শান্তিকামী ইমাম আর উত্তেজিত আসানসোল | শিল্পাঞ্চলের রামনবমীর ইতিহাস

Ram Navami 2025: আসানসোল যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তে অবস্থিত তাই বরাকর নদী পেরিয়ে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের হিন্দীভাষী সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের এক জীবন্ত সংযোগ থেকেই গেছে।

আবার এক রামনবমী, আবার মেরুদণ্ডে আতঙ্কের শীতল স্রোত। প্রতিবার রামনবমী এলেই মনে পড়ে যায় ২০১৮ সালের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা। সেই ক্ষত এত গভীর যে আজও, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংক্রান্ত যে কোনও প্রতর্কে আসানসোলের নাম নিশ্চিতভাবে জায়গা পায়। সেবার রামনবমী পড়েছিল ২৫ মার্চ। কয়েকদিন আগে থেকে দেখছিলাম, অবাঙালি হিন্দিভাষী এলাকাগুলোতে পতাকার ছড়াছড়ি, হনুমান চিত্রিত বাইকের দাপাদাপি। সত্যি কথা বলতে, যে শহরে জন্ম থেকে আমার বড় হয়ে ওঠা, যে শহর জানে আমার সবকিছু, তাকে কেমন অচেনা মনে হচ্ছিল। রামনবমীর দিনটা শান্তিতেই কেটেছিল। পরে জেনেছিলাম, কৌশল করেই কিছু মন্দির কমিটি থানায় মিছিলের অনুমতি চায়নি। ২৬ তারিখে পুলিশের সামনেই মিছিল বেরোল। সশস্ত্র, ডিজেতে প্ররোচনামূলক গানের উচ্চনাদ। সন্ধ্যাবেলায় খবর এল রেলপাড়, ঝিঙরিমহল্লা, কসাইমহল্লা, ধাদকা— যেখানে ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু ও মুসলিম অবাঙালি গরিব মানুষের বসতি— উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে উঠেছে। মিছিলগুলোর যাত্রাপথে মসজিদ থাকলে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। ২৭ মার্চ ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দুর্গাপুর থেকে আনার দিন। সকালবেলা বাসে করে আসানসোল থেকে দুর্গাপুর যেতে গিয়ে দেখলাম, রাস্তা তুলনামূলক ফাঁকা। কোনওরকমে খাতা নিয়ে আসানসোলে ফেরত আসতেই দেখলাম বাসস্ট্যান্ডে আগুন, পুলিশের গাড়ি, হাতে কাঁদানে গ্যাস ও বন্দুক নিয়ে রিজার্ভ ফোর্সের দৌড়াদৌড়ি। ইতিমধ্যে ছেলের ফোন! আমাদের বাড়ি যেহেতু গণ্ডগোলের এলাকার ঠিক পাশে, তাই সেখানকার বাসিন্দারা মোটামুটি ক্লাবগুলোর সৌজন্যে জমায়েত শুরু করে দিয়েছে। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, দুইশত বছরের পুরনো নুরানি মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমাদুল্লা রশিদির ষোল বছরের সন্তান খুন হয়েছে। সেই অন্ধকার সময়ে রশিদি সাহেবের অহিংসা ও শান্তির পক্ষে অবিস্মরণীয় সওয়াল আজ ইতিহাস। মনে আছে, ঘটনার ৫ দিন পরে দেশের বিশিষ্ট সমাজকর্মী হর্ষ মান্দারকে সঙ্গে নিয়ে আমরা কয়েকজন যখন দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলোতে যাই, তখন রশিদি সাহেব পরম মমতায় আমাদের বলেছিলেন ভালোবাসার শক্তির কথা। ডিপোপাড়ার এক মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল যিনি অসীম সাহসে সেখানকার মুসলমান বাড়িগুলোকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু আজও যে প্রশ্নটা তাড়িয়ে বেড়ায় তা হলো, যে শহরের প্রবেশপথে আমরা গর্বের সঙ্গে লিখে রেখেছি 'সিটি অব ব্রাদারহুড', তা এতটা পাল্টে গেল কেমন করে! আজ আরেকটা রাম নবমীর সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা খুব জরুরি হয়ে ওঠে।

ইমাম মৌলানা ইমাদুল্লা রশিদি

আরও পড়ুন- রামনবমী ঘিরে দাঙ্গা পরিস্থিতি, ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ফিরে ফিরে এসেছে

