গান গায় বালিয়াড়ি! ধূ ধূ বালিতে প্রকৃতির গা ছমছমে 'কনসার্ট'-এর নেপথ্যের রহস্য জানেন?
Singing Sand Dunes: বালিয়াড়ি থেকে শুনতে পাওয়া সঙ্গীত আসলে ভিতরে চাপা পড়া মানুষদের গান!
ধূ ধূ বালিয়াড়ি। পথিকের পথ হারানো ছাড়া গতি নেই। অথবা দক্ষ পথিক হলে পথের সন্ধানে বালি ঠেলতে ঠেলতে হাঁপিয়ে পড়বেন। জল নেই, জনমানসের চিহ্ন নেই, আরাম নেই। তবে সারাক্ষণ গান গেয়ে চলবে মিহি বালিরা! বালির গান? বালিয়াড়ির গান বলা ভালো। বালিয়াড়িতে গেলেই অদ্ভুত ধ্বনিতে শুরু হয়ে যায় সঙ্গীত! চিনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় গানসু প্রদেশে, দুনহুয়াং-এর মরুভূমির শহর সঙ্গীতের ধ্বনিতে জেগে থাকে। শুনতে রোমাঞ্চকর মনে হলেও বিষয়টি বেশ গা ছমছমেই। কোনও মানুষ নেই, বাদ্যযন্ত্র নেই, অথচ গোটা বালিয়াড়ি জুড়ে এক সঙ্গীত। ভয়ঙ্কর কিন্তু অপার্থিব! কুমটাগ মরুভূমি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অত্যাশ্চর্য এই বালিয়াড়ির গানের নেপথ্যে রয়েছে নানা লোককাহিনিও।
Singing Sand Dunes নামে পরিচিত এই বালিয়াড়ির সর্বোচ্চ শিখরটির উচ্চতা ১,৭১৫ মিটার। বালিগুলিও রামধনু রঙের। হলুদ, সাদা থেকে শুরু করে সবুজ এবং কালো রঙের বালিরও দেখা মিলবে। দুনহুয়াং অঞ্চলের এই সুরেলা বালিয়াড়িগুলি অনেক চিনা কিংবদন্তি এবং লোককাহিনির কেন্দ্রবিন্দু। এই বালিয়াড়িগুলি বিখ্যাত সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত। সিল্ক রোড হচ্ছে মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যেকার এক উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য পথ যা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে প্রায় ১,৫০০ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই অবস্থানের তাত্পর্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে, বালিয়াড়িগুলি চিনের সাংস্কৃতিকভাবে উল্লেখযোগ্য সুরেলা বালিয়াড়িগুলির মধ্যে অন্যতম।
আরও পড়ুন- সৌরজগতের মধ্যেই রয়েছে আরও একটা পৃথিবী! চমকে গেলেন বিজ্ঞানীরাও
চিনা কিংবদন্তি অনুসারে এই অঞ্চলটি একসময় একটি পর্বত অঞ্চল ছিল, এখানে ছিল ক্রিসেন্ট মুন হ্রদ, যা এখনও নাকি টিলার তলদেশে চাপা পড়ে আছে। জায়গাটি পবিত্র সব মন্দিরে ঘেরা ছিল। কেউ কেউ বিশ্বাস আবার করেন, মন্দিরগুলি থেকে আসা পুজোর শব্দে মরুভূমির ঘুমন্ত হলুদ ড্রাগন প্রিন্স নাকি ভয়ানক বিরক্ত হতেন। একদিন মেজাজ বেজায় খারাপ ছিল, রেগে মেগে এই অঞ্চল এবং এর সমস্ত বাসিন্দাকে তিনি বালিতে ঢেকে দিয়েছিলেন। বালিয়াড়ি থেকে শুনতে পাওয়া সঙ্গীত আসলে ভিতরে চাপা পড়া মানুষদের গান! তবে এসব লোককাহিনি সরিয়ে একটু যুক্তি আর বিজ্ঞানকে ডাকা হোক আসরে। দেখা যাক, বালিয়াড়ির গানের নেপথ্যে রয়েছে কোন রহস্য?
বালিয়াড়ি কীভাবে গাইতে পারে?
