চতুর্দিকে 'প্রেতে'র ভিড়! রোম খাড়া হয়ে যায় ভারতের ১৪ দিনের এই ভূতমেলায়

Ghost Fair in India: দু'দিনের এই মেলায় মানুষের উপস্থিতি প্রতি বছর ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

ভারতবর্ষ উৎসবের দেশ। এমন কোনও ঘটনা পাওয়াই মুশকিল, যার জন্য পৃথক উদযাপন নেই! সম্পর্ক এখানে পূজিত হয়, স্বাস্থ্য ফিরে পেতে, পড়াশোনা বা জ্ঞান বাড়াতে, সম্পদ বাড়াতে এখানে মানুষ পুজো করেন, প্রকৃতির ঋতুপরিবর্তন, ফসল কাটা বা রোপণ করাও এখানে পুজো আর উৎসবের মাধ্যমে পালিত হয়। এমনকী বহুকাল আগে ছেড়ে চলে যাওয়া স্বজনদের স্মরণ করতেও রয়েছে ভিন্ন উৎসব। সবই যখন হলো, ‘ভূত'রাই বা বাদ যায় কেন? বাদ যায়নি, ভূতদের জন্য এই ভারতেই আয়োজিত ও উদযাপিত হয় এক মেলা। সেই মেলা 'মানুষের মিলনক্ষেত্র' নাকি 'তেনাদের মিলনস্থল' বোঝা দুষ্কর। এই হালফিল গেজেট নির্ভর সমাজেও, ভূত মেলা যে ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়, তা স্পষ্ট করে বিশ্বাসের শিকড় এখনও প্রবল আঁধারেই। কোথায় পালিত হয় এই ভূতমেলা? কীই বা হয় এই ভূতমেলাতে?

এক নয়, দুইখানি মেলা! 'ভূতাদি অমাবস্যা' বা ভৌতিক অমাবস্যার দিন বসে একটি মেলা। মধ্যপ্রদেশে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, আচার-অনুষ্ঠান এবং ভুতুড়ে চিৎকারের এক বিচিত্র, উদ্ভট, ভয়াবহ সংমিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায় ভূতমেলায়। মধ্যপ্রদেশের নর্মদাপুরম জেলায় মেলা পিতৃপক্ষের ১৪ তম দিনে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা এবং অমাবস্যার গভীর রাত্রি পর্যন্ত চলতে থাকে। শুধু যে গ্রামের অন্ধবিশ্বাসী মানুষই ভিড় জমান এমন নয়। দু'দিনের এই মেলায় মানুষের উপস্থিতি প্রতি বছর ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। আর এই মধ্যপ্রদেশেরই রাজধানী ভোপাল থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে বেতুল জেলার সাতপুরা পর্বতমালার পাহাড়ের মধ্যে একটি গ্রাম হচ্ছে মালাজপুর। মালাজপুর গ্রামে তিন সপ্তাহব্যাপী ভূতের মেলা চলে! মানুষের বিশ্বাস, মালাজপুর ভূত মেলা নাকি ৪০০ বছর ধরে চলে আসছে।

মালাজপুর ভূত মেলার নেপথ্যের গল্পটি ১৮ শতকের। লোককথা অনুযায়ী, দেবজি মহারাজ নামে এক ব্যক্তির নাকি কিছু অদ্ভুত জাদুক্ষমতা ছিল। তিনি একবার এই গ্রামে এসেছিলেন। স্থানীয়দের মতে, তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতা দিয়ে তিনি মাটিকে গুড় এবং পাথরকে নারকেলে বদলে দিয়ে বন্ধুদের খাওয়াতেন। পরে, এই দেওজি নিজের 'জাদুক্ষমতা' দিয়ে অশুভ আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন এবং ভূতে পাওয়া মানুষদের 'রোগ' নির্মূলে সাহায্য করেন। তিনি এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে গ্রামবাসীরা পরে গ্রামে একটি মন্দিরের মতো তৈরি করেন। এই মন্দিরের পুরোহিতরা দেওজিকেই তাদের পূর্বপুরুষ বলেন এবং উত্তরাধিকার হিসেবে নাকি এখন মানুষকে অশুভ আত্মা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করেন। 'গুরু মহারাজ দেওজি কি জয়' বলতে বলতে ঝাঁটাপেটা থেকে শুরু করে চুলের মুঠি ধরে মার, বাদ যায় না কিছুই!