সাধারণভাবে একথার সঙ্গে আমার কোনও দ্বিমত নেই যে রামনবমী কোনওভাবেই বঙ্গ সংস্কৃতির অংশ নয়। এটা উত্তর ভারত থেকে আমদানি করা 'খোট্টা' ধর্মীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন। কিন্তু রাজ্যের দু'টি শিল্পাঞ্চল— নৈহাটি-ব্যারাকপুর-জগদ্দল-টিটাগড়ে পাটকলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল এবং কয়লা-ইস্পাত ও রেলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রানিগঞ্জ, আসানসোল ও বার্নপুর যাকে আমরা এক কথায় বৃহত্তর আসানসোল বলে জানি— এই বহিরাগত সংস্কৃতির প্রশ্নটা এই দুটো অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আমাদের অঞ্চলের আর্থ- সামাজিক ইতিহাসের মধ্যেই অনেক প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।

শিল্প সভ্যতার চালিকাশক্তি কয়লা। এই কয়লাকে ঘিরে আসানসোলের গল্প শুরু। কয়লার গুরুত্ব উপলব্ধি করেই ঔপনিবেশিক পর্ব থেকে এখানে বেসরকারি উদ্যোগে কয়লা খনন শুরু হয়। কার অ্যান্ড টেগোর, বীরভূম কোল সহ একাধিক কোম্পানির কাজ শুরু হয়।আসানসোল ছিল মূলত নিম্নবর্গের মানুষের জনপদ। এছাড়া ছিল আগুরি সম্প্রদায়। কয়লা খননের ইতিহাস বলছে, এই সব জনগোষ্ঠীর মানুষরা খনির নিচে নেমে কয়লা কাটতে আগ্রহী ছিল না। তখন স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকের চাহিদা মেটাতে উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও মধ্যপ্রদেশ থেকে হিন্দিভাষী মানুষরা দলে দলে এই অঞ্চলে বসত শুরু করে। উর্দুভাষী মুসলমানদের আসাও এই সময়ে শুরু হয়। এই কয়লাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনেক দূরে দূরে অবস্থিত কোলিয়ারিগুলোর কোয়ার্টার (স্থানীয় ভাষায় ধাওড়া) নজর করলেই দেখা যাবে, অজস্র পাড়া যেখানে ঐতিহাসিকভাবেই এই মানুষেরা তাঁদের ধর্মীয় সংস্কৃতি নিয়ে, পুরুষোত্তম রাম ও তাঁর ভক্ত হনুমানের কথা নিয়ে বেঁচে থাকেন। সমস্যা হলো, আমাদের অজানা আসানসোল কীভাবে বেঁচে থাকে সে নিয়ে আমাদের ধারণা ছিল সামান্য। একই কথা বার্নপুরের ইস্পাত কারখানা বা রেলের অবাঙালিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মুসলমানদের ক্ষেত্রেও গল্পটা আলাদা কিছু নয়। ভারতের যে কোনও বড় শহরের মতো এখানেও তারা 'ঘেটো'-র বাসিন্দা। আসানসোল ও বার্নপুর, দু'জায়গাতেই তারা শহরের প্রান্তে থাকে, আমাদের অনেকের ভাষায় মহল্লা, মধ্যবিত্ত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের ভাষায় 'মিনি পাকিস্তান'। এরা 'অপর' যাদের ভাবনা, সংস্কৃতি, চিন্তা, চেতনা থেকে আমরা, যারা শহরের স্বঘোষিত প্রধান তাদের অবস্থান আলোকবর্ষ দূরে।

এই অবাঙালি মানুষেরা সত্যি কথা বলতে, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ বাদ দিলে, আসানসোলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মানচিত্রে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত ছিল। এরা বিভিন্ন সময়ে শাসকদলকে ভোট দিয়েছে, চাকরি করেছে কিন্তু একইসঙ্গে নিজেদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে সংরক্ষণ করেছে। আবার আসানসোল যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তে অবস্থিত তাই বরাকর নদী পেরিয়ে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের হিন্দীভাষী সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের এক জীবন্ত সংযোগ থেকেই গেছে। তাই মাত্রার তারতম্য থাকলেও এই বিস্তৃত শিল্পাঞ্চলে রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী, ছটপুজো পালিত হয়ে এসেছে। এই অবাঙালিরা (হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) যে কোনও একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে পারে তার প্রমাণ আমি প্রথম দেখি ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধি হত্যার পর শিখ দাঙ্গায়। পশ্চিমবঙ্গে যে কয়েকটি জায়গায় শিখনিধন ও শিখদের উপর আক্রমণ হয়েছিল, তার মধ্যে একটি আসানসোল। এছাড়া শিল্প শহর হওয়ার কারণে এখানে রাজনৈতিক নেতাদের সৌজন্যে এক ধরনের মাফিয়ারাজ বহু যুগ থেকেই চলে যারা কিন্তু এই ধরনের দাঙ্গা- হাঙ্গামার আগুনকে ছড়িয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত।

