স্বয়ং জগন্নাথের লীলা না কি অন্য অলৌকিক— পুরীর মন্দিরে যে রহস্যের উত্তর পাওয়া যায়নি আজও
সে বহুদিন আগেকার কথা। আসিসির সেন্ট ফ্রান্সিস তখন অর্ডার অব ফ্রারারস মাইনর প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তাদেরই এক সদস্যের হাত ধরে চতুর্দশ শতকের আশেপাশে জগন্নাথ দেবের গল্প পৌঁছল ইউরোপে। সেখানকার লোকজন শুনল, ভারতে জগন্নাথ নামে ভগবান বিষ্ণুর এক অবতার রয়েছে, তাঁকে এক বিরাট রথে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। লোকের মুখে মুখে সেই অচেনা গল্প এমন ফুলে ফেঁপে উঠল, যে শোনা যেতে লাগল সেই রথের তলায় অনেক ভক্তই আত্মোৎসর্গ করতে লাফিয়ে পড়ে এবং চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যায়। যথেষ্ট বাড়িয়ে বলা সন্দেহ নেই, কিন্তু ইউরোপের জনমানসে এই গল্প এমন প্রভাব ফেলেছিল যে উনবিংশ শতকে ইংরেজি অভিধানে একটি নতুন শব্দ পর্যন্ত যোগ হয়—জাগারনাট। ব্যুৎপত্তিগতভাবে এই শব্দ যে ‘জগন্নাথে’রই অপভ্রংশ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণত এই শব্দ যে কোনও বিরাটাকৃতির কিছুকেই বুঝিয়ে থাকে, যা নিজের পথে সমস্ত বাধাবিপত্তি গুঁড়িয়ে এগিয়ে চলে।
এর থেকে গোটা বিশ্বে রথযত্রার অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা কী ব্যাপক— একটা ধারণা করা যায়। এছাড়াও ভারতের বিখ্যাত চারধামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাম পুরী। পুরী, দ্বারকা, বদরিনাথ ও রামেশ্বরম নিয়েই এই চারধাম। পুরীর মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বহুদিন আগে। সম্ভবত ১০৭৮ থেকে ১১৪৮ সালের মধ্যে। তবে আজকে আমরা মন্দিরটি যেমন দেখি, এই রূপ দিয়েছিলেন রাজা অনন্ত ভীম দেব ১১৭৪ খৃস্টাব্দে। হিন্দুদের অন্যতম পীঠস্থান এই মন্দির রহস্যে ভরপুর। আজ জেনে নেব এমন কয়েকটি রহস্যের কথা।
নিশান রহস্য
মন্দিরচূড়ে নীলচক্রের মাথায় লালে হলুদে জাফরি কাটে আকাশের গায়। পতিতপাবন বনো নিশান। সূর্যালোকে ঝলমল করছে। অদ্ভুত ব্যাপার, এই নিশান ওড়ে হাওয়ার ঠিক বিপরীতে।
ছায়া রহস্য
দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়ায়। আশেপাশের বাড়ি, গাছ-গাছালির ছায়া দীর্ঘতর হয়। কিন্তু যেন দৈবপ্রভাবে পুরীর মন্দিরের ছায়া পড়ে না বিন্দুমাত্র। কারীগরীবিদ্যার আজব জাদুতে অতবড় কাঠামোর ছায়া মিলিয়ে যায় মন্দিরের শরীরেই।
প্রসাদ রহস্য
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রসুইকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম রসুই। ৩২ কামরার এই রান্নঘরে ২৫০-রও বেশি মাটির পাত্রে ভোগ রান্না হয়। রান্না করেন ৬০০ জন রাঁধুনি ও তাদের সাহায্য করে আরো ৪০০ জন। এই ভোগ পুজো শেষে ভক্তদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয় প্রসাদরূপে। আশ্চর্যের ব্যপার, প্রতিদিন একই পরিমাণ ভোগ রাঁধা হলেও প্রসাদ কখনও অপর্যাপ্ত হয় না বা উদ্বৃত্ত থাকে না। অথচ ভক্তের সংখ্যা হতে পারে ২০০০ থেকে ২০০০০ পর্যন্ত। এই বিপুল পার্থক্য কীভাবে যথাযথ পরিমাণে প্রসাদ পায়, তা এখনও রহস্য।
মাটির হাঁড়ির রহস্য
