ধ্রুপদী মর্যাদা পেল বাংলা ভাষা! নতুন প্রজন্মের কাছে সম্মান পাবে মাতৃভাষা?

Bengali Classical Language: বাংলার পাশাপাশি মারাঠি, পালি, প্রাকৃত এবং অসমিয়া এবার থেকে ধ্রুপদী ভাষা।

বাংলা প্রাণের ভাষা, বাংলা মাতৃভাষা আমাদের। এবার আমাদের বাংলাভাষা ধ্রুপদী ভাষাও! কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা আরও পাঁচটি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। বাংলার পাশাপাশি মারাঠি, পালি, প্রাকৃত এবং অসমিয়া এবার থেকে ধ্রুপদী ভাষা। মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তের ফলে, এমন বিশেষ মর্যাদা পাওয়া ভাষার সংখ্যা ৬টি থেকে বেড়ে হলো ১১। আগে তামিল, সংস্কৃত, তেলগু, কন্নড়, মালায়লাম এবং ওড়িয়া ভাষা ছিল ধ্রুপদী ভাষা। ২০০৪ সালে এই মর্যাদা পেয়েছিল তামিল ভাষা। শেষবার ২০১৪ সালে ওড়িয়া ভাষা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পায়।

এবার যে পাঁচটি ভাষা ধ্রুপদী মর্যাদা পেল, তার মধ্যে কয়েকটি ভাষাকে এই মর্যাদা দেওয়ার দাবি বহুদিন ধরেই ঝুলে ছিল। বিশেষ করে মারাঠি ভাষা। মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চভান ২০১৪ সালে এই উদ্দেশ্যে ভাষা বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। ওই প্যানেল জানিয়েছিল, মারাঠি ধ্রুপদী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার সমস্ত মানদণ্ডই পূরণ করেছে। সেই প্রতিবেদনটি কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হয়েছিল।

গত মাসের শেষে, কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ অভিযোগ করেন যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মারাঠিকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিকে উপেক্ষা করছেন। জয়রাম বলেছিলেন, "প্রধানমন্ত্রীর শাসনামলে, কোনও ভাষাকেই ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়নি। মারাঠি ভাষাকে ধ্রুপদী ঘোষণা করার জন্য ২০১৪ সালের ১১ জুলাই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চভান যে দাবিপত্র জমা দেন, গত দশ বছর ধরে সেই বিষয়ে কিছুই করেননি মোদি।" উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে সেই দাবি পূরণ হয়েছে।

আরও পড়ুন- বাংলা ভাষা বাঁচাতে বাংলাপক্ষ আদৌ প্রয়োজনীয়?

বাংলা ভাষাকে ভারতীয় ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "বাংলাকে অবশেষে ভারত সরকার একটি ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রকের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করছিলাম... আমরা অবশেষে ভারতের ভাষার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক শীর্ষে পৌঁছেছি।"

ভারতে অজস্র ভাষা। অসংখ্য উপভাষাও। এর মধ্যে কোন ভাষা ধ্রুপদী তা ঠিক করবে কে? কীভাবেই বা ভারতের ধ্রুপদী ভাষা নির্বাচিত হয়?

১। ১,৫০০-২,০০০ বছর সময়কালে ভাষার প্রাথমিক পাঠ্য/লিপিবদ্ধ ইতিহাসের প্রাচীনত্ব থাকতে হবে।
২। প্রাচীন সাহিত্য/পাঠের অংশ হতে হবে যা এই ভাষায় কথা বলা মানুষদের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাজিত ঐতিহ্য হিসাবে বিবেচিত হবে।
৩। কবিতা ছাড়াও গদ্য, লিপি এবং শিলালিপির প্রমাণ থাকতে হবে।
৪। ধ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্য তাদের বর্তমান ধাঁচ থেকে আলাদা হতে পারে বা তাদের শাখাগুলির পরবর্তী ধরনগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে।

আরও পড়ুন- শব্দকল্পদ্রুম আর আ মরি বাংলা ভাষা

পাঁচটি নতুন ধ্রুপদী ভাষার মধ্যে, অসমিয়া, বাংলা এবং মারাঠি ব্যাপকভাবে কথ্য। পালিতে ভারতের পাশাপাশি লাওস, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের কিছু অঞ্চলে কথা বলা হয়। এটি বুদ্ধের উপদেশের ভাষা। এলাহাবাদ এবং পাটনা সহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় এই ভাষা।

কোনও ভাষা যদি ধ্রুপদী মর্যাদা পায় তাহলে তার কী বিশেষত্ব ঘটে? সরকারি সূত্র অনুযায়ী, শিক্ষা মন্ত্রক ধ্রুপদী ভাষার প্রসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ করেছে। সংস্কৃতের প্রচারের জন্য তিনটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ক্লাসিক্যাল তামিল যেখানে প্রাচীন তামিল গ্রন্থের অনুবাদ, গবেষণার প্রচার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও তামিল ভাষা পণ্ডিতদের জন্য বিশেষ কোর্স পরানো হয়। মাইসুরুতে সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেসের অধীনে ধ্রুপদী কন্নড়, তেলগু, মালায়ালম এবং ওড়িয়াতে পড়াশোনার জন্য উৎকর্ষ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ধ্রুপদী ভাষায় কৃতিত্বের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য, এই ভাষা চর্চায় উত্সাহিত করার জন্য বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে। শুধু গবেষণায় নয়, এই ভাষার প্রাচীন গ্রন্থগুলির সংরক্ষণ, নথিবদ্ধ করা এবং ডিজিটাইজেশনের জন্য উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাও সরকারের উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্যতা কি নিতুন প্রজন্মের কাছে বাড়বে তাতে? যারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করেন, তাঁদের কাছে এই ভাষা প্রাণের ভাষা, সন্দেহ নেই। তার বাইরে যে বৃহৎ জগৎ, যেখানে অন্তত প্রতি ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা বাঁচাও বলে আর্তনাদ শোনা যায় সেইখানে বাংলার এই ধ্রুপদী হয়ে ওঠার গুরুত্ব কতখানি?

বাংলা ভাষা রোজের পাঠ্যবই থেকে সরেই গেছে বড় অংশের পড়ুয়াদের। রোজের কথাবার্তায় অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষার প্রয়োগ দেখে এখনও সকলেরই প্রায় কান-সওয়া হয়ে গেছে। রেডিওতে অদ্ভুত বাংলায় কথা বলেন জকিরা, অকারণে হিন্দি শব্দকে বাংলা ভেবে বলে ফেলেন কত কত মানুষ, বাংলা বই সন্তানকে কিনে দেন না কত কত বাবা মা! ভারতবর্ষের বিবিধ ভাষাচরিত্রে বাংলা ধ্রুপদী হলো কি হলো না, তাতে বাংলা ভাষার আয়ুর কি ক্ষয় বা বৃদ্ধি ঘটল আদৌ?

More Articles