সব অভিযোগই ছিল ভুয়ো? ঋণে কোনও প্রতারণা নেই, প্রণয়-রাধিকাকে ক্লিনচিট সিবিআইয়ের!

NDTV CBI Investigation: সিