জেএনইউ: যা ছিল, ক্রমে যা হলো
JNU: রাষ্ট্র যখন উচ্চশিক্ষাকে বাজারমুখী করছে, তখন জেএনইউ-এর এই পদক্ষেপ ছিল বৃহত্তর বৈষম্যের প্রতিফলন, যেখানে শিক্ষা আর অধিকার নয়, পণ্যে পরিণত হয়েছে।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়— একটি নাম, যা একসময় ভারতের মুক্তচিন্তা, যুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বোধের প্রতীক ছিল। গত এক দশকে এই প্রতিষ্ঠানটি যে সংকটের মধ্যে পড়েছে, তা কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বা নীতিগত ব্যর্থতা নয়; এটি এক বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রকল্পের প্রতিফলন, যার লক্ষ্য উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং মতবিরোধকে অপরাধে পরিণত করা। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানের পর যে কৃত্রিম ‘দেশবিরোধী’ বিতর্ক তৈরি করে ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ ও অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল— সেই ঘটনাই ছিল এই পরিকল্পিত আক্রমণের সূচনা। এরপর থেকে জেএনইউ-এর প্রতিটি স্তরে প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণ, স্বাধীন কণ্ঠের দমন, এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের সংস্কৃতি গেঁথে দেওয়া হয়েছে।
একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এমন একটি জায়গা, যেখানে দেশের সব প্রান্তের ছাত্রছাত্রীরা, বিশেষ করে গ্রামীণ ও সংরক্ষিত শ্রেণির তরুণ-তরুণীরা, স্বল্প খরচে উচ্চ মানের শিক্ষালাভ করতে পারত। আজ সেই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ২০১৯ সালে হোস্টেল ফি প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছিল, যার বিরুদ্ধে ছাত্রদের ব্যাপক আন্দোলন দমন করা হয়েছিল পুলিশি শক্তি দিয়ে। ফি বৃদ্ধির ফলে গরিব ও প্রান্তিক পরিবারের বহু শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। রাষ্ট্র যখন উচ্চশিক্ষাকে বাজারমুখী করছে, তখন জেএনইউ-এর এই পদক্ষেপ ছিল বৃহত্তর বৈষম্যের প্রতিফলন, যেখানে শিক্ষা আর অধিকার নয়, পণ্যে পরিণত হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি ২০১৬ থেকে জেএনইউ-এর উপর নেমে আসা সুসংগঠিত আক্রমণের ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠানটি আজ চরম দুর্দশার সম্মুখীন। সে'সময় জেএনইউ, এর শিক্ষককুল এবং শিক্ষার্থীদের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করার যে বিদ্বেষপূর্ণ অভিযান শুরু হয়েছিল, তা ছিল একটি সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার সূচনা মাত্র— যার লক্ষ্য ছিল এই প্রতিষ্ঠানের সেই প্রাণশক্তিকে শুষে নেওয়া যা এর অসাধারণ কৃতিত্বের ভিত্তি ছিল এবং যা দেশ ও বিশ্বজুড়ে একে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছিল। সেই আক্রমণের পর যা শুরু হয়েছে, তা হলো উপাচার্যের কার্যালয়কে কেন্দ্র করে 'ভেতর থেকে' প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে দুর্বল করার একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া। বর্তমান এবং পূর্ববর্তী উপাচার্য এই দায়ভার ভাগ করে নিয়েছেন। পুরনো ক্ষত শুকানোর আগেই প্রতিষ্ঠানের দেহে নতুন আঘাত হানা হচ্ছে– এককথায়, জেএনইউকে যেন তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। উপাচার্য এই প্রতিষ্ঠানের একজন প্রাক্তনী হওয়া সত্ত্বেও এমনটা ঘটছে। গত এক দশকে, 'সুশাসন' এবং 'নেতৃত্ব' শব্দ দুটি তাদের অর্থ হারিয়ে এক ভয়াবহ তাৎপর্য লাভ করেছে, যা কার্যত তাদের বিপরীত শব্দের সমার্থক হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন - বামেদের স্বার্থপর আকচা-আকচিতেই জেএনইউতে জমি পাচ্ছে এবিভিপি?
