দুর্নীতি ঢাকতেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার গাজায় আক্রমণ নেতানিয়াহুর?
Netanyahu's Strike on Gaza: প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর দুর্নীতি মামলায় নির্ধারিত সাক্ষ্য দিতে পারবেন না, কারণ গাজায় আকস্মিক হামলার ফলে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হয়েছে।
ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ কী চায় তা আমরা জানি না, তবে তাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তাঁর দক্ষিণপন্থী জোট সরকার প্যালেস্তাইনে শান্তি নয়, বরং নরসংহারের পথই বেছে নিয়েছে। এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতেই ইজরায়েল হামাসের সঙ্গে সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে গাজা উপত্যকায় পূর্ণমাত্রায় গণহত্যা শুরু করেছে, কোনও প্ররোচনা ছাড়াই। দুই মাসের আপাত শান্তির পর যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হওয়ায় হতবিহ্বল প্যালেস্তিনিরা আবারও ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে প্রিয়জনদের বের করতে বাধ্য হচ্ছে এবং হাসপাতালের মর্গে নিহতদের জানাজা পড়তে শুরু করেছে। রাতারাতি ইজরায়েলি সেনাবাহিনী একের পর এক হামলা চালিয়েছে, যার ফলে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কমপক্ষে ৪১৩ জন প্যালেস্তিনি নিহত এবং ৫৬২ জন আহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে আরও লাশ উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে বাড়বে এবং ইজরায়েল এই হামলা অব্যাহত রাখবে— যাকে মাল্টার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট আবেলা 'বর্বর' আক্রমণ বলে নিন্দা করেছেন। এই বর্বরতার কোনও শেষই দেখা যাচ্ছে না, কারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে শুধু দুর্বল নিন্দা ছাড়া কোনও কার্যকর পদক্ষেপ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান এই সংঘাতে অন্তত দু'বার যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে এবং দুবারই তা ভঙ্গ করে ইজরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে গেছে। এই চুক্তিগুলোর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে কাতার, মিশর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের নভেম্বরে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে গাজায় বন্দি মুক্তি ও যুদ্ধবিরতির জন্য আরেকটি চুক্তিতে এই দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে, যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলকে বোমা সরবরাহ করে গাজায় গণহত্যা সফল করতে সহায়তা করেছে। ফলে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হলেও প্যালেস্তাইনে মৃত্যুমিছিল থামেনি। প্রায় প্রতিদিনই গাজার কোনও না কোনও অঞ্চলে ইজরায়েলি সেনারা মানুষ হত্যা করেছে।
আরও পড়ুন- রমজানে মৃত ৪১৩! যুদ্ধবিরতির মধ্যেও কেন গাজায় আবার হামলা ইজরায়েলের?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনে, ইজরায়েলি সেনাবাহিনী ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৮,৫৭৭ জন প্যালেস্তিনিকে হত্যা করেছে। ফেব্রুয়ারিতে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস মৃতের সংখ্যা জানিয়েছে ৬২,০০০। সেখানে হাজার হাজার নিখোঁজ প্যালেস্তিনিকে ধ্বংসস্তূপের নিচে মৃত বলে ধরা হয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সময় গাজা ইজরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলেও, ইজরায়েলি সেনারা হত্যা এবং চুক্তি লঙ্ঘন অব্যাহত রেখেছে। শত্রুতা বন্ধ করা কখনই ইজরায়েলের কৌশল ছিল না। মার্চের শুরুতে ইজরায়েল গাজায় সব মানবিক সাহায্য প্রবেশ বন্ধ করে দেয়—এ এমন একটি কৌশল যা জোরপূর্বক খিদেয় মারা এবং সুস্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ। অথচ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর জন্য হামাসকেই দায়ী করেছে, যারা বাস্তবে এটি করছে তাদের নয়।
রবিবার ভোর থেকে ইজরায়েল গাজার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায়। হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ৪০০-র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তির চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথম বড় আকারের হামলা এটি। চুক্তির প্রথম ধাপে ৪২ দিনের মধ্যে হামাস ৩৩ জন নারী, শিশু, ৫০ বছরের বেশি বয়সি বেসামরিক পুরুষ এবং 'মানবিক বিবেচনায়' রাখা কয়েকজন বন্দিকে মুক্তি দেয়। দ্বিতীয় ধাপে ২ মার্চ থেকে হামাসের আরও ২৪ জন জীবিত বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু নেতানিয়াহু এই আলোচনা স্থগিত করেন। কারণ, এতে ইজরায়েলকে গাজা থেকে পুরোপুরি সরে যেতে হতো, যা তাঁর কট্টর দক্ষিণপন্থী জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
এই হামলার আরেকটি তাৎক্ষণিক কারণ হলো, নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সংকট। মঙ্গলবার সকালে ইজরায়েলের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর দুর্নীতি মামলায় নির্ধারিত সাক্ষ্য দিতে পারবেন না, কারণ গাজায় আকস্মিক হামলার ফলে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হয়েছে। আদালতে শুনানি বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “কয়েক ঘণ্টা আগে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করেছে। আজ সকাল ১১টায় জরুরি নিরাপত্তা পরামর্শ অনুষ্ঠিত হবে।” এর আগেও তিনি যুদ্ধ পরিচালনার অজুহাতে শুনানি স্থগিত করেছেন। গত মাসে বিচারকরা তাঁর অনুরোধে সপ্তাহে তিন দিনের পরিবর্তে দুই দিন সাক্ষ্য গ্রহণের অনুমতি দিলেও, তিনি কখনই নিয়মিত উপস্থিত হতে পারেননি।
আরও পড়ুন-গাজার আশ্রয় শিবির, স্কুলে বারবার হামলা! নিরপরাধের ‘গণহত্যা’ই কি পাখির চোখ নেতানিয়াহুর?
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতি মামলা বিচারাধীন। মামলা ১০০০ ও ২০০০-এ প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ এবং মামলা ৪০০০-এ ঘুষ, প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ‘বেজেক-ওয়াল্লা’ মামলা, যেখানে তিনি টেলিকম কোম্পানি বেজেকের মালিককে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে ইতিবাচক সংবাদ কভারেজ পেয়েছেন। এই মামলার বিচার ২০২৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চলতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া দুর্বলই থেকে গেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টার্ক বলেছেন, ইজরায়েলি হামলা “ট্র্যাজেডির উপর ট্র্যাজেডি যোগ করবে।” নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জোনাস গাহার স্টোর এটিকে গাজার জনগণের জন্য “বড় ট্র্যাজেডি” বলেছেন। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার নিন্দা করেনি, বরং ইজরায়েলের সঙ্গে পরামর্শের কথা স্বীকার করেছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প “স্পষ্ট করে দিয়েছেন” যে হামাসকে এর মূল্য দিতে হবে।
ইজরায়েল-হামাস সংঘাতে শান্তির সম্ভাবনা ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে। যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের জন্য হামাসকে দায়ী করা হলেও, তারা বরং চুক্তি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছিল। বাস্তবে, ইজরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এই সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করছে, যার ফলে প্যালেস্তিনিরা প্রতিনিয়ত মৃত্যু ও ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছে।