মুম্বইয়ের জমকে ব্রাত্য আরে অরণ্য, আদিবাসীদের দিন বদলের স্বপ্ন দেখান ক্যাসান্দ্রা
ক্রমবর্ধমান মুম্বই শহর কোথাও যেন এই আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবন এবং তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ক্রমশ গ্রাস করছে, ছিনিয়ে নিচ্ছে তাঁদের বাসভূমিও।
রবিন হুডের কাহিনি আমরা বোধহয় কমবেশি সবাই জানি। ইংল্যান্ডের লোক কাহিনির একজন কিংবদন্তী রবিন হুড, ধনীদের ঘরে লুটপাট চালিয়ে, তাদের সমস্ত অর্থ বিলিয়ে দিতেন নির্ধনদের মধ্যে। আজ বলব ক্যাসান্দ্রা নাজারেথের কথা। ক্যাসান্দ্রা বাস্তব জীবনের এমনই এক রবিন হুড এবং নিজ উদ্যোগে আরে অরণ্যে বসবাসকারী পরিবারগুলির জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। মুম্বইয়ের আরে অরণ্যে, গাছ বাঁচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে বছর কয়েক আগে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ক্যাসান্দ্রা নাজারেথ। সেইসময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আরে অরণ্যে বসবাসকারী বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির।
স্বপ্নের মতো উজ্জ্বল শহর মুম্বই থেকে খানিক দূরত্বে অবস্থিত, এই আরে বন্য অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের জীবনে তখনও দুরবস্থার করুণ ছায়া ঘনায়মান। অল্পকিছু জমিতে চাষাবাদ এবং হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমেই তাঁদের কোনও মতে দিন গুজরান হত। জীবন এবং জীবিকার ভরসা বলতে সেইসময় এইটুকুই সম্বল ছিল তাদের। আরে অঞ্চলের আদিবাসীদের এই করুণ পরিণতি দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি ক্যাসান্দ্রা। এরপরেই তিনি মনস্থির করেন, গ্রামগুলিতে বসবাসকারী ওরলি মহিলাদের জীবন উন্নত করার এবং খানিকটা হলেও তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলার। সমাজে অবহেলিত এই জাতিগোষ্ঠীগুলির জীবন পরিবর্তনের লড়াইতে অবশ্য তিনি একা মাঠে নামেননি। এই লড়াইয়ে তিনি পাশে পেয়েছিলেন, তাঁর আরও তিন সঙ্গীকে – ব্লাসিয়া পিন্টো, মহেশ বারিয়া এবং রিটা নিউনেস। বিগত ছয় বছর ধরে চারজনের এই দলটি তেরোটি আরে গ্রামের ২৫০০টি পরিবারকে এবং মধ্যদ্বীপের চারটি গ্রামের প্রায় ১২০০ পরিবারকে সাহায্য করে চলেছে।
তবে ক্যাসান্দ্রা যে শুধুই গ্রামগুলির আর্থিক অবস্থা পুনর্জীবিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। তাঁর কথায়, ক্রমবর্ধমান মুম্বই শহর কোথাও যেন এই আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবন এবং তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ক্রমশ গ্রাস করছে, ছিনিয়ে নিচ্ছে তাঁদের বাসভূমিও। তাই গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু ছোটো ছোটো উদ্যোগের মাধ্যমে ওরলি গ্রামের ব্যক্তিগত সংস্কৃতিকে রক্ষা করার চেষ্টাও করেছেন। এই উদ্যোগগুলির মধ্যেই একটি হল #TRibalLunch এবং অন্যটি হল #TRibalTadka। মুম্বইবাসীর সঙ্গে গ্রাম্যজীবনের পরিচয় ঘটানোর কথা মাথায় রেখেই এই দু’টি উদ্যোগ শুরু করেছিলেন ক্যাসান্দ্রা। #TRibalLunch এর মাধ্যমে মুম্বইকরদের আরে অরণ্যে আসতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এই উদ্যোগে যেমন শহরবাসীর সঙ্গে অরণ্যের নিবিড় এক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে, তেমনই আবার তাঁরা স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক আরবান অরণ্যে বসবাসকারী মহিলাদের রাঁধা গ্রাম্য ঐতিহ্যবাহী সব খাদ্যের।
আরও পড়ুন- ধ্বংস হচ্ছে পৃথিবীর ফুসফুস, সংশয়ে হাজার হাজার আদিবাসীর জীবন! নেপথ্যে কারা?