এক 'পাবলিক' প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেখানে জ্ঞান ও শিক্ষার অন্বেষণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সম্মিলিত জীবনের মাধ্যমে বিকশিত হতো, সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্রমশ উপাচার্যের ব্যক্তিসত্তার প্রকাশে পরিণত করা হয়েছে— এমন একটি ব্যক্তিগত জমিদারিতে (fiefdom) পরিণত করা হয়েছে যেখানে শুধুমাত্র সেই পদে আসীন ব্যক্তির নির্দেশই চূড়ান্ত। গণতান্ত্রিক স্ব-শাসন এবং সুশৃঙ্খল কার্যকারিতার ভিত্তি যে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম এবং সংবিধিবদ্ধ বিধান, তার প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা দেখিয়ে একটি কেন্দ্রীভূত, স্বেচ্ছাচারী এবং স্বৈরাচারী 'অপশাসন' চালু করা হয়েছে, যা কোনো প্রকার প্রশ্ন তোলাকে সহ্য করে না। বর্তমানে, উপাচার্যের নেতৃত্বে জেএনইউ প্রশাসন কার্যত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহারের মাধ্যমে কঠোর কৌশল, হেনস্থা এবং হয়রানির দ্বারা শিক্ষকদের দমন করার সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, জেএনইউ-এর শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন সময়ে আদালতের একাধিক রায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে বেআইনি বলেও ঘোষণা করেছে। এই দুটি প্রতি-শক্তিশালী কারণই জাতীয় সম্পদ, অর্থাৎ এমন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের প্রক্রিয়াকে ধীর করেছে, যার ইতিহাস একসময় উৎকর্ষ এবং সাম্যের সংমিশ্রণের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনাকে মূর্ত করেছিল।
জেএনইউ-এর অসাধারণ কৃতিত্ব এবং শিক্ষাগত উৎকর্ষ ও সামাজিক সাম্যের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক এর মূল ভিত্তি ছিল, তা ছিল মূলত গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত। এতে সেন্টার, স্কুল এবং সামগ্রিক ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে কমিটি, বোর্ড এবং কাউন্সিলগুলির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। এখানে ডিন এবং চেয়ারপার্সনরা অনেকাংশে 'সমানদের মধ্যে প্রথম' (first among equals) হিসেবে কাজ করতেন, যারা প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করতেন, প্রতিষ্ঠানটির উপর প্রভুত্ব করতেন না। কিন্তু গত এক দশকে এই শাসন কাঠামো সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। যে মডেলে উপাচার্য এখন 'বস' এবং শিক্ষকরা কার্যত অধিকারচ্যুত, তার প্রথম ও প্রধান ভিত্তি হল চেয়ারপার্সন এবং ডিন নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পালাক্রমে নিয়োগের দীর্ঘস্থায়ী, অনৈচ্ছিক প্রথাকে বাতিল করা। এর ফলে কলেজিয়েট কার্যকারিতা দুর্বল হয়েছে এবং সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলিতে শিক্ষকদের মতামতের প্রতিফলন কমেছে। শুধুমাত্র উপাচার্যের খেয়াল-খুশিতে এই ধরনের নিয়োগগুলি করা হয়েছে একমাত্র এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে কোনো স্বাধীন মতামতের কণ্ঠরোধ করা যায় এবং আনুগত্যের সংস্কৃতি তৈরি করা যায়। এর ফলে বহু যোগ্য অধ্যাপককে সুযোগ না দিয়ে বাইপাস করা হয়েছে, এমনকি কেউ কেউ এই পদগুলি না পেয়েই অবসর নিয়েছেন। এছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলির ভূমিকা সীমিত করে সেগুলিকে নামমাত্র অনুমোদনের প্ল্যাটফর্মে পরিণত করা হয়েছে। উপাচার্য, কার্যনির্বাহী ও একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থপূর্ণ আলোচনাকে একেবারেই অনুমোদন দেন না। কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতেও ফিজিক্যাল মিটিং-এ না ফিরে অনলাইনে বৈঠক করার অভ্যাস বজায় রয়েছে, যা আন্তরিক আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার একটি সুবিধাজনক উপায় মাত্র। সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলির বৈঠক সংখ্যাও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মাবলীর তুলনায় কম হয়েছে; যেমন, চারটির পরিবর্তে মাত্র