বালির কণার গুণমান হচ্ছে রহস্যের আকর! বালির কণাই এমন একটি উপাদান যা বালিয়াড়ি জুড়ে মেহফিল বসায়। সূক্ষ্ম থেকে মাঝারি বালির কণা দ্বারা গঠিত এই বালিয়াড়িতে বালি অত্যন্ত সহজেই হাওয়াতে উড়ে এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেতে পারে। এই বালির কণার আকারের কারণে চলাচল এবং মিথস্ক্রিয়া দুই-ই অত্যন্ত সুন্দরভাবে ঘটে। বালির কণার সঙ্গে কণার ঘর্ষণে বিভিন্ন অনুরণন এবং কম্পাঙ্ক তৈরি হয়। মসৃণ, গোলাকার বালির দানা আরও ভালো শব্দ তৈরি করতে পারে।
বালিয়াড়িগুলির গঠনও এই সুর তোলার নেপথ্যে কাজ করে। বালিয়াড়ির ঢাল কতখানি খাড়া তাই ঠিক করে দেয় বালির কণাগুলির মধ্যে কতটা মিথস্ক্রিয়া ঘটবে, কতখানি ঘর্ষণ হবে। এবং এই সবের পাশাপাশিই রয়েছে বায়ু! শব্দ তৈরি করার জন্য কণাগুলি যাতে উড়ে উড়ে যেতে পারে তার জন্য ভালো বায়ুপ্রবাহ দরকার। বাতাস শক্তিশালী হলে বালিয়াড়িগুলি জোরে গর্জন করে, কিন্তু হালকা বাতাস বইলে মৃদু সঙ্গীত তৈরি হয়।
আরও পড়ুন- ধূ ধূ মরুভূমিতে শস্য-শ্যামল কৃষিক্ষেত! যেভাবে অসাধ্যসাধন করেছিলেন রাজা গঙ্গা সিং!
আশেপাশের কাঠামোগুলিও শব্দ তৈরি এবং শব্দকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। পাহাড় এবং পর্বত দুই-ই বায়ুপ্রবাহের এক নির্দিষ্ট পথ তৈরি করে যা বালিয়াড়ির চারপাশের নির্দিষ্ট এলাকায় বায়ুর প্রবাহের এক গতি তৈরি করে। বাতাস বালির কণার সঙ্গে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে, যার ফলে বালিতে কম্পন তৈরি হয় এবং শব্দ সৃষ্টি হয়। বালির কণার মধ্যে বায়ু গহ্বরগুলিও অনুরণণ প্রকোষ্ঠ হিসাবে কাজ করতে পারে যা শব্দকে আরও প্রশস্ত করে।
শুষ্ক জলবায়ুও শব্দ তৈরির অন্যতম কারণ। এই কারণেই মরুভূমির পরিবেশেই কিন্তু সুরেলা বালিয়াড়ি মেলে। কম আর্দ্রতা বালির কণার মধ্যে ঘর্ষণ বাড়ায়। একে অপরের সঙ্গে ঘষা লাগলেই শব্দ তৈরি হয়।
সুরেলা বালিয়াড়ি কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই নয়। মঙ্গোলিয়া, জিনজিয়াং, গানসু এবং নিংজিয়া প্রদেশ সহ চিন এই জাতীয় বালিয়াড়ির আবাসস্থল। সাহারা মরুভূমির মতো নামিবিয়ার নামিব মরুভূমিরও নিজস্ব গানের বালিয়াড়ি রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার মোজাভে মরুভূমিতেও সুরেলা বালিয়াড়ির দেখা মেলে।
উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক স্থান হিসাবে, বালিয়াড়িগুলি ক্ষয়ের লক্ষণ এবং মানুষের বেশি আনাগোনার উপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালানো হয়। বালিয়াড়ি সংরক্ষণ প্রচেষ্টার লক্ষ্যই হচ্ছে এই বালিয়াড়ি এবং প্রকৃতির প্রভাব সম্পর্কে দর্শকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আসলে এই স্থানটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। সুরেলা বালিয়াড়ির মধ্যে উটে চড়া, গ্লাইডার ট্যুর তো চলেই, আর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়কার শব্দ ও দৃশ্যের যুগলবন্দি দেখতে ভিড় জমে। প্রচুর পর্যটকদের আনাগোনা সত্ত্বেও প্রতি রাতে যখন মরুভূমির বাতাস বালিয়াড়ির উপর বয়ে যায়, সমস্ত লৌকিক পদচিহ্নগুলি মুছে দেয়, বালিদের কলতান শুরু হয়। নৈশব্দ কাঁপিয়ে বালিদের কনসার্ট শুরু হয়। প্রকৃতির নিজস্ব আদিম কনসার্ট।