বোধন থেকে বিসর্জন, বাঙালির পাতে জায়গা পাক পুজোর ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টিগুলি
Bengali Sweets: উৎসবের শেষ বেলাতে আনন্দের রস নিংড়ে নিতে ভোলে না বাঙালি। বিসর্জনের পর কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ কোনওটাতেই কমতি পড়ে না এদিন ।
আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে গেছে প্যান্ডেলে এবং রেস্তোরাঁয় মানুষের ভিড়। গত দুই বছরের তুলনায় এবারে পুজো নিয়ে উত্তেজনা খানিকটা বেশি। তবে মাঝে মধ্যে আকাশ মুখ ভার করছে, কালো মেঘ খানিকটা ভয়ও দেখাচ্ছে। তাও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে রয়েছে অঢেল খাওয়া দাওয়া আর সেখানে বাদ যায়নি নানারকম মিষ্টি পদও! আসলে পুজো আসছে আসছে ব্যাপারটাই ভালো। বোধন থেকে মিষ্টিমুখে মায়ের আগমনী সুর বেজে উঠলেও নবমীনিশি পেরোলেই শূন্যতা গ্রাস করে আপামর বাঙালিকে। দশমীর সকাল থেকেই মুখ ভার। তবু উৎসবের শেষ বেলাতে আনন্দের রস নিংড়ে নিতে ভোলে না বাঙালি। বিসর্জনের পর কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ কোনওটাতেই কমতি পড়ে না এদিন। মিষ্টির দোকানে ভিড়ের ঠেলায় থাকে না তিল ধারণের জায়গা । অনেকে আবার বাড়িতেই বানান মিষ্টি। পুজোয় পাতে কোন কোন মিষ্টি রাখতেই হবে, দেখা যাক এক ঝলকে-
বোঁদে: বাঙালি বাড়িতে বোঁদের এক আশ্চর্য মাহাত্ম্য রয়েছে। আজও ঠাম্মা-দিদিমাদের রান্নাঘরে পুজোর সময় উঁকি দিলে দেখা যায় তাঁরা নিজের হাতেই বানাচ্ছেন বোঁদে। বিউলির ডাল নিজের হাতে বেটে নিয়ে তারপর ভালো করে ফেটিয়ে নিন। তারপর গরম ঘিতে ছাঁকনা দিয়ে বিউলির ডাল বাটা ছাড়ুন, কড়াইতে যেই ছাড়বেন তখনই তা বোঁদের আকার নেয়। বোঁদে ভেজে নিয়ে চিনির রসে ডোবাতে হয়। চিনির রসে বোঁদে ভালো করে ভিজে গেলে সেগুলি ছাঁকনা দিয়ে তুলে ঠান্ডা করে নিলেই তৈরি হয়ে যায় বোঁদে।
মিহিদানা: পুজোর সকালে জলখাবারের লুচির সঙ্গে পাতে জায়গা করে নেয় মিহিদানা। তবে এই মিহিদানার রয়েছে এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও। ১৯০৪ সালে রাজ পরিবারের আমন্ত্রণে বর্ধমানে এসেছিলেন বড়লাট লর্ড কার্জন। তাঁকে মধ্যাহ্ন ভোজে বিশেষ মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য কারিগরকে নির্দেশ দেন বর্ধমানের মহারাজ বিজয়চাঁদ মহাতাব। সেই সময় থেকেই মিহিদানার দাপট বাংলা জুড়ে চলছে। মিহিদানা তৈরি করা হয় গোবিন্দভোগ চাল ও ছোলার বেসন দিয়ে।
আরও পড়ুন- মিষ্টির জন্য ট্রেন দাঁড়াত এক ঘণ্টা! লেডিকেনির ইতিহাস আজও অবাক করে
সীতাভোগ: বর্ধমানের আরও একটি ঐতিহাসিক মিষ্টি হল সীতাভোগ। সীতাভোগ তৈরির প্রধান উপাদান গোবিন্দভোগ চাল। গোবিন্দভোগ চাল থেকে প্রস্তুত হওয়ার কারণেই সীতাভোগের একটি নিজস্ব স্বাদ ও সুগন্ধ হয়। এই চাল গুঁড়ো করে প্রথমে পাউডার করে তাতে ১:৪ অনুপাতে ছানা মিশিয়ে পরিমাণমতো দুধ দিয়ে মাখা হয়। তারপর একটি বাসমতী চালের আকৃতির মতো ছিদ্রযুক্ত পিতলের পাত্র থেকে ওই মিশ্রণকে গরম চিনির রসে ফেলা হয়। এর ফলে সীতাভোগ বাসমতীর চালের ভাতের মতো দেখতে লম্বা সরু সরু দানাযুক্ত হয়। এর সঙ্গে ছোট ছোট গোলাপজাম এবং কখনো কখনো কাজুবাদাম ও কিশমিশ মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।
