাবের সমালোচক হিসেবে ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের অগ্রণী অংশের প্রতিবাদী সওয়াল করার কারণে। সব ক্ষেত্রেই তাঁর বাঙ্ময় উপস্থিতি, সেই জন্যই।

 


এই লেখা কেন যেন মৃণালদারই আঙ্গিকে সিঁড়ি ভাঙছে। স্মৃতিঘোরে চলে আসছে নানা মুহূর্ত। মৃণালদার বাড়ি, আড্ডা, তর্ক-বিতর্ক, সিনেমা, শট বাই শট, লেন থেকে বাই লেন। এক অসামান্য পরিক্রমা। আমার মৃণাল সেন চর্চার অনেক আগে থেকেই শুরু হওয়া ছয়ের শেষ থেকে সত্তর, আশি হয়ে ক্রমেই এক বিস্তৃত পরিসর তৈরি করেন মৃণাল সেন। যা ছিল সামগ্রিকভাবেই এক সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিজ্ঞান থেকে উঠে আসা। সেসময় বাবুর বাড়ির ড্রইংরুম থেকে চায়ের দোকানে ফিল্ম পরিকল্পকদের পৌঁছতে মৃণাল সেন যে সাহায্য করেছিলেন, সে ইতিহাস লেখা হবে কি না, জানি না। তবে যে কোনও পরিস্থিতিতেই সিনেমাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে, মাঠে-ময়দানে সিনেমাকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মৃণালদা ছিলেন অগ্রগণ্য।সিনেমা হল-কর্মচারীদের লাগাতার ধর্মঘটে যখন শহর-শহরতলিতে, গ্রামে-গঞ্জে মাঠে মাঠে টিকিট বিক্রি করে ষোলো মিলিমিটারে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়, তখন মৃণালদা ছিলেন এই আন্দোলনের সামনের সারির একজন চিন্তক।

 


মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা যে ছবি করতে সাহস পেয়েছিল তাঁর জন্য, সেকথা মৃণালদা জানতেন কি না আমার জানা নেই। তবে পিছন ফিরে তাকালেই বুঝতে পারি, একঝাঁক ছবি-করিয়ে কীভাবে নতুন ধারার ছবি করতে শুরু করলেন। শুধু তাই নয়, একাধিক ফিল্মমেকারকে তিনি প্রযোজক পাইয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। ফিল্মের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। স্টুডিও সেট আর প্রকৃতির দোলাশোভিত ক্যামেরাকে বস্তিতে, অলিতে-গলিতে, রাস্তাঘাটে টেনে নামিয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। মূলধারার বিপরীতে তা ছিল এই সময়ের উল্লেখযোগ্য নির্ণয়।

 


মৃণালদার এই ছবিগুলোতে ক্যামেরার বেপরোয়া চলন ও ছোট ছোট জাম্প কাটে (কাট আপ বলা যায়) তিনি বুনে দিয়েছেন প্রস্তাবিত মন্তাজের অনন্ত সম্ভাবনার সুনির্দিষ্ট সিনে-কারুকাজ। নিছক কাহিনি-নির্ভরতাকে দূরে সরিয়ে তিনি সমালোচনাকে, দৈনন্দিন ঘটনার রাজনৈতিক নির্যাসকে সেলুলয়েডে প্রতিফলিত করেছেন।

 


চরম দুর্দিন তখন। লড়াইয়ের একটা প্রেক্ষিৎ তখন তৈরি হচ্ছে। মিছিল, ব্যারিকেড, হরতাল আর পুলিশের অত্যাচারের সঙ্গে আগুন-ঝরা কলকাতার অবস্থাকে এক নতুনতর ফিল্মি বাস্তবতার নিরিখে মৃণালদা চিত্রায়িত করলেন একটার পর একটা ছবিতে। যে আন্দোলনকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে মৃণালদার ক্যামেরা কথা বলে উঠেছিল। মৃণাল সেন নকশাল আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল যেমন ছিলেন, তেমনই সমালোচনা করেছেন তাদের নানা অভীষ্ট ও তত্ত্ব-প্রকৌশল নিয়ে, এবং সে বিষয়ে তিনি ছিলেন অকপট। আবার এই মৃণাল সেনকেই মুহুর্মুহু বলতে শুনেছি, "আই অ্যাম আটারলি কনফিউজড‍।" তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু একজন শিল্পীই তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, আবার তিনিই সমাধান খুঁজতে গিয়ে অবসন্নও হয়ে পড়তে পারেন। আসলে সমাধান বাতলানো তো কোনও চলচ্চিত্রকারের কর্ম নয়। কিন্তু একজন বামপন্থী হিসেবে, একজন মার্কসবাদী হয়ে তাঁর অন্বেষণ যেন অ্যান্টি ড্যুরিং-এর নেগেশন অফ দ্য নেগেশনকে প্রতিস্থাপিত করে তাঁর পঁয়ত্রিশ মিলিমিটারের সাদা-কালো এই ছবিগুলোয়। ফিল্মের ছাত্র হিসেবে আমরা যারপরনাই অবাক হই।

 


একটা বিষয় এখানে উল্লেখ রাখি, তা হলো আটের দশকে, এক বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকার শ্রমিকরা তখন ধর্মঘট ডেকেছিল, তখন আমরা গুটিকতক বিপরীতমুখী লেখালিখি-করিয়ে, ছবি-আঁকিয়ে, সিনেমা-করিয়ে সেই আন্দোলনের সমর্থক ছিলাম। মূল বক্তব্য ছিল, এমার্জেন্সি সার্ভিসের নামে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনার দাবিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। সেই প্রতিবাদকে মুখর করে তুলতে আমরা একটি আবেদনের লিফলেট ছাপানোর ব্যবস্থা করি। সেখানে সই সংগ্রহ করতে তৎকালীন নানা ব্যক্তিত্বের শরণাপন্ন হতে হয়। প্রণম্য সমর সেন, কবি শঙ্খ ঘোষ, ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, চলচ্চিত্রকার বারীন সাহা, হিন্দু ধার্মিক কথাসাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদার, প্রতিষ্ঠানবিরোধী গদ্যকার সুবিমল মিশ্রের কাছে উপস্থিত হই। প্রত্যেকেরই একটাই কথা, "মৃণালবাবু কি সই করেছেন? মৃণাল সেন?" এর থেকে কী ধরে নেব?

 

এটা এই কাহিনির অঙ্গ নয় যে, এই আবেদনে প্রথম সই করেছিলেন মৃণালদা। এখানে উপপাদ্য হলো, মৃণালদার প্রতি সেই সময়কার ক্রিম অফ ইন্টেলিজেনশিয়া-র ভরসা। আবার বলব, আমাদের দেশে একজন চলচ্চিত্রকারের প্রতি এমন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মান্যতার দৃষ্টান্ত খুব কম দেখা গেছে। মৃণালদা ছিলেন সমস্ত দিক থেকেই একজন অ্যাক্টিভিস্ট। অনর্গল কথা বলেছেন। কিন্তু সেখানে ভারসাম্যের অভাব ছিল না, অতিকথন ছিল না, উচ্চকিত বারফাট্টাই ছিল না। অত্যন্ত শাণিত মেধা, বিশ্লেষণাত্বক মনন ও আধুনিক এক চলচ্চিত্রকারকে আমরা পেয়েছিলাম। যাঁর অধিকাংশ ছবি থেকে আমরা শিখে নিতে পারতাম প্রতিবাদের ভাষা, ভিন্নতর পরীক্ষামূলক ছবির বর্ণপরিচয়। প্রতিষ্ঠানের চোখে চোখ রেখে কীভাবে নিজের স্থানাঙ্ক চিহ্নিত করা যায়, তাও শিখতে পারতাম।

 

আজ সে অবকাশ আর রইল কই!

More Articles