নোবেলজয়ীদের সোনালি পোর্ট্রেটের নেপথ্যনায়ক! চেনেন এই গুণী শিল্পীকে?
Niklas Elmehed: নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে গত বারো বছর ধরে জুড়ে রয়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন অজানা, অচেনা এক তারকা, যার তুলির টানে আশ্চর্য মায়াবী হয়ে বিশ্বের কাছে ধরা দেন প্রত্যেক নোবেলজয়ী।
অক্টোবর মানেই নোবেলের মাস। প্রতিবছরের মতো এ বছরও প্রায় সব কটি শাখায় নোবেল পুরস্কার ঘোষণা সারা। অর্থনীতি, মেডিসিন, পদার্থবিদ্যা থেকে শুরু করে রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তি, সব কটি বিভাগের চলতি বছরের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আগামী ১০ ডিসেম্বর, আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকির দিনই বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে স্মারক ও অর্থপুরস্কার। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার খবর ইন্টারনেটে খুঁজলেই চোখে পড়ছে নোবেলজয়ীদের সোনালি সব পোর্ট্রেট। প্রায় প্রতিটি ছবির আঁকার ধরণ একই রকম। গত কয়েক বছর ধরেই নেটদুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায় এই ছবিগুলি। সোনালি আর কালো রঙে আঁকা প্রতিটি পোর্ট্রেটে ছলকে ওঠে শিল্পীর স্বকীয়তা। কে আঁকেন এই সব ছবি? গত কয়েক বছর ধরে আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স বা এআই কাঁপাচ্ছে দুনিয়া। এবারের নোবেলের মঞ্চেও একাধিক শাখার পুরস্কৃত কাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই এআইয়ের দাপট। এই সব পোর্ট্রেটের নেপথ্যেও কি আদতে এআইয়ের কামাল, নাকি রয়েছেন রক্তমাংসের শিল্পী-হাত?
নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে গত বারো বছর ধরে জুড়ে রয়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন অজানা, অচেনা এক তারকা, যার তুলির টানে আশ্চর্য মায়াবী হয়ে বিশ্বের কাছে ধরা দেন প্রত্যেক নোবেলজয়ী। তিনি নিকোলাস এলমেহেদ। সুইডেনের এই শিল্পী সেই ২০১২ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার মিডিয়ার জন্য কাজ করা শুরু করেন। সমস্ত নোবেলজয়ীদের প্রতিকৃতি তৈরি করার গুরুদায়িত্ব বর্তেছে নিকোলাসের ঘাড়েই।
আরও পড়ুন: মেশিন লার্নিংয়ের বাঁক বদল! গণিতে নয়, পদার্থবিদ্যায় কেন নোবেল পেলেন হিন্টন?
২০১২ সালের আগে এদিক-ওদিক থেকে পাওয়া বিজয়ীদের ছবিগুলি একত্রিত করে প্রকাশ করত নোবেল কমিটি। যেগুলোর বেশিরভাগই ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা। ফলে সেগুলির মধ্যে কোনও তেমন কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যেত না, যা নোবেলজয়ীদের বিশ্বের সামনে আলাদা মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে পারে। সেখান থেকেই আসে, পোর্ট্রেট আঁকানোর ভাবনা। ২০১৯ সালে 'পপুলার সায়েন্স'-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে নিকোলাস জানান, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যেত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের তেমন ভালো মানের ছবি ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনওটা খারাপ ক্যামেরায় তোলা, কোনওটায় বা মুখ পরিষ্কার নয়। সেখান থেকেই নোবেল বিজয়ীদের পোর্ট্রেট আঁকার কাজ শুরু করেন নিকোলাস। তবে যে সে পোর্ট্রেট হলেই হল না, সেই চিত্রগুলি এমন হতে হবে, যা দেখলেই নোবেল পুরস্কারের কথা মনে পড়ে যায়।
প্রাথমিক ভাবে বিষয়টি ছিল এরকম যে যেসব নোবেলজয়ীর ছবি নেটবিশ্বে পাওয়া যাবে না, তাঁদের ছবিগুলিই আঁকবেন নিকোলাস। প্রথম বছর হয়েও ছিল এমনটাই। তবে পরে নোবেল কমিটির মিডিয়া শাখা বুঝতে পারে, বেশ দিব্যি দেখাচ্ছে ছবিগুলি। এবং সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিটি ছবি অঙ্কনের মধ্যে যে মিল, রঙের ব্যবহার, তা নোবেল পুরস্কারের গুরুত্বকে আরও ভালো ভাবে তুলে ধরতে পারছে। এর পরে নিকোলাসকে প্রত্য়েক নোবেলজয়ীর ছবি আঁকার বরাত দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতি বছর সেই পরম্পরা চলছে। তবে এই যে সোনালি-কালো তুলির আঁচড়ে প্রত্যেক নোবেলজয়ীর স্কেচ আঁকা হয়, এই রং ব্যবহারের নেপথ্যেও রয়েছে বিশেষ কারণ।
চলতি বছর, চিকিৎসা বিজ্ঞান তথা মেডিসিন শাখায় নোবেল পেয়েছেন মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর অ্যামব্রোজ ও গ্যারি রুভকুন। মাইক্রো আরএনএ আবিষ্কার ও পোস্ট ট্রান্সক্রিপশনাল জিন নিয়ন্ত্রণে তাঁদের গবেষণার জন্য। নিউরাল নেটওয়ার্ক-সহ মেশিন লার্নিংয়ে মৌলিক আবিষ্কারের জন্য যৌথ ভাবে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল জিতে নিয়েছেন মার্কিন বিজ্ঞানী জন হোপফিল্ড ও ব্রিটিশ-কানাডিয়ান বিজ্ঞানী জিওফ্রে হিন্টন। রসায়নে নোবেল পেয়েছেন তিন জন। বিজ্ঞানী ডেভিড বেকার, জন এম জাম্পার ও বিজ্ঞানী ডেমিস হ্যাসাবিস। কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইন ও প্রোটিন স্ট্রাকচার প্রেডিকশন নিয়ে গবেষণার জন্য। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখিকা হ্যান ক্যাং এবং অর্থনীতিতে যৌথ ভাবে নোবেল পেয়েছে তুর্কি-আমেরিকান অর্থনীতিবিদ ড্যারন অ্যাসেমোগলু, সাইমন জনসন ও জেমস এ রবিনসন। বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ঔপনিবেশিকতা ও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব নিয়ে তাঁদের কাজ। এবার শান্তিতে নোবেল কোনও ব্যক্তি নয়, পেয়েছে জাপানের সংগঠন নিহন হিডানকিও। পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব অর্জনের প্রচেষ্টার জন্য তাদের এই সম্মান দিয়েছে নোবেল কমিটি।
আরও পড়ুন: পেলব অথচ নৃশংস! কেন পড়তেই হবে নোবেলজয়ী হ্যান কাং-এর লেখা?
এই সংস্থার ছবি আঁকতে গিয়ে নিকোলাস সোনালি-কালোয় এঁকেছেন একটি কাগজের ঘুঘু। যেটি সংগঠনটির লোগোর প্রতিনিধিত্ব করছে। ২০১৭ সাল নাগাদ নোবেল কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, নিকোলাসের আঁকা প্রতিটি স্কেচের মূল রংটি হবে সোনালি। নোবেলের রংয়ের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখেই এই রংটি নির্বাচন করা হয় বলে ধারণা। আদতে কালো বর্ডার দিয়ে আঁকা ছবিগুলিতে আঠা দিয়ে বিশেষ একটি পাতলা সোনালি ফয়েল পোর্ট্রেটে আটকে দেন শিল্পী, যা ওই চূড়ান্ত ছবিটি তৈরি করে দেয়। এতগুলো বছরে যেন নোবেল পুরস্কার মানেই হয়ে উঠেছে নিকোলাসের আঁকা ওই সোনালি-কালোর বিজয়ী-পোর্ট্রেট। নোবেলজয়ীরা সামনে আসেন, তাঁদের ওই সোনালি পোর্ট্রেট ঘুরে বেড়ায় নেটদুনিয়ায়। নেপথ্যে থেকে যান নিকোলাস। যাঁর তুলির টান ছাড়া আজ নোবেল পুরস্কার ঘোষণার কাজ অসম্পূর্ণ বললেও বোধহয় খুব ভুল হয় না।