অন্যদিকে #TRibalTadka নির্মিত হয়েছে একেবারেই মহিলাদের আর্থিক উন্নতির কথা মাথায় রেখে। এই মডেলে গ্রামের মহিলারা, মুম্বইবাসীর কাছে বিভিন্ন খাদ্য, অর্গানিক আইটেম এবং হস্তশিল্প বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে থাকেন। এছাড়াও এই মডেলের দৌলতে কেউ চাইলে প্রায় মধ্য-অরণ্যে গ্রামের কুটিরে বসে টাটকা রাঁধা খাঁটি মহারাষ্ট্র পদও উপভোগ করতে পারেন। এই উদ্যোগগুলি কীভাবে ওরলি সম্প্রদায়কে উপকৃত করছে, সে সম্পর্কে মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণকারী ওরলি গ্রামের এক মহিলা সুরেখা বুদকুর বলেন, “ইয়ে জো হোতা থা, ওহ হামারে পরিবারকে লিয়ে বহুত আচ্ছা থা” অর্থাৎ, এই মধ্যাহ্নভোজন বা বেচাকেনা যা হত, তা তাঁদের পরিবারের জন্য খুবই ভালো ছিল। তিনি আরও জানান, খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে তাঁদের যা আয় হত, তা দিয়েই তাঁরা নিজেদের পরিবারের জন্য জল এবং খাবার কিনতে সক্ষম হয়েছেন এবং কখনও কখনও শখ মেটাতে নিজেদের জন্য কিছু শাড়িও কিনেছিলেন তাঁরা। সুরেখার কথায়, ক্যাসান্দ্রার আগে কেউ তাঁদের কথা একটিবারের জন্যও ভেবে দেখেননি। অর্থ উপার্জনের পাশাপাশিই বিদ্যুৎ এবং পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থাও করা হয়েছে গ্রামবাসীদের জন্য।
ক্যাসান্দ্রার দল কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি। ওরলি গ্রামবাসীদের জীবনে বিপ্লব এনেছে ক্যাসান্দ্রার দলের স্থাপন করা বায়ো টয়লেটগুলি। আরে এবং মধ্যদ্বীপের মোট আটটি গ্রামে তাঁরা পঁয়তাল্লিশটি বায়ো টয়লেট স্থাপন করেছেন এবং এই এক একটি বায়ো টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন গ্রামের আটটি পরিবার। ক্যাসান্দ্রা জানান, প্রতিটি বায়ো টয়লেট স্থাপন করতে তাঁদের খরচ হয়েছে ৫৫,০০০ টাকা। অরণ্যের মধ্যে গ্রামগুলির অবস্থান হওয়ার কারণে বায়ো টয়লেট স্থাপনের আগে প্রায়ই চিতাবাঘের হাতে গ্রামবাসীদের আহত এবং নিহত হওয়ার খবর শোনা যেত। প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আগে মহিলাদের গম ভাঙতে যেতে হত। এই সমস্যার সুরাহা করতে ক্যাসান্দ্রা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রায় এগারোটি ডোমেস্টিক গমকল গ্রামের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয়, #ProjectRoots প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের তরুণ তরুণীরা আজ অন্যান্য মানুষদের ওরলি আর্ট শেখানোর চেষ্টা করছে এবং ক্রাউড ফান্ডিং ও সরকারি সহায়তার মাধ্যমে গ্রামের উন্নয়নের জন্য আট হাজার টাকা মূল্যের মোট ২৩ টি সেলাই মেশিন এবং ২৫০০ টি পরিবারকে স্টোভ কিনে দিতেও সক্ষম হয়েছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন- চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দি মানুষ! কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী ওটা বেঙ্গার কাহিনি সভ্যতার লজ্জা
গ্রামের মহিলাদের সুস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে তিনি #SurekhaMenstrualCupProject নামে আরও একটি উদ্যোগ নিয়েছেন, যেখানে গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রায় ৩৫০ টি মেন্সট্রুয়াল কাপ বিলি করা হয়েছে। ক্যাসান্দ্রার দলের এই উদ্যোগগুলি যে কেবল গ্রামের মহিলাদেরই আত্মনির্ভর হতে সক্ষম করেছে তা নয়। আজ মুম্বই শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও, গ্রামবাসীদের প্রত্যেকের জীবনেই আধুনিকতার কিছু ছাপ অন্তত লক্ষ্য করা যায়। এখন গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষেরই আধার কার্ড রয়েছে, রয়েছে ব্যাঙ্কে নিজস্ব অ্যাকাউন্টও যা ক্যাসান্দ্রা আসার আগে ওরলি গ্রামের মানুষের কাছে হয়তো কেবল অধরা এক স্বপ্ন মাত্রই ছিল।