জগন্নাথদেবের ভোগ রান্না হয় শুধুমাত্র মাটির পাত্রে। একের ওপর আরেকটি করে সাকুল্যে সাতটি হাঁড়ি চাপানো হয় একটি উনুনে। অথচ দেখা যায়, সবার উপরের পাত্রটির ভোগ রান্না হয় সবার আগে। শেষের পাত্রটিতে রান্না সম্পন্ন সবার শেষে। এও এক রহস্য।
হাওয়া রহস্য
সাধারণত সমুদ্রতটে সমুদ্রের হাওয়া স্থলভাগের দিকে ছুটে আসে দিনের বেলায়। রাতে স্থল্ভাগের থেকে সমুদ্রের দিকে সেই হাওয়া ফিরে যায়। অথচ জগন্নাথ মন্দিরের সমুদ্রতটে এ ঘটনা ঘটে সম্পূর্ণ উল্টো ক্রমে। দিনের বেলায় মন্দিরের হাওয়া নেমে যায় সমুদ্রে। রাতে আবার তা মন্দিরসংলগ্ন অঞ্চলে ফিরে আসে।
শব্দ রহস্য
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের চারটি প্রবেশদ্বার। মন্দিরের পুবদিক ঘেঁষা সিংহদ্বারটি দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলে সমুদ্রের গর্জন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। আবার মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এলে কানে আসে সেই গর্জন। এ এক অতি আশ্চর্য ঘটনা। গোটা মন্দির এমন ভাবেই তৈরি যে বাইরের কোনও আওয়াজ সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। কারিগরী নাকি দৈব ঘটনা? উত্তর মেলেনি আজও।
নীলচক্রের রহস্য
যে চক্রের গায়ে পতিতপাবন বনো নিশান বাঁধা হয়, তার নাম নিলচক্র। লোহা, তামা, দস্তা, পারা, শিসা, পিতল, রুপো ও সোনা দিয়ে তৈরি এই অষ্টধাতুর চক্রের বাইরের ঘের ৩৬ ফুট, ভিতরের ঘের ২৬ ফুট। নানা কারুকার্য্যময় চক্রটি প্রায় ২ ইঞ্চি পুরু। মনে করা হয়, এই চক্র আসলে সুদর্শন চক্র, যা বিষ্ণুর সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র। ২১৪ ফুট উঁচুতে এই চক্রটির অবস্থান বিচিত্র। যে কোনও দিক থেকে চক্রটিকে দেখলে মনে হয় সেটি দর্শকের দিকেই মুখ করে রয়েছে। কী উপায়ে এই বিশাল চক্র মন্দিরের চূড়ায় তোলা হল, তাও এক রহস্য।
উড়ানবিধি রহস্য
ছবিতে প্রায়শই দেখা যায় বড় বড় ইমারত বা স্থাপত্যের উপর দিয়ে বিমান উড়ে চলেছে। অথবা উঁচু জায়গায় পাখিদের আধিপত্য। কুতুব মিনার থেকে তাজমহল, লালকেল্লা–সবই এই ধরনের ঘটনার সাক্ষী। অথচ পুরীর মন্দিরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। কোনও এক আশচর্য কারণে মন্দিরের চূড়ায় বা আশেপাশে কোনও পাখি সচরাচর দেখ যায় না। এমনকী এর উপর দিয়ে বিমানও ওড়ে না বলে দাবি করেন ভক্তরা। রাষ্ট্রের জারি করা কোনও সরকারি নিয়ম নয়; ভক্তদের মতে ভগবান জগন্নাথের দৈববলে জারি থাকে এই উড়ানবিধি।
তথ্যঋণ–
“8 Unexplained Mysteries of Jagannath Temple Puri That Are Intriguing.” 2017. October 9, 2017.
“10 Mysterious Facts of Puri Jagannath Temple.” n.d. Accessed January 17, 2022.
“11 Astonishing Facts About Jagannath Temple In Puri - Holidify.” n.d.
Biswas -, Suchismita. 2016. “10 Mysteries Of Puri’s Jagannath Temple Which Are Still Unexplained.” Noise Break (blog). December 12, 2016.
Dey, Panchali DeyPanchali, and Read More. n.d. “Mysteries of Jagannath Temple That Defy Scientific Logic.” The Times of India.
Dutta, Swarnab. 2020. “10 Mysteries about the Puri Jagannath Temple That Is Unbelievable - Swarnab Dutta.” June 28, 2020.