কত সিবগাতুল্লার মৃত্যু হলে বাঙালির রামনবমী পালন পূর্ণতা পাবে?

Ram Navami 2025: কেন মমতা বললেন, তাঁদের দলের পক্ষ থেকেও রামনবমী পালন করা হবে এবং ওইদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হবে? কে বা কারা এই নরম হিন্দুত্বের মন্ত্র তাঁর কানে ঢেলেছিল?

রামনবমী নিয়ে এখন সাধারণ বাঙালির অভিব্যক্তি ভয়ের, অস্বীকার করে উপায় নেই। সাধারণ বাঙালির মধ্যে আছেন হিন্দুরা, মুসলমানরাও। সকলেই আতঙ্কে। সবার কাছে এটুকু পরিষ্কার যে, এবছর রামনবমীকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা আবার ধর্মীয় উন্মাদনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। এর কারণ সামনের বছর এই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। গতবছর এই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়, বিক্ষিপ্ত গণ্ডগোল হয়েছিল রামনবমীকে কেন্দ্র করে। ২০২৩ সালেও হয়েছিল। প্রতি বছরই রামের জন্মকে কেন্দ্র করে হিন্দুত্ববাদী শক্তির এই আস্ফালন শঙ্কিত করছে সাধারণ বাঙালিকে, যারা রাম বলতে বুঝতেন কৃত্তিবাসী রামায়ণের চরিত্রকে। এই বাঙালির কাছে অন্য অনেক দেবতার অস্তিত্ব থাকলেও রামের এমন আধিপত্য ছিল না। অকালবোধনের সময়ে শরৎকালে, রামের দুর্গাপুজোর কথা শোনা যেত এতদিন কিন্তু রামের জন্মদিন পালন নিয়ে এই উন্মাদনা বাঙালি আগে দেখেনি, যা গত কয়েকবছরে দেখছে।

৮০-র দশক থেকে বাবরি মসজিদের স্থানে, ‘মন্দির ওঁহি বানায়েঙ্গে’ দিয়ে যাঁদের উত্থান, তারা ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরে রামের জন্মদিন ঘটা করে পালন করবেন সেটাই স্বাভাবিক। এই রাজ্যেও এবছর বিশাল আকারে তা পালিত হওয়ার যথেষ্ট আভাস পাওয়া গেছে। রাজ্যজুড়ে ‘রামনবমী পালন করুন’ পোস্টার পড়েছে। শ্রীরামচন্দ্রের তির-ধনুক হাতে ছবির পাশেই নরেন্দ্র মোদি, তাঁর পাশেই শুভেন্দু অধিকারী। কোনও রাজনৈতিক দল কি ভারতে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে বলতে পারে? ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান নিশ্চিত কেউ ভুলে যাননি। ১৮০০ কোটি টাকা খরচ করে, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী— ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে, চোখ-ধাঁধানো তারকা সমাবেশে যে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা, তাতে বাঙালির ঘরে ঘরে ভক্তির যে গণউন্মাদনা দেখা গিয়েছিল, তা নিশ্চিত কেউ ভুলে যাননি। দলে দলে মানুষজন সেই সময়ে রামমন্দির দর্শনে গিয়েছিলেন, পাড়ায় পাড়ায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এমন বিনিয়োগ থেকে ভোটে ২০২৪ সালে সেইরকম সুবিধা না পাওয়া গেলেও, এবারের রামনবমীকে ধরে আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে বাংলায় লভ্যাংশ তোলার জন্যেই যে এত আয়োজন তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

২০১৬ সাল থেকেই বাংলায় রামনবমীর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। সঙ্ঘ পরিবারের নেতৃত্বে বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও হিন্দু জাগরণ মঞ্চ সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল নিজেদের কাঁধে। কর্মযজ্ঞ কীভাবে হবে, কারা অংশ নেবেন রামনবমীর মিছিলে— সবটাই ঠিক করেছিল সঙ্ঘ পরিবার। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে দিলীপ ঘোষ সহ বেশ কিছু নেতারা বলে দিয়েছিলেন, সেবার রামনবমী পালিত হবে চোখ ধাঁধানো উপায়ে। সত্যিই, মাথায় গৈরিক ফেট্টি বাঁধা মূলত হিন্দিভাষী অবাঙালি ভক্তবাহিনীর ধুন্ধুমার সে বার বিস্মিত করেছিল রাজ্যবাসীকে। সঙ্গে ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রামনবমী পালনে বাধাদানের অভিযোগ। হিন্দু হয়ে তিনি কী করে রামনবমীর মতো একটি অনুষ্ঠান তিনি বন্ধ করছেন এই প্রশ্নে হিন্দুদের আক্রমণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে সামাজিক মাধ্যমে
চূড়ান্ত আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি সেই আক্রমণে মদত দিয়েছিল। সঙ্গে অবশ্যই ছিল, সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ। আরএসএসের হিন্দুত্বের কার্যক্রম যদিও এই রাজ্যে বহু পুরনো এবং বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সহ সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই সংগঠনগুলোও নতুন নয়। তবুও যতদিন এই রাজ্যে বিজেপি ভোটে সম্মানজনক ভোট পায়নি ততদিন এইভাবে মহাড়ম্বরে রামনবমী পালিত হয়নি।

