বুভুক্ষু প্রায় ছ'লক্ষ! দু'বছর যে যে ভয়াবহতা দেখছে সুদান
Sudan: ত ২ বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ সহিংসতা থেকে পালিয়ে এসেছেন। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বৃহত্তম বাস্তুচ্যুতি সঙ্কটগুলির মধ্যে একটি।
দু্র্ভিক্ষ, সন্ত্রাস আর বাস্তুচ্যুতিই নিয়তি, দু'বছর পেরিয়েও সুদানের ভাগ্যলিপি বদলাচ্ছে না। দেশটিতে ঠিক দু'বছর আগে শুরু হয়েছিল গৃহযুদ্ধ। ক্রমাগত বোমাবর্ষণের কারণে, বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সুদানের আল-ফাশের। দেশজুড়ে বিভিন্ন শিবিরে বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসস্থল। সাংবাদিকদের পক্ষেও ওই শহরে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। আর এই সবকিছুই ঘটছে ক্ষমতাবানদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে। দেশটিতে সেনাবাহিনী এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের উপর আক্রমণ চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগ উভয়পক্ষই অস্বীকার করে এসেছে। স্পষ্ট হওয়া দরকার, কেন নিজের দেশেই উদ্বাস্তু হতে হচ্ছে সুদানের নাগরিকরা? কেন দেশটিতে নাগরিক স্বাধীনতা নেই? কেন নিজের দেশেই মানবধিকার সংকোচিত হচ্ছে?
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে, খার্তুমে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর দেশ জুড়ে এই সংঘাত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কটে পরিণত হয়। বহুদিন ধরেই সুদানের নাগরিকরা তাঁদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকেই এখন বিদেশে শরণার্থী হিসাবে আছেন। অনেকে সুদানের ভেতরেও আশ্রয় শিবিরে আছেন। দেশটির মধ্যে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে আছেন, মহিলারা ধর্ষনের শিকার হচ্ছেন।জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সি মেয়েরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০২৩ সালে শুধু এল-জেনেইনাতেই ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন।
অক্সফর্মের তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ মাসে যা হয়েছে :
* ইতিহাসে প্রথমবার কোনো একটি দেশে ৩ কোটিরও বেশি মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে হয়েছে।
* সুদানে বিশ্বের মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা সর্বোচ্চ। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে ৯০ লক্ষ মানুষকে। গত ২ বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ সহিংসতা থেকে পালিয়ে এসেছেন। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বৃহত্তম বাস্তুচ্যুতি সঙ্কটগুলির মধ্যে একটি।
* এখানে জরুরি অবস্থা বা ক্ষুধায় থাকা মানুষের সংখ্যা সর্বোচ্চ। অক্সফর্মের তথ্য অনুযায়ী, ৬০০,০০০ জনেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষে বাস করছেন এবং ৮০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কোনো রকমে জীবন কাটাচ্ছেন।
২০২৩ সালে সুদান ভয়াবহ জাতিগত হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী ছিল। এই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যরা গণহত্যা বলে উল্লেখও করেছিল। আরএসএফ যোদ্ধারা এবং তাদের মিত্র আরব মিলিশিয়ারা মাসালিতের মতো আরব নয় এমন জাতিগোষ্ঠীকে টার্গেট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরএসএফ গণহত্যা চালিয়েছে বলে এর আগে অভিযোগ তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি। এই অভিযোগ আরএসএফ অস্বীকার করেছে। শহরের ভেতরে ও বাইরে বেসামরিক নাগরিকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করে আরএসএফ। শহরটির দুর্ভিক্ষর পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে। দেশটিতে সূর্যাস্তের পর খুব কম মানুষই ঘরের বাইরে যান।
সামরিক বাহিনী কেন ক্ষমতায়?
সুদানে প্রায় দীর্ঘ ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন ওমর আল-বশির। ২০১৯ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। যেভাবে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন সেভাবেই তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তেও হয়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে যখন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছিল তখন ১৯৮৯ সালে আল-বশির ক্ষমতায় আসেন। ২০১১ সালে দেশটি ভাগ হয়ে যায়। এতে দক্ষিণ সুদানের জন্ম হয়। এর আগে পর্যন্ত সুদানই ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ। সে সময় রুটির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানাতে সারা দেশ জুড়ে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তখনই তিনি সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তবে তার শাসনের অবসানও দেশটিতে শান্তি আসেনি।
ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতা হারানোর পর দেশটি পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বর্তী সামরিক কাউন্সিল গঠন করা হয়। এই কাউন্সিল দু'বছরের জন্য দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ক্ষমতা গ্রহণের সময় তাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বেসামরিক গ্রুপ দেশটিতে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাতে থাকে। এই দাবি থেকেই বেসামরিক ও সামরিক- এই যৌথ নেতৃত্বে একটি সরকার ক্ষমতায় আসে। তাদের মধ্যে খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না। বিভিন্ন বিষয়ে দু'পক্ষের মধ্যে ঝামেলা বেধে যায়। এরপর ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আবার একটি অভ্যুত্থান হয় এবং সরকারকে উৎখাত করা হয়।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী এক সময় একে অপরের সহযোগী ছিল
সুদানে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এর পর থেকে দেশটিতে ক্ষমতায় রয়েছে জেনারেলদের একটি কাউন্সিল। কিন্তু পরে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই তৈরি হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ সেনাবাহিনী এবং আরএসএফ এক সময় একে অপরের সহযোগী ছিল। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা একসঙ্গে ক্ষমতায়ও আসে। বেসামরিক শাসনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই পরিকল্পনা কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত ছিল। মূলত কাউন্সিলের প্রধান দুই সামরিক নেতাকে ঘিরেই এই বিরোধ শুরু হয়। ওই দুই সামরিক নেতা হলেন- জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো।
জেনারেল আল-বুরহান সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং সে কারণে তিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট। আর জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো দেশটির উপ-নেতা কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের কমান্ডার। এই নেতা হেমেডটি নামেই বেশি পরিচিত। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার কিছুদিন আগেও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতা থেকে সরাতে এই দুই নেতা একসাথে জোট বেঁধে ছিল। সুদানে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানেও তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তবে অভ্যুত্থানের পর ভবিষ্যতে দেশটির ক্ষমতা নিয়েই মূলত এই দুই নেতার মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। বিশেষ করে সুদানের ভবিষ্যৎ এবং দেশটির বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাবনা নিয়ে তারা ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেন। অতীতে সুদানে বেসামরিক সরকার পুন-প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিও ব্যর্থ হয়।
রাজনীতিবিদদের মতে, এছাড়াও এই দুই জেনারেলের দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ - প্রথমত, এক লাখ সদস্যের র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা এবং দ্বিতীয়ত, নতুন এই বাহিনীর প্রধান কে হবেন। সামরিক বাহিনীতে আরএসএফ-এর একত্রে করার আলোচনায় মতবিরোধের থেকেই উত্তেজনা তৈরি হয়। এই আলোচনায় মূল প্রশ্ন ছিল- নতুন বাহিনীতে কে কার অধীনে কাজ করবেন? কে থাকবে ক্ষমতার প্রধান?
আরএসএফ কারা?
২০১৩ সালে এই আধা-সামরিক বাহিনীটি গঠিত হয়। এই বাহিনী নিয়ে সুদানের ভেতরে ও বাইরে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এই বাহিনীর শীর্ষে রয়েছে কুখ্যাত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপ। এই দলটি দাফুরের বিদ্রোহীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিল। এই গ্রুপের শীর্ষনেতা ছিলেন জেনারেল দাগালো। দলটি বহু আন্তর্জাতিক নিন্দা ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু এরপরও ওমর আল-বশির এই গ্রুপটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। দলটির নাম রাখা হয় বর্ডার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটস। পরে ধীরে ধীরে এই দলের সদস্যরা সুদানের গোয়েন্দা বিভাগের অংশ হয়ে ওঠে। কিছু বছর যেতে না যেতেই ওমর আল-বশির আরএসএফ বাহিনীটি গঠন করেন। তিনি নিজে এই বাহিনীর কার্যক্রম দেখাশোনা করতেন কিন্তু দলের প্রধান ছিলেন জেনারেল দাগালো। তিনি পরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরোধিতা করেন। আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি উপ-প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে জেনারেল দাগালো আরএসএফকে একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এরপর থেকেই খুব দ্রুত তাঁর ক্ষমতার উত্থান ঘটতে থাকে।
আরএসএফ বাহিনী ইয়েমেন ও লিবিয়ার সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি সুদানের বেশ কয়েকটি সোনার খনিও তারা তাদের দখলে নেয়। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় ১২০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছিল। সুদানের সেনাবাহিনীর বাইরেও এই ধরনের ক্ষমতাবান একটি বাহিনীর উপস্থিতিকেও সুদানের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে, জেনারেল আল-বুরহান কার্যত দেশটির নেতা। ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যূত করার সময় তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর ইন্সপেক্টর জেনারেল। দাফুর সংঘাষের সময় তিনি আলোচনায় আসেন এবং এই সময়েই তাঁর ক্ষমতার উত্থানও হয়।
উল্লেখ্য, সুদানে অপশাসন, সাধারণ মানুষের অধিকার হ্রাস, নারীর ওপর সহিংসতা বেড়েই চলেছে। দেশটিতে মানুষকে ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও মৃত্যুভয়ে বাঁচতে হচ্ছে। এই যুদ্ধ কবে থামবে? কবে নিজের দেশেই মুক্তি পাবে মানুষ?