শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ,নেপাল || বারবার গণবিক্ষোভ যা শেখাল
Nepal, Bangladesh and Sri Lanka Agitation: শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এক অভিন্ন সত্যকে সামনে এনেছে— কোনো গণ আন্দোলন হঠাৎ জন্ম নেয় না।
২০২২-২০০৫। একই চিত্রনাট্য যেন অভিনীত হলো ভারতের তিন প্রতিবেশী দেশে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা, গত বছর বাংলাদেশ, এবার নেপালে। বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতির বাসভবনে ঢুকে তান্ডব চালিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভবন তুলকালাম করার ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশেও বিক্ষুব্ধ জনতা শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বাসভবনে ঢুকে তান্ডব চালায়। এবারে নেপালেও তাই হল। একে একে সরতে বাধ্য হয়েছেন শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়া রাজাপক্ষ, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা, এখন কেপি শর্মা ওলি-কে। মায়ানমার এবং আফগানিস্তানেও একই সময়তটে বারবার অস্থিরতা তৈরি হলেও, চরিত্রের দিক থেকে এই এই তিনদেশের আন্দোলন অনেকটাই এক। ঠিক কী ঘটেছিল শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশে, এই আবহেই ফিরে পড়া যাক।
শ্রীলঙ্কা
গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কায় আর্থিক সঙ্কটের চরম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা স্বাধীন হয়েছে সাড়ে সাত দশক আগে। স্বাধীনতার পর থেকে বরাবরই কয়েকটি পরিবার দেশটির শাসনের ক্ষমতায় এসেছে। ভোট প্রচার দুর্নীতি, ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ-সহ আর্থিক টানাপোড়েনে শ্রীলঙ্কা গণ অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়। বিভিন্ন দেশের কাছে ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা নিজেকে ‘অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া’ ঘোষণা করেছিল। তারপর থেকেই প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষের ইস্তফার দাবি জোরদার হয়। এই পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের ১৩ জুলাই প্রবল জনরোষে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষে এবং তাঁর ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। এর আগে গত দুই দশক ধরে তাঁর পরিবারের শক্ত দখল ছিল শ্রীলঙ্কায়। এরপর গঠিত হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। তবে রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে জনগণের যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি অন্তর্বর্তী সরকারও।
বহু বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় সিংহলিদের মধ্যে রাজাপক্ষেদের বিরাট জনপ্রিয়তা ছিল। যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং গণমাধ্যমের উপর মারাত্মক সব হামলার অভিযোগও ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের অনেকেই তখন এসব নিয়ে কথা বলেনি। কিন্তু পুরো দেশ যখন সংকটে পড়ে তখন বিক্ষোভে সব জাতিগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়। বিবিসি-র তথ্য অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার কয়েক দশকের গৃহযুদ্ধে অন্তত এক লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছেন।
আরও পড়ুন- চিনের গোলামিই নেপালে কেপি ওলির পতন ডেকে আনল?
বাংলাদেশে
বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে- তিস্তা প্রকল্প, কোটা বিরোধী আন্দোলন, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পেনশন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকে টানা আন্দোলন ও অবরোধের মত কর্মসূচি শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে লেগে পড়েছিল বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবুও শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। অন্যদিকে, পড়ুয়াদের সন্ত্রাসবাদী ছকের অংশ বলে দাগিয়ে দিয়েছিল হাসিনা সরকার। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১,৪০০। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো আন্দোলনে এত কম সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
শেষে ৫ অগাস্ট সকাল থেকে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি শুরু হয়। অন্যদিকে, চলছিল সরকারের ঘোষিত কার্ফু। তবে কার্ফু-র তোয়াক্কা না করেই লক্ষ লক্ষ বিক্ষোভকারী রাজধানী ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল। শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন এই দিন। শেষ পর্যন্ত ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
নেপাল
নেপালে জেনারেশন জি-এর নেতৃত্বে কেপি শর্মা ওলি সরকারের দুর্নীতি ও সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদে নামেন হাজার ছাত্রছাত্রী। এই তরুণদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ৪ সেপ্টেম্বর। অনলাইনে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ক্রমেই ৮ সেপ্টেম্বর রাস্তায় নেমে আসে। কে পি ওলি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনেকদিন ধরেই সরব নেপাল। পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেও ক্ষোভ ছিলই। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করেছে। বিক্ষোভের পুরো ভাগে ছাত্রছাত্রীরা থাকলেও, এই বিক্ষোভে দক্ষিণ পন্থীরাও সামিল হয়েছেন বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
নেপাল সরকার ২৬টি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে তরুণ প্রজন্ম প্রতিবাদ শুরু করে। যার মধ্যে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউব রয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নথিভুক্ত না করার কারণে এই প্ল্যাটফর্মগুলি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় নেপাল সরকার। সরকার দাবি করে, এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। কিন্তু প্রতিবাদীরা এই সিদ্ধান্তকে কণ্ঠরোধ হিসেবে মনে করেন এবং সংগঠিত প্রতিবাদ দমনের জন্য সরাসরি সেন্সরশিপ হিসেবে দেখছে। নেপালে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৯ জনের মৃত্যুর পর দেশটিতে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-নেপালের গণ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ছায়া কতটুকু?
পুলিশ গুলি চালালে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। বিক্ষোভকারীরা একাধিক মন্ত্রীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। সহিংসতার জেরে সরকারের ভেতরে বিভাজন দেখা দেয়। একে একে নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ফলে ওলি শর্মার সরকার কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েন। কে পি শর্মা ওলিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এক অভিন্ন সত্যকে সামনে এনেছে— কোনো গণ আন্দোলন হঠাৎ জন্ম নেয় না। তার শিকড় থাকে বহু বছরের বঞ্চনা, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অর্থনৈতিক ব্যর্থতা এবং নাগরিক অধিকারের সংকোচনের ভেতরেই। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, বাংলাদেশে দমননীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-যুব সমাজের ক্ষোভ, আর নেপালে ডিজিটাল স্বাধীনতার উপর নিষেধাজ্ঞা— সব কিছুরই মূলে ছিল সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ-অসন্তোষ।
প্রতিবারই একটা সময় গিয়ে পরিস্থিতি এতটাই তীব্র হয়েছে যে, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা জনপ্রিয় ও ক্ষমতাবান নেতারাও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই এই তিন দেশের অভিজ্ঞতা শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রই নয়, বরং এক স্পষ্ট বার্তা দেয়, যতই শক্তিশালী হোক সরকার বা পরিবারতন্ত্র, জনগণের কণ্ঠরোধ করে দীর্ঘদিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। যখন বঞ্চিতরা ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তাঁদের আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ইতিহাস রচনা করে।

Whatsapp