আরও পড়ুন- রামনবমী ঘিরে দাঙ্গা পরিস্থিতি, ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ফিরে ফিরে এসেছে

২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপির সরকার আসা এবং পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী হিসেবে বিজেপির ভোট এবং সম্মানবৃদ্ধি (২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ১০ শতাংশ ভোট, যা ২০১১-র থেকে ৫ শতাংশ বেশি) এবং জাতীয় নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরাট শক্তিবৃদ্ধির (২০১৯ সালে চমকে দেওয়া ৪০ শতাংশ ভোট এবং ১৮জন সাংসদ নির্বাচিত হওয়া) সঙ্গে অনায়াসে পাশাপাশি বসানো যায় রামনবমী উদযাপনের অস্ত্র ঝনঝনানি এবং ডিজে বক্সের হিন্দি গানের আওয়াজের ঊর্ধ্বমুখী শব্দকে। ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং তার পর ২০২৩, ২০২৪— বছরগুলিতে আমরা দেখেছি অস্ত্রধারী অবাঙালি রামভক্তদের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব, সংখ্যালঘু অঞ্চলে দাঙ্গা পরিস্থিতি। 

এইরকমেরই একটি দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন, আসানসোলের ইমাম ইমদাদুল রশিদির সন্তান সিবগাতুল্লা, সেই কথা আমরা নিশ্চিত ভুলে যাইনি। সেই আসানসোলের বিজেপির হয়ে জেতা সাংসদের তৃণমূলে ফিরে এসে মন্ত্রী হয়ে যাওয়াও আমরা ভুলে যাইনি। তারপরে সেই আসানসোলেই আরেক অবাঙালিকে তৃণমূলের সাংসদ করার কথাও আমাদের মনে আছে। প্রাথমিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা রামনবমী নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, তাতে যদি স্থির থাকা যেত, তাহলে বোধহয় রামনবমীর এই আস্ফালনকে প্রশাসনিকভাবে আটকানো যেত। মমতা বলেছিলেন, বাঙালিরা কোনওদিন রামনবমী উদযাপন করেনি। বাঙালির ঘরের পুজো ছিল অন্নপূর্ণা পুজো, বাসন্তী পুজো— তাও তা
সার্বজনীন নয়। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে সরে এসে কেন মমতা বললেন, তাঁদের দলের পক্ষ থেকেও রামনবমী পালন করা হবে এবং ওইদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হবে? কে বা কারা এই নরম হিন্দুত্বের মন্ত্র তাঁর কানে ঢেলেছিল? এর নেপথ্যেও কি সঙ্ঘ পরিবারের পরোক্ষ মদত ছিল? যেদিন থেকে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং রামনবমী পালন আমাদের রাজ্য সরকারি মদত পেল, সেদিন থেকেই ভুলের সূত্রপাত এবং সেই ভুলের খেসারত সারা বাংলার মানুষকে দিতে হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। শুধু রামনবমী কেন, হনুমান জয়ন্তী এবং গণেশপুজোর বাড়াবাড়িও সরকারের বদান্যতাতেই বেড়েছে। আরও কত সিবগাতুল্লার প্রাণ আগামীতে এই কারণে যেতে পারে, তা স্বয়ং রামচন্দ্রেরও অজানা!

আরও পড়ুন- বাউরি, কোড়া, সাঁওতালদের মধ্যেও উগ্র হিন্দুত্ব কীভাবে জাগাচ্ছে বিজেপি?

এবারের বাংলা যে রামনবমীকে কেন্দ্র করে উত্তাল হবে তা বলাই বাহুল্য। কয়েকমাস আগেই আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বাংলায় দশদিন কাটিয়ে গেছেন। উলুবেড়িয়াতে বিজেপি এবং আরএসএস তাদের সমন্বয় বৈঠক করেছে। মিডিয়া, ইউটিউবারদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এবারের রামনবমীকে ঘিরে কী কী প্রচার করা হবে, তার পরিকল্পনা হয়েছে। বহু দশক ধরেই বাংলায় জনসংখ্যার চরিত্রের বদল ঘটেছে। গত দশ বছরে সারা দেশ জুড়েই উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার বেড়েছে। তাতে বাংলায় এই সংস্কৃতি প্রবেশ না করলেই অবাক হতে হতো অবশ্য।