নয়টি নিয়মিত বৈঠক হয়েছে এবং জরুরি বৈঠকের সংখ্যা (১৭টি) নিয়মিত বৈঠকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার ফলস্বরূপ অত্যন্ত গুরুতর বিষয়গুলিতেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন, কোনো পূর্বের নথি ছাড়াই আর্থিক কমিটি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুমোদিত হয়েছে। জেএনইউ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (JNUTA)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরে তফসিলি জাতি (এসসি) এবং তফসিলি উপজাতি (এসটি) শিক্ষার্থীদের ভর্তির সংখ্যা বাধ্যতামূলক সংরক্ষণ স্তরের নীচে নেমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১-২২ এবং ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে এসসি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১,৫০০ থেকে ১,১৪৩-এ এবং এসটি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৪১ থেকে ৫৪৫-এ নেমে এসেছে। এটি জেএনইউ-এর মূলনীতি— সামাজিক সাম্যের সঙ্গে উৎকর্ষের সংমিশ্রণ থেকে সরে আসার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। একইসঙ্গে, ২০১৬-১৭ সালে যেখানে গবেষণার (এম.ফিল/পি এইচ ডি) জন্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫,৪৩২, সেখানে ২০২৪-২৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩,২৮৬-এ। এর পাশাপাশি, ২০১৭-১৮ সালে যেখানে শিক্ষাখাতে ব্যয় ছিল ৩৮.৩৭ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৪-২৫ সালে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে ১৯.২৯ কোটি টাকা হয়েছে, যা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে প্রশাসনের অগ্রাধিকার শিক্ষা ও গবেষণার পরিবর্তে অন্য দিকে সরে গেছে। নতুন পিএইচডি অর্ডিন্যান্স স্কুল ও সেন্টারগুলির মতামত ছাড়াই গৃহীত হয়েছে এবং তা অবৈধভাবে পূর্ববর্তী শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা চলছে। স্বীকৃতি ফির বিনিময়ে বাইরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কোর্সকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটিয়েছে এবং উচ্চশিক্ষার বেসরকারীকরণের হাতিয়ার হয়েছে। শিক্ষাবর্ষের ক্যালেন্ডার এখনও জাতীয় পরীক্ষা সংস্থা (এনটিএ)-এর উপর নির্ভরশীল, যার ফলস্বরূপ বিভিন্ন ব্যাচের মধ্যে শিক্ষাবর্ষের সময়ের কোনো মিল নেই। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে CUET বাধ্যতামূলক নয় এবং উপাচার্য নিজেও এনটিএ -এর MCQ পদ্ধতির উপযুক্ততা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, তবুও জেএনইউ-এর ভর্তি প্রক্রিয়া এনটিএ -এর হাতেই রয়ে গেছে। এমনকি পিএইচডি-তে ভর্তির ক্ষেত্রে ইউজিসি-নেট স্কোর ব্যবহার করার সিদ্ধান্তও কোনো একাডেমিক কাউন্সিলের আলোচনা ছাড়াই নেওয়া হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করার এক জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
আরও পড়ুন- এসআইআর শেষে বিহারের চূড়ান্ত ভোটার লিস্ট: অজস্র অসঙ্গতির উত্তর নেই
শিক্ষকদের কর্মজীবনের অগ্রগতি প্রকল্প (সিএএস) গত উপাচার্যের আমলে নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল, আর নতুন উপাচার্যের অধীনে এটি 'গাজর ও লাঠি' (carrot and stick) নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশাল সংখ্যক আবেদন (১১২টিরও বেশি) জমে রয়েছে, এবং প্রক্রিয়াটি কার্যত স্থবির হয়ে গেছে। প্রক্রিয়াটি নির্বাচনের মাপকাঠিতে অত্যন্ত ধীর এবং বেছে বেছে ও উদ্দেশ্যমূলক ভাবে করা হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রাপ্য পদোন্নতিগুলিতেও বেছে বেছে ও ইচ্ছামতো তারিখ পরিবর্তন করে বা পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্যেষ্ঠতা অস্বীকার করে হয়রানি করা হচ্ছে। অতীতে যাদের চাকরির মেয়াদ গণনার সুবিধা কার্যনির্বাহী পরিষদ দ্বারা অনুমোদিত ছিল, তাদেরও সেই সুবিধা পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি হাইকোর্ট কর্তৃক স্থগিতাদেশ পাওয়া ৪৯জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের চার্জশিটকেও অবৈধ ভাবে পদোন্নতি আটকে রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, ২০১৮ সালের একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য ৪৫জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তার আইনি মামলার সময়ে দেখা গেছে যে কয়েকজন শিক্ষক মামলা থেকে সরে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার পরই তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই ঘটনা শিক্ষকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে ভিন্নমতকে দমন করার এক উদাহরণ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ৩২৬টি শূন্যপদের মধ্যে ১৩৩টিতে, অর্থাৎ ৪০ শতাংশের বেশি পদে, 'উপযুক্ত প্রার্থীর অভাব' ঘোষণা করা হয়েছে, যার মধ্যে সংরক্ষিত পদের সংখ্যাই সর্বাধিক। এমনকি যোগ্য অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদেরও 'অভ্যন্তরীণ প্রার্থী' হওয়ার অজুহাতে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এ ছাড়াও শিক্ষকদের হয়রানি ও নিপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। উপাচার্যের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী নতুন শিক্ষকদের প্রবেশন পিরিয়ডকে নির্বিচারে এবং অবৈধ ভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। তরুণ শিক্ষকদের নিশ্চিতকরণকে বিলম্বিত করে এবং শেষ পর্যন্ত একজনকে টার্মিনেট করে প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার চরম প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রেও আদালতের হস্তক্ষেপ প্রমাণ করে যে উপাচার্যের সিদ্ধান্ত আইনি যাচাইয়ে টিকে থাকতে পারেনি। এক তরুণ শিক্ষকের 'অবৈধ' টার্মিনেশন আদেশের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের ফলে প্রশাসনকে তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বা স্থগিত রাখতে বাধ্য হতে হয়েছে, যা উপাচার্যের একতরফা ও প্রতিহিংসামূলক আচরণের বিরুদ্ধে একটি বড় প্রমাণ। এদিকে, গুরুতর যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত অধ্যাপকদের বিরুদ্ধেও প্রশাসন দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থী ইউনিয়ন দাবি করেছে যে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় নির্যাতিতা ছাত্রীরা ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, যা শিক্ষাঙ্গনের নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচারের পরিবেশকে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই সকল ঘটনায় প্রশাসনের 'আইনহীনতা' এবং 'ক্ষমতার অপব্যবহার'-এর অভিযোগে আজ জেএনইউ একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে— কী ভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে ধ্বংস করা যায়। একসময় যে জায়গায় অধ্যাপক জি. পার্থসারথি, অধ্যাপক মুনিস রাজা ও অধ্যাপক যশ পাল-এর মতো শিক্ষাবিদেরা, রোমিলা থাপার-এর মতো ইতিহাসবিদরা জ্ঞানের স্বাধীনতার পতাকা বহন করতেন, সেখানে আজ নীরবতা। তবু প্রতিরোধের স্ফুলিঙ্গ এখনও বেঁচে আছে— শিক্ষক, ছাত্র ও আদালতের কিছু সাহসী কণ্ঠে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই লড়াই কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বের লড়াই নয়, এটি ভারতের গণতান্ত্রিক বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু পাঠদান নয়; এটি এমন এক পরিসর, যেখানে জাতির চিন্তা, প্রশ্ন ও বিবেকের বিকাশ ঘটে। সেই চিন্তাকে যদি দমন করা হয়, তবে ক্ষতি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের নয়— ক্ষতি পুরো সমাজের। আজ তাই প্রশ্ন একটাই: আমরা কি এমন এক ভবিষ্যৎ চাই, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রশাসনের অফিসে পরিণত হবে, আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভয়ে নীরব থাকবেন? নাকি আমরা সেই পুরনো জেএনইউ-এর চেতনাকে ফিরিয়ে আনব— যেখানে যুক্তি, ন্যায় ও সাহস একসঙ্গে শিক্ষা নামের সেই মানবিক মুক্তির পথে আলো দেখাত?
লেখকের মতামত ব্যক্তিগত।
Whatsapp
