"কারও চাকরি যাবে না": এসএসসি-র চাকরিহারাদের উদ্দেশে যা বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

Mamata Banerjee on SSC: সিপিএমকে আক্রমণ মমতা বলেন, ‘‘আমি অনেক কথা জেনেও সিপিএমের কারও কোনও চাকরি খাইনি। বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কেন মামলা করলেন?"

প্রায় ২৬ হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। স্বামী স্ত্রীর চাকরি গেছে একসঙ্গে, বাকি পড়ে আছে ইএমআইয়ের টাকা, সন্তানকে বড় করবেন কীভাবে, বাবা-মায়ের চিকিৎসা করাবেন কীভাবে, বাঁচবেন কীভাবে, কী খাবেন এই চিন্তায় রাজ্যের প্রায় ২৬০০০ মানুষের ঘুম উড়ে গেছে। শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে, সমাজের চোখে সম্মানটুকুও হারিয়েছেন তাঁরা। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, রাজ্যে চরম দুর্নীতি হয়েছে। এমনই দুর্নীতি যে যোগ্য-অযোগ্য প্রার্থী বাছতে না পেরে পুরো প্যানেল বাতিল করতে হয়েছে। আর চাকরিহারা এসএসসির সেই সমস্ত প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “ভুল করা অধিকার, ভুল শোধরানোর সুযোগ দিন।" শাসকের সহজতম উত্তর তিনি দিয়েছেন। স্বীকারও করেছেন ভুল হয়েছে, আবার সংশোধনের রাস্তাও চেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি বিরোধীদের উপর দায় চাপিয়ে কতদূর পর্যন্ত কান্না দমিয়ে রাখতে পারবেন? নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের বৈঠকজুড়ে কখনও বিজেপি, কখনও সিপিএমকেই আক্রমণ করে গেলেন মমতা। আশ্বাসও দিলেন, কারও চাকরি যাবে না। তিনি সুপ্রিম কোর্টে রায়ের ব্যাখ্যা চাইবেন। নেতিবাচক উত্তর এলে তিনি যোগ্য চাকরিহারাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবেন। সুপ্রিম কোর্ট যেখানে আবারও নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছে, সেখানে তিনি প্রায় ২৬০০০ মানুষের জন্য ঠিক কোন দুর্নীতিমুক্ত বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবেন? তা স্পষ্ট করেননি।

নেতাজি ইন্ডোরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে চাকরিহারারা নিজেদের বেশ কয়েকটি দাবি জানান। তাঁদের দাবি—

১। সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন দিতে হবে। পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
২। পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কাউকে চাকরি থেকে বরখাস্তের চিঠি দেওয়া যাবে না।
৩। যে বিচারপতি রায় দিয়েছেন, তাঁর বেঞ্চে রিভিউ পিটিশন দাখিল করা যাবে না।
৪। পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেখানে চাকরি করছেন তাঁরা, সেখানেই তাঁদের বহাল রাখতে হবে।
৫। এই সময়ের মধ্যে নতুন করে পরীক্ষার কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করা যাবে না। পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে যেতে চাইছেন না চাকরিহারারা।
৬। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে, সিবিআইয়ের নথিতে যোগ্য এবং অযোগ্যের ভাগাভাগি রয়েছে। যোগ্যদের পরিচ্ছন্ন তালিকা নিয়ে রিভিউ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
৭। চাকরিহারাদের একজন দক্ষ আইনজীবীর ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

আরও পড়ুন- ২৬ হাজার চাকরি বাতিলই! বিধানসভা নির্বাচনে অশনি সংকেত হবে শিক্ষকদের কান্না?

