এক কোটি গাছ কাটা হবে নিকোবরে! সবুজ ধ্বংসের কারণ কী?
Nicobar Island Deforestation: সরকার দাবি করেছিল, এই বনাঞ্চলের মাত্র ৫০% অর্থাৎ প্রায় ৬,৫০০ হেক্টর বন উজাড় করা হবে এবং প্রায় ৮.৫ লক্ষ গাছ কাটা হবে
নিকোবর দ্বীপে আন্তর্জাতিক ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর, একটি টাউনশিপ, একটি পাওয়ার স্টেশন এবং একটি বিমানবন্দর নির্মাণ হবে। উন্নয়ন হবে মানেই, আগের অবস্থানে যা ছিল তা উৎখাত করে নয়া ব্যবস্থা, নয়া পরিকাঠামো গড়া হবে। নিকোবর মানে অরণ্য। সবুজ দ্বীপে উন্নয়ন মানে সবুজকেই উৎখাত। ২০২২ সালে, পরিবেশ মন্ত্রক গ্রেট নিকোবর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ১৩০.৭৫ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি উজাড় করার অনুমতি দেয়। সরকার দাবি করেছিল, এই বনাঞ্চলের মাত্র ৫০% অর্থাৎ প্রায় ৬,৫০০ হেক্টর বন উজাড় করা হবে এবং প্রায় ৮.৫ লক্ষ গাছ কাটা হবে। তবে বৃষ্টি অরণ্য নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করা একজন বিজ্ঞানী বলছেন, সরকারের এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত ভুয়ো। ওই বাস্তু বিশেষজ্ঞ বলছেন, নিকোবর রেইনফরেস্টে গাছের ঘনত্ব নিয়ে সরকারি তথ্য আর বিজ্ঞানীদের তথ্যে অমিল রয়েছে।
ওই বাস্তুবিদ (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলছেন, সরকার যদি দাবি করে যে ৬,৫০০ হেক্টর জুড়ে ৮.৫ লক্ষ গাছ কাটা হবে, তাহলে সেই হিসেব অনুযায়ী বনের প্রতি হেক্টরে ১৩০টি করে গাছ রয়েছে। বনের ঘনত্বের ক্ষেত্রে এই হিসেবটি গোলমেলে। ওই বাস্তুবিদের যুক্তি, এই ধরনের ঘনত্ব গুজরাত বা রাজস্থানের মতো জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় যেখানে শুকনো কাঁটা বন, ঘাস এবং ঝোপঝাড়ের সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছ রয়েছে। নিকোবর তো এমন এলাকা নয়। সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে নিকোবরে ঘন অরণ্য রয়েছে।
আরও পড়ুন- নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে নিকোবরের আদিম অধিবাসীরা, কেন প্রমাদ গুনছেন গবেষকরা
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে যারা কাজ করছেন সেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই অরণ্যে রয়েছে ম্যানগ্রোভ, উপকূলীয় বন এবং ঘন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট। এখানে প্রতি হেক্টরে ৫০০ থেকে ৯০০টি গাছ রয়েছে। এই হিসেব অনুযায়ী, ৬,৫০০ হেক্টর বন কেটে ফেলার অর্থ হচ্ছে ৩২ থেকে ৫৮ লাখ গাছ কাটা হবে। সরকার যে ১৩,০০০ হেক্টর বনভূমি উচ্ছেদের ছাড়পত্র দিয়েছে তার সবগুলোই যদি কেটে ফেলা হয়, তাহলে যে গাছ কাটা হবে তার সংখ্যা এক কোটির মতো হতে পারে।
সরকারের প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নে অবশ্য গাছ কাটার সংখ্যার উল্লেখ নেই। তবে পরিবেশ মন্ত্রকের ওয়েবসাইট থেকে প্রকৃত চিত্রটি পাওয়া যেতে পারে। মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, কাটা পড়বে এমন গাছের সংখ্যা প্রায় ৮,৫২,২৪৫। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী বলেছিলেন, ১৩,০০০ হেক্টর বন কাটার যে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ৫০% গাছ কাটা হবে। অর্থাৎ ৯.৬৪ লাখেরও কম গাছ কাটার সম্ভাবনা ছিল।
এই পরিসংখ্যান অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে ১৩০-১৫০টি গাছের ঘনত্বের পরিসংখ্যানকে অদ্ভুত বলে মনে করছেন আন্দামানে কর্মরত বাস্তুবিজ্ঞানী অক্ষয় সুরেন্দ্র। তিনি বলছেন, সরকার কোন মাপকাঠিকে ব্যবহার করছে তা বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ এখানে। প্রথম বাস্তুবিদ বলেছিলেন, সাধারণত, জীববিজ্ঞানীরা যখন গাছ গণনা করেন, তখন শুধুমাত্র সেই গাছগুলিকেই গোনেন যার ঘের অর্থাৎ কাণ্ডের পরিধি কমপক্ষে ৩০ সেমি। অক্ষয় সুরেন্দ্র বলছেন, সরকারের গাছের ঘনত্বের কম হিসেবের কারণ তারা কেবল বড় গাছগুলির কথা বলছে।