আরও পড়ুন- বাউরি, কোড়া, সাঁওতালদের মধ্যেও উগ্র হিন্দুত্ব কীভাবে জাগাচ্ছে বিজেপি?

আজ আমরা যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাপূর্ণ আসানসোলকে নিয়ে আলোচনা করছি, তার শুরু রামমন্দিরের দাবিতে আদবানির রথযাত্রাকে ঘিরে। সেইসময় আমাদের স্বকল্পিত প্রগতিশীলতার তলপেটে লাথি মেরে রাজ্যের বহু জায়গা থেকে রামের নাম লেখা ইঁট অযোধ্যায় পাঠানো শুরু হয়। এক্ষেত্রে আসানসোলের নাম ছিল শীর্ষে। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে এক ধরনের হিন্দু ব্লক ভোট তৈরি হচ্ছে। এখানে একটা কথার উল্লেখ জরুরি। আমরা বলি যে, শ্রমিকরা যেহেতু তাদের সর্বহারা শ্রেণি অবস্থানের কারণে সমাজের সবচেয়ে অগ্রণী অংশ তাই তারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলে। কিন্তু ৯০ পরবর্তী ভারতের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, মুম্বই, আমেদাবাদ, বরোদা হোক বা এ রাজ্যের নৈহাটি, ব্যারাকপুর, আসানসোল — দাঙ্গা কবলিত এলাকায় শ্রমিকরা নিজেরাই হাঙ্গামায় অংশ নিচ্ছে। এর মূল কারণ, পেশাগতভাবে শ্রমিক হলেও এদের মধ্যে সর্বহারা মতাদর্শ, শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি বিস্তারের ব্যর্থতা, শ্রমিকদের একটা বড় অংশকে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের দিকে নিয়ে গেছে। এই ব্যর্থতার দায় সমস্ত ধরনের বামপন্থী শক্তিকে নিতেই হবে।

২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পরিবর্তনের সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ধর্মীয় অনুষঙ্গে রাজনীতির কথকতা আরও বৃদ্ধি পায়। এর দুটো দিক আছে। একদিকে, দেশজুড়ে গেরুয়া শিবিরের উত্থান, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির রাজ্যাভিষেক এ রাজ্যে, বিশেষ করে আসানসোলে বিজেপির রাজনীতির জমি প্রস্তুত করে। অন্যদিকে, রক্ষাকবচের আশায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তৃণমূলে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করে। এই পরিবর্তিত অবস্থা আসানসোলের রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে পরিবর্তন ঘটায়। এই বাস্তবতার প্রতিফলন হলো একাধিক জনপ্রতিনিধি অবাঙালি সম্প্রদায় থেকে নির্বাচিত। এই মেরুকরণের রাজনীতির বিস্তারে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখাগুলোর নিরন্তর অনুশীলন একটা উল্লেখযোগ্য দিক।

আজ প্রকৃত অর্থে আসানসোল এক আগ্নেয়গিরির উপর দাঁড়িয়ে আছে। বাঙালি-অবাঙালি নয়, আজ মেরুকরণ হচ্ছে ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে। তাই ধর্মীয় উৎসব আজ আনন্দ নয়,আতঙ্কের বার্তা বয়ে আনছে। আজ দুটো আসানসোল দাঁড়িয়ে আছে। একটা রবীন্দ্রভবন কেন্দ্রীক সুললিত, শ্যামা-চিত্রাঙ্গদা, গ্রুপ থিয়েটার, লিটল ম্যাগ শোভিত মুষ্টিমেয় সংস্কৃতিবানের পিকচার পারফেক্ট আসানসোল। অন্যদিকে, ধর্ম পরিচিতির মোড়কে হিংসাদীর্ণ, মেরুকৃত আসানসোল, সিটি অব ব্রাদারহুডের পোস্টার যেখানে নেহাতই এক উপহাস! সময় দাবি করছে নাগরিক সক্রিয়তা, সেই আশায় দিন গোনা জারি থাকুক।

More Articles