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, যত দিন না সরকারের কাছ থেকে চাকরি থেকে বরখাস্তের নোটিশ পাচ্ছেন, তত দিন স্কুলে গিয়ে চাকরিহারারা স্বেচ্ছা পরিষেবা দিতেই পারেন। আদালতের নির্দেশ না মেনে স্বেচ্ছায় পড়িয়ে আবার চাকরি ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা কি পাবেন এই স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষকরা? এই অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে কোন মানসিকতা থেকে তাঁরা সুস্থ-শান্তভাবে পড়াতে পারবেন? এর উত্তর অবশ্য নেই। মমতা আরও বলেছেন, ‘‘আগে যোগ্যদের বিষয়টি মিটে যাক। তার পর যাদের ‘অযোগ্য’ বলা হচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কী কী তথ্য আছে আমি দেখব। আবার আপনাদের ডাকব। সত্যি যদি তাঁরা ‘অযোগ্য’ বলে প্রমাণিত হন, আমার তখন কিছু করার থাকবে না। কিন্তু কাকে কেন অযোগ্য বলা হয়েছে, কে তদন্ত করেছে, আলাদা করে সেটা দেখতে হবে। আলাদা করে সেটা নিয়ে আমি কথা বলব। সকলে নিশ্চিন্তে থাকুন। যোগ্য-অযোগ্যের মধ্যে গোলমাল লাগাবেন না। নিশ্চিন্ত ভাবে আপনারা শিক্ষা দিন, শিক্ষিত করুন।’’

এদিকে, শীর্ষ আদালত জানিয়েছে যাঁদের চাকরি পাওয়ার ন্যায্যতা নিয়ে সন্দেহের যাবতীয় উপাদান মজুত রয়েছে তাঁদের চার বছরের বেতনের টাকা ফেরত দিতে হবে। জানা যাচ্ছে, এখনও অবধি এই সন্দেহের তালিকায় থাকা প্রার্থীদের সংখ্যা ৫,৪০০ জনের মতো। এরা কীভাবে চাকরি পেলেন? মূলত

১) প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর চাকরি পেয়েছেন,
২) তালিকা বহির্ভূত প্রার্থী হয়েও চাকরি পেয়েছেন,
৩) সিবিআইয়ের উদ্ধার করা ওএমআর শিটে এদের নম্বর বাড়ানো হয়েছে

আরও পড়ুন- সন্দেহভাজন প্রার্থীদের তালিকা থাকা সত্ত্বেও কেন যোগ্য-অযোগ্যদের আলাদা করা গেল না?

অথচ ওএমআর শিট মেলানো যায়নি কারণ রাজ্য সরকারের স্কুল সার্ভিস কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও উত্তরপত্রের কোনও হার্ডকপি নিজেদের কাছে রাখেনি। ওএমআর শিটের মিরর ইমেজ বা ট্রেসিংও এসএসসির সার্ভারে পাওয়া যায়নি। সিবিআই গাজিয়াবাদে নাইসার এক আধিকারিকের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে কিছু মিরর ইমেজ। সেখানে জানা যায়, ০ পাওয়া প্রার্থীর নম্বর বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৩! অধিকাংশ দুর্নীতির নির্দিষ্ট পরিসংখ্যানই পাওয়া যায়নি। তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অযোগ্য খুঁজবেন কীভাবে? আবারও তদন্ত? মমতা আশ্বাস দিয়েছেন, ‘‘যাঁরা যোগ্য, তাঁদের চাকরি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।’’ দুর্নীতি রোধের দায়িত্ব কি সরকারের ছিল না?

নেতাজি ইন্ডোর থেকে আবারও বিজেপি আর সিপিএমকেই চাকরি দুর্নীতির নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন মমতা। সিপিএমকে আক্রমণ মমতা বলেন, ‘‘আমি অনেক কথা জেনেও সিপিএমের কারও কোনও চাকরি খাইনি। বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কেন মামলা করলেন? উত্তর দিতে হবে। সিপিএমকে এর জবাব দিতে হবে।’’ বিজেপিকে নিশানা করে মমতা বলছেন, ‘‘চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই, চাকরি কাড়ার ক্ষমতা আছে। তাঁদের ধিক্কার জানাই। যাত্রাপালার মাধ্যমে আপনাদের ভুল বোঝাচ্ছে। রাজ্য সরকার অনেক চেষ্টা করেছিল। ২০২২ থেকে নোংরা খেলা শুরু করেছে।’’

কিন্তু বৈঠকে স্পষ্ট হলো না, দুর্নীতি কি মমতা স্বীকার করে নিলেন। আদালতের রায়কে আবারও চ্যালেঞ্জ, আশ্বাস, স্বেচ্ছাসেবার মধ্যে দিয়ে সত্যিই চাকরিহারারা বিচার পাবেন?

More Articles