দ্য স্ক্রোলের একটি প্রতিবেদন বলছে, বছরের পর বছর ধরে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে হওয়া বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, দ্বীপগুলিতে গাছের ঘনত্ব সরকারের অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি। এই গবেষণার বেশিরভাগই বলছে, এখানে প্রতি হেক্টরে ৫০০ থেকে ৭০০টি গাছ রয়েছে কম করে! ভারতীয় প্রাইমাটোলজিস্ট গোবিন্দস্বামী উমাপ্যাথি এবং মেওয়া সিংয়ের ২০০৩ সালের একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, গ্রেট নিকোবরে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব ৯৯৬.৬। যদি এই ঘনত্বকে ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়, তাহলে ৬,৫০০ হেক্টর জুড়ে গাছের মোট সংখ্যা প্রায় ৬৫ লক্ষ হবে। এই গবেষণায় ১৫ সেন্টিমিটার বা তার বেশি কাণ্ডের ঘের আছে এমন গাছকেই গোনা হয়েছে।
২০০৮ এবং ২০০৯ সালে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পরিচালিত অন্য তিনটি গবেষণাতেও সরকারের অনুমানের চেয়ে বেশি গাছের উল্লেখ আছে। বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, পণ্ডিচেরি ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ফরেস্ট্রি রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন এবং ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার বিজ্ঞানীদের এই গবেষণায় ৩০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি ঘেরের গাছকেই ধরা হয়েছে।
অক্ষয় সুরেন্দ্র বলছেন, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বনগুলি ভিন্ন হলেও এই দুই দ্বীপেই মধ্য ভারতের উন্মুক্ত জঙ্গলের চেয়ে অনেক বেশি গাছ রয়েছে। মধ্য ভারতের জঙ্গলে প্রতি হেক্টরে ১২৯টি গাছ থাকা সম্ভব। নিকোবর আন্দামানের তুলনায় অনেক বেশি আর্দ্র রেইনফরেস্ট। তাই, গাছের পরিমাণও বেশি। উত্তর আন্দামানের একটি গবেষণায়, দ্বীপের বিভিন্ন ধরনের বনের ঘনত্বের পরিসর গণনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে যে এর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃষ্টি অরণ্যে প্রতি হেক্টরে ৫১৫টি গাছ রয়েছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আধা চিরহরিৎ বনে প্রতি হেক্টরে ৪৮৭টি গাছ রয়েছে এবং এর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আর্দ্র পর্ণমোচী বনে প্রতি হেক্টরে ৫২২টি গাছ রয়েছে।
আরেকটি গবেষণায় মধ্য আন্দামানের বিশাল চিরহরিৎ বনের দু'টি স্থান পরীক্ষা করা হয়েছে এবং অনুমান যে এদের প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব যথাক্রমে ৫৭৯টি এবং ৭৩২টি। লিটল আন্দামানে তৃতীয় একটি গবেষণায়, দ্বীপের অবিশৃঙ্খল চিরসবুজ, আধা-চিরসবুজ, পর্ণমোচী এবং সমুদ্রতীরবর্তী বনের ঘনত্ব গণনা করা হয়েছে। এখানে প্রতি হেক্টরে ৪৮৮ থেকে ৯৩৫টি গাছ রয়েছে।
আরও পড়ুন- আন্দামানের ‘রাক্ষস’-দ্বীপের কাছে গেলেই মৃত্যু! কীভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন এক বাঙালি মহিলা?
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সরকারের হিসেব আর প্রকৃত গবেষকদের হিসেবে ঢের ফারাক। এই প্রকল্পের জন্য যারা বৃক্ষ জরিপ করতে গ্রেট নিকোবরে গিয়েছিলেন, সেই দলটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে এলাকায় তারা সমীক্ষা করেছেন, সেটি অভেদ্য ঝোপঝাড় এবং লতায় পরিপূর্ণ। ঘন বন, গাছপালা পরিষ্কার করা এবং পথ তৈরি করার অবস্থা ছিল না সেখানে। তাহলে গণনা হলো কীভাবে? এমনটা কি হতে পারে যে, এই গবেষণাগুলি করার সময় এবং বর্তমান কালে বনের ঘনত্ব হ্রাস পেয়েছে? বাস্তুবিদরা তা মনে করছেন না।
২০০৪ সালের সুনামির মতো বিশাল প্রাকৃতিক দুর্যোগও এখানকার গাছের ঘনত্বকে এতটা ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করতে পারেনি। প্রভাব পড়েছিল মূলত উপকূলরেখায়। অভ্যন্তরীণ জঙ্গল ন্যূনতম ছিল সুনামির প্রভাব। পুরো ৬,৫০০ হেক্টর বন সুনামির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এমন হতে পারে না। তাছাড়া বনের এত বড় অঞ্চলের গাছের ঘনত্ব শত শত বছর ধরে একই থাকতে পারে। প্রায় কোটির কাছাকাছি গাছ যদি উপড়ে যায় নিকোবর থেকে এখানকার জীববৈচিত্র বাঁচবে? কোথায় আশ্রয় নেবে পশুপাখিরা? এখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে জঙ্গল জড়িয়ে আছে। তাঁদের জীবন ও জীবিকায় কি ব্যাপক প্রভাব পড়বে না! টাউনশিপ, বিমানবন্দরের উন্নয়নের জন্য কোটি খানেক গাছের মৃত্যু ঘটবে রাষ্ট্রের হাতে। আমাদের কীই বা করণীয়!