আরও পড়ুন- মানুষের বসতি, না ভূতের আস্তানা? বিশ্বের সবচেয়ে ‘নিঃসঙ্গ’ বাড়ি ঘিরে আজও ঘুরে বেড়ায় রহস্য

কেন এত জনপ্রিয় এই মেলা? উত্তর হয়তো, ভয়ই মানুষের সেরা বিনোদন! এই মেলায় ঢুকে পড়লেই চারদিকে যা দৃশ্য দেখা যাবে, সে ভারতকে চেনেন না অনেকেই। খানিক মজা লাগলেও, আখেরে অস্বস্তি হতে বাধ্য! স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, এই মেলার সময় নর্মদা নদীতে স্নান করলে মানুষ অতিপ্রাকৃত নানা সমস্যা থেকে মুক্তি পায়। মেলায় নদীর ধারেই, কালাজাদু, প্রেততন্ত্র, বাবা, তান্ত্রিক এবং এই ধরনের নানা মানুষের দেখা মেলে। স্থানীয় মানুষের মতে, এত এত লোক মেলায় জড়ো হন পড়িহারো বাবার (স্থানীয় এক দেবতা) কাছ থেকে 'চিকিৎসা' পেতে। নর্মদার জলে দাঁড়িয়ে ভক্তরা নিজেদের কথ্য গ্রাম্য ভাষায় নিজেদের সমস্যা বর্ণনা করতে থাকেন। আর যারা অলৌকিক কোনও সমস্যায় ভুগছেন, মানে ভূতে ধরেছে, বা এমন কোনও রোগ যা তাঁদের জ্ঞানের বাইরে, তার থেকে নিরাময় পেতে তারা স্নান করে কাদা মাখেন দেহে। মন্দিরে দু'টি বটগাছ রয়েছে। পুরোহিতদের মতে, হাজার হাজার ভূত এবং অশুভ আত্মা যাদের মানুষের দেহ থেকে বের করে আনা হয়, তারা 'পরিত্রাণ' পেয়ে এই গাছেই বাসা বাঁধে।

আরও পড়ুন- সময় পেরলেও মরচে পড়েনি এতটুকুও, ভারতের এই মন্দিরে আজও রয়েছে পরশুরামের কুঠার

বিশ্বাসের নামে কুসংস্কারের এই আজব খেলা মাঝে মাঝে হিংসাত্মকও হয়ে ওঠে। মেলায় এই ত্রাণকর্তা বাবাদের তরোয়ালের ব্যবহারে উপস্থিত বিশ্বাসীদের গুরুতর আঘাতও লাগে। ভূত ছাড়াতে অনেককে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, ব্যাপক মারধরও চলে। তবে ভূতের মেলায় এসব আঘাত, অত্যাচারকে গুরুত্ব দিতে নেই। বিশ্বাসে চিরকালই মেলায়...

ভূত মেলা মূলত 'প্রেত ছাড়ানোর মেলা'। লোকবিশ্বাসে, প্রেত অর্থাৎ তারাই যাদের অকালমৃত্যু হয়েছে। এই প্রেতরা অস্বাভাবিক তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত। তাই ছটফটে প্রেত কারও উপর চেপে বসলে তার একেবারে রক্ত শুষে খায়! মনোবিজ্ঞান বা বিজ্ঞান বলছে, এই জাতীয় অতিপ্রাকৃত বা ভৌতিক সমস্যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্কিজোফ্রেনিয়া রোগটিই মূল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার ভারতে প্রায় ১ শতাংশ রোগীই স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সেই এই রোগ দেখা দিতে শুরু করে। তবে কখনও কখনও লক্ষণগুলি পরেও দেখতে পাওয়া যায়। সঠিক চিকিৎসার অভাব এবং প্রচলিত কুসংস্কারের কারণে, ভারতে রোগীদের গন্তব্য চিকিৎসক না হয়ে, হয়ে ওঠে প্রায়ই এই ধরনের ভূত মেলা এবং জাদুবিদ্যায় পারদর্শী কিছু মানুষ।
হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত মানুষরা এভাবেই সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে আজীবন রোগ সারানোর নামে অত্যাচারিতই হন। অবৈজ্ঞানিকভাবে রোগীদের মারধর করে ভূত ছাড়ানোর এই খেলা আসলে নিজেই এক রোগ!

 

More Articles