২০১৮ পরবর্তীতে বেশ কিছু মানুষ রামনবমী সংক্রান্ত হিংসার খোঁজখবর নিয়ে, আক্রান্ত মানুষদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যে, কী প্রক্রিয়ায় রামনবমীকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত করা জয়েছে মানুষকে। রামনবমীর আগে থেকেই উস্কানিমূলক মন্তব্য শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের তরফে। যত রামনবমী এগোতে থাকে, বাড়তে থাকে উস্কানি। তারপর রামনবমীর দিন মিছিল বের করা হয়, ডিজে বাজানো হয় তারস্বরে। এই উদযাপনের কেন্দ্র হয়ে থাকে পথপ্রান্তে বিভিন্ন মসজিদ। একটু খতিয়ে দেখলেই জানা যাবে, যাঁরা এই হিংসায় জড়ান মূলত অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত শ্রেণি, বেকার হিন্দিভাষী ও বাঙালি যুবক, যাদের জন্য কোনও সরকারই কিছু করেনি। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকেও বেশ কিছু যুবককে আনা হয়। মহিলাদের উপস্থিতি থাকে নগণ্য। প্রতিবেদন বলছে, সেই মিছিলের মধ্যে থেকেই কেউ বা কারা মিছিলেরই যুবকদের উদ্দেশ্যে পাথর ছোড়ে। দাবি করা হয়, মসজিদ থেকে ঢিল এসেছে কিন্তু প্রতিবেদনের অনুসন্ধানকারীরা তেমন প্রবণতার কথা জানতে পারেননি। এরপরই হিংসা, যাতে মূলত গরিব মানুষের ঘরই ভাঙচুর হয়, আগুন জ্বলে, মানুষ মারা যায়।

সচেতন হলে, সাবধান হলে, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সঙ্ঘবদ্ধভাবে হিন্দু-মুসলমান যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে, এই পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়া যায়। নরম হিন্দুত্ব দিয়ে উগ্র হিন্দুত্ব রোখার কৌশল কাজ করে না, মনে রাখতে হবে। প্রশাসনের একটা অংশে আরএসএস-বিজেপির প্রভাব বেড়েছে, অন্যদিকে বেকারত্ব বেড়েছে। সেই কারণেই রামনবমী পালনের হুজুগও বেড়েছে। এবার বাংলার প্রশাসন বলেছে, রামনবমীর মিছিল আইন বহির্ভূত কাজ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিজেপির শরণে থাকা মিডিয়াতে সরকারকে হিন্দুবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়ার কাজও চলবে সমানভাবে।

আরও পড়ুন- হিন্দু-মুসলিম, শ্মশান-কবর, রামমন্দিরেই আটকে গেল ভারতবর্ষ

সাধারণ বাঙালির আরাধ্য দেবতার তালিকায় দুর্গা থেকে ষষ্ঠী, শীতলা থেকে মনসার বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি, উত্তরভারতে শুধুই রাম প্রধান। যে রামকে সাধারণ বাঙালি চিনত, তার মধ্যে পৌরুষের আস্ফালন নেই, আছে কোমলতা। রাগী হনুমানের যে ছবি ইদানীং দেখা যাচ্ছে, তাও সাধারণ বাঙালি আগে দেখেনি। আসলে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের দৌলতে হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যই আজ প্রশ্নের মুখে। আসলে, দেশভাগের কারণে সাধারণ বাঙালির মধ্যে এমনিতেই একটা সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা আছে, সেই আগুনে ঘৃতাহুতি পড়েছে রামনবমীর দৌলতে। হিন্দুধর্মের আধিপত্যের এই চেহারা শুধু হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যে সংকট নয়, বাঙালির সত্তা বদলেরও সংকট, বাঙালির সংস্কৃতি বদলেরও ভাষ্য। বাঙালিদের একটা অংশ মানসিকভাবে এখনও ঔপনিবেশিক, একটা সময়ে তাদের আদর্শ ছিল ইংরেজরা। এখন সেই অংশই খুব দ্রুত 'ভারতীয়' হয়ে উঠতে চাইছেন বলেই কি নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে বর্জন করে উত্তর ভারতের রামকে আপন করে নিতে চাইছে?

১৯৭৮ সালে, একটি নব্য-নাৎসি গোষ্ঠী শিকাগোর শহরতলির স্কোকিতে ইহুদি-প্রধান এলাকা দিয়ে মিছিল করার চেষ্টা করে। তাদের হাতে ছিল "আমরা আসছি" লেখা প্ল্যাকার্ড এবং হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের অধ্যুষিত এলাকায় স্বস্তিক চিহ্ন উত্তোলন। মিছিলটি শেষ পর্যন্ত সেই শহরতলিতে হয়নি, শিকাগোতে হয়েছিল। তবে এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়, সংবেদনশীল এলাকায় ইচ্ছাকৃতভাবে পরিচালিত এই ধরনের উস্কানিমূলক মিছিল ২০১৭ সালের আবিষ্কার নয়; এগুলি ঘৃণার এক পুরনো বিশ্বব্যাপী খেলার বইয়ের অংশ, যার অংশ এখন আমাদের দেশ এবং রাজ্য।

More Articles