৯ মাসে ৯টি সফর! কেন ঘন ঘন বিদেশযাত্রা ইউনূসের?

Muhammad Yunus : তথ্য বলছে, ৯ মাসে ৯টি সফর করেছেন ইউনূস। প্রথম সফর করেন নিউইয়র্ক-এ। সেখানে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবার জাপান যাচ্ছেন। ২৭ মে বুধবার থেকে তাঁর এই সফর ৪ দিনের। ইউনূসের জাপান সফর সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেছে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সফরকালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর সঙ্গে জাপান-বাংলাদেশ শীর্ষ বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন ইউনূস। এরপর নিক্কেই ফোরামের ৩০ তম 'এশিয়ার ভবিষ্যৎ' সেমিনারে যোগ দেবেন। বাংলাদেশের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, এই সফরে বাংলাদেশে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তা আসতে পারে। এর মধ্যে ২৫০ মিলিয়ন রেলখাতের উন্নয়নের জন্য। এছাড়াও সাতটি সমঝোতা পত্র ও চুক্তিও সই হতে পারে।

গত বছরের ৮ অগস্ট অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ৯ মাস অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় রয়েছেন তিনি। তথ্য বলছে, ৯ মাসে ৯টি সফর করেছেন ইউনূস। প্রথম সফর করেন নিউইয়র্ক-এ। সেখানে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন। এরপর আজারবেইজান সফর করেন, সেখানে কপ-২৯ সম্মেলনে যোগ দেন। এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় সফর। এছাড়াও আরও ৭টি দেশে সফরে যান তিনি। তার মধ্যে রয়েছে - ইজিপ্ট, সুইজারল্যান্ড, আরব, চিন, থাইল্যান্ড, কাতার, ভ্যাটিকান সিটি। দেখা যাক, কোথায়, কেন সফর করেছেন ইউনূস?

আমেরিকা

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকায় সফর করেন ইউনূস। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেবার পর তাঁর প্রথম সফর ছিল এটি। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইর্য়ক গিয়েছিলেন। এই সফরে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-সহ ১২টি দেশের সরকার-রাষ্ট্রপ্রধান ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের মাঝে ৪০ টি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেন। ২৪ সেপ্টেম্বর জো আইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীক বৈঠক করেন। নিউইয়র্কে থাকাকালীন চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্সো গ্র্যান্ডি, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গ ও ইউএসএইডের প্রশাসক সামান্থা পাওয়ার-এর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয় তাঁর।

বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের এমন বৈঠক বিরল ঘটনা! ফলস্বরূপ ইউনূসের আমেরিকার এই সফর বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের জায়গাটি ফিরে পেয়েছিল। অনেকেই বলেছিলেন, এটি ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আজারবাইজেন

২০২৪ সালের ১১ থেকে ১৪ নভেম্বর আজারবাইজেন সফর করেন ইউনূস। কপ ২৯ জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে আজারবাইজেন রাজধানী বাকুতে গিয়েছিলেন তিনি। এই সম্মেলনের বিভিন্ন ফোরামে তিনি বক্তব্য রাখেন এবং সেখানে অংশগ্রহণকারী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথেও তাঁর বৈঠক হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি তাঁর দ্বিতীয় সফর ছিল।

ইজিপ্ট

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে দুই দিনের সফরে মিশরের রাজধানী কায়রোতে গিয়েছিলেন ইউনূস। মিশরের পাবলিক বিজনেস সেক্টরের মন্ত্রী মোঃ সিমি কায়রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইউনূসকে স্বাগত জানান। এই মন্ত্রীর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বৈঠক হয় উপদেষ্টার। এছাড়াও এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, ইরান, পাকিস্তান তুরস্ক-সহ ৮ টি দেশের শীর্ষ নেতারা। এই সফরে ইউনূস কায়রোতে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণও দেন।

সুইজারল্যান্ড

২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ড সফরে যান ইউনূস।  তিনি সেখানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে (ডব্লিউইএফ)যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। এই সম্মেলনে তিনি ৪৭ টি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।

আরব

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরব সফর করেন ইউনূস। সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে (ডব্লিউজিএস) যোগদান করেছিলেন তিনি। আরব আমিরাতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুর রহমান বিন মোহাম্মদ আল ওয়াইস, বাণিজ্যমন্ত্রী থানি বিন আহমেদ আল জেয়োদি-সহ একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। সে দিন পারস্পরিক স্বার্থ জড়িয়ে থাকা এমন নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। যেমন- বাংলাদেশী নাগরিকদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, চট্টগ্রাম বন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং ক্রীড়া ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পর্ক আরও ভালো করা।

থাইল্যান্ড

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসেই থাইল্যান্ড সফর করেন ইউনূস। এখানে তিনি দু'দিনের সফরে গিয়েছিলেন। এই সফরে তিনি বিমসটেক ইয়ং জেনারেশন ফোরামে বক্তব্য দেন পাশাপাশি বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনেও বক্তব্য রাখেন তিনি। এই সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।

কাতার

২০২৫ সালের এপ্রিলে 'আর্থনা শীর্ষ সম্মেলন-২০২৫' - এ যোগ দিতে কাতার সফরে গিয়েছিলেন ইউনূস। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার বাংলাদেশের চারজন জাতীয় নারী ক্রীড়াবিদ প্রধান উপদেষ্টা সফরসঙ্গী হিসেবে কাতারে গিয়েছিলেন। এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল কাতারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা। সেখানে ব্যবসা ও জ্বালানি সহযোগিতার পাশাপাশি ভিসা উন্মুক্ত করার মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কাতারের কাছ থেকে এলএনজি আমদানি করে থাকে। এ নিয়ে দেশটির সঙ্গে চুক্তিও আছে। আর্থিক সংকট থাকায় আমদানি বিল নিয়মিত পরিশোধ করা যায়নি।

চিন

সম্প্রতি চিন সফরে গিয়েছিলেন তিনি। সে সময়ই দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি সমর্থনও জানিয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা এই সফরকে সফল বলে মনে করেছেন। এই সফরে বাংলাদেশে চিনের বিনিয়োগ, নদীর ব্যবস্থাপনা এবং রোহিঙ্গা সংকটের মতো বিষয়গুলিও আলোচনায় এসেছিল।

ভ্যাটিকান সিটি

২০২৫ সালের এপ্রিলে, চার দিনের জন্য রোম সফর করেন ইউনূস। পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ইউনূসের ফ্রান্স সফরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে ফ্রান্স ইউনূস-কে আমন্ত্রণ জানিয়েও অপমান করেছে বলে দাবি করেন ইউনূস। যদিও বিগত কয়েক বছর তিনি এই দেশেই অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তৃতীয় ওশেন কনফারেন্সে যোগদানের জন্য মুহাম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমুনায়েল ম্যঁক্রো। এই সফরকালে ম্যঁক্রো সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসতে চেয়েছিলেন ইউনূস। এতে প্যারিসের তরফে কোনরকম সারা পাওয়া যায়নি। এই পরিস্থিতিতে সফরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইউনূস।

প্র‍শ্ন উঠছে, এত ঘন ঘন বিদেশ সফরের কোনো প্রত্যক্ষ ফল কি বাংলাদেশ পেয়েছে? এই ব্যয়ভার সংকোচন করলেই কি বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে শুভ হতো না? ইন্টারনেট পরিকাঠামো থাকতে আজ কি সত্যি মুখোমুখি বৈঠক জরুরি? অভ্যন্তরীণ অশান্তি থেকে কি ইউনূস নজর ঘোরাতে চাইছেন?

More Articles