জিলিপি: অনুষ্ঠান, মেলা মানেই জিলিপি। আর জিলিপির প্যাঁচের কথা কম-বেশি সকলেই জানে। তবে সেই প্যাঁচে মিষ্টি নেই, যে মিষ্টি আছে আসল জিলিপিতে। জিলিপি বা জলেবির উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্যে। মনে করা হয়, পার্সি আক্রমণকারীরা ভারতে নিয়ে এসেছিল এই জলেবি। তবে এই মুহূর্তে কোনও সন্দেহ নেই যে, ভারতের মানুষ আবেগ দিয়েই তাকে আপন করে নিয়েছে। এমনকী বাঙালি ঘরে তার আদরের নাম ‘জিলিপি’। এটি মূলত মিহি ময়দা থেকে তৈরি, প্যাঁচালো আকারে ভেজে জাফরান চিনির সিরাপে ভিজিয়ে রেখেই বানানো হয়।
সরপুরিয়া: নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত অধরচন্দ্র দাসের সরপুরিয়ার নাম এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরেও শোনা যায়। পুজোর ক'টা দিন তাই মিষ্টিমুখ করতে নিজেদের প্লেটে রাখতে পারেন সরপুরিয়া ও সরভাজাকে। ক্ষীর, কাজু, পেস্তা ও নানা উপকরণ সহযোগে বানানো হয় এই মিষ্টি।
মিষ্টি দই: মিষ্টি দই বাংলার ঐতিহ্য। এটি জনপ্রিয়ও বটে। দুধ, চিনি বা গুড় সহযোগে তৈরি করা হয় এটি। লাল দইয়ের উপরিভাগে থাকে ক্ষীরের স্তর। নদিয়ার যেমন সরপুরিয়া বিখ্যাত তেমনই নদিয়া চৈতন্য মহাপ্রভুর জায়গা, নবদ্বীপ ধামের লাল দইও খুবই বিখ্যাত।
কাজু বরফি: বরফি হল একটি বিখ্যাত ভারতীয় মিষ্টি, যেটির নামকরণ ফার্সি শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘তুষার’। এর প্রধান উপাদান কনডেন্সড মিল্ক। কাজু বা পেস্তা দিয়ে তৈরি হয় বরফি। সেগুলির উপরের অংশে লাগানো হয় তবক বা রুপোলি ফয়েল, যেটি খাওয়া যায়।
গুলাব জামুন: ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টিগুলির একটি হল এই গুলাব জামুন। অত্যন্ত নরম, স্পঞ্জি এই মিষ্টি ময়দা এবং গুঁড়ো দুধ বা কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে তৈরি করা হয়। স্বাদ বাড়াতে মেশানো হয় এলাচ এবং গোলাপ। সম্ভবত গোলাপের ব্যবহার থেকেই নাম ‘গুলাব জামুন’।
জলভরা: জলভরা মিষ্টির নাম শুনলেই জিভে জল চলে আসে। তবে অনেকেই ডায়েটে কারণে সারাবছর মনের মতো করে মিষ্টি খেতে পারেন না। তাঁরা কিন্তু এই পুজোর সময় মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারেন ডায়েটে জুজুকে, আর প্রাণ ভরে করতে পারেন মিষ্টি মুখ। কথিত আছে, ময়রা বাড়িতে আসে নতুন জামাই। তাকে কীভাবে মিষ্টি দিয়ে চমক দেওয়া যায়, সে বিষয়ে ভাবতে ভাবতেই তৈরি হয় আজকের ‘জলভরা’। মুখে দিতেই জামাই অবাক! আজও প্রসিদ্ধ সেই মিষ্টি। শীতের দিনে যা মুখে দিলে মোলায়েম গুড় মন ভালো করে দেবেই।
আরও পড়ুন- বাসি দুধেই মিষ্টিমুখ! এবার পুজোয় বাড়িতেই সহজে বানিয়ে ফেলুন এই পদগুলি
ক্ষীর এবং ফিরনি: ক্ষীর ঐতিহ্যবাহী এক ভারতীয় মিষ্টি। ফিরনি তৈরি হয় চালের গুঁড়ো দিয়ে। দুধ ঘন করে জাল দিয়ে ক্ষীর তৈরি করতে অনেকটা সময় লাগে। ফিরনি সব সময়ই ঠান্ডা পরিবেশন করা হয়। ক্ষীর গরম গরমও ভালো লাগে। এ ছাড়া, বাংলায় পায়েস বা পরমান্নও বেশ জনপ্রিয়। পুজোর ভোগে পরমান্ন নিবেদন করা হয় ইষ্ট দেবতার উদ্দেশ্যে।
রস মালাই: এই মিষ্টি অনেকটা রসগোল্লার মতোই। তবে দেখতে চ্যাপ্টা। এটি সরওয়ালা মিষ্টি দুধে (মালাই) ডুবে থাকে। সাধারণত বাদাম এবং কেশর দিয়ে সাজানো হয় রসমালাই।
রসগোল্লা: বাংলার এই বিখ্যাত মিষ্টি নিয়ে আছে জনপ্রিয় গান ও সিনেমা। রসগোল্লার উৎপত্তিই সেই ছবির বিষয়। ১৮৬৮ সালে কলকাতার নবীনচন্দ্র দাসের সৃষ্টি এই রসগোল্লা। শোনা যায়, নিজের স্ত্রীর কথা রাখতেই তিনি এই বিশেষ মিষ্টি তৈরি করেন। কলকাতার রসগোল্লার জগত জোড়া নাম কিন্তু স্বাদের গুণেই। এটি তৈরি করতে সম্পূর্ণ ছানার গোলা মিষ্টি চিনির রসে ডুবিয়ে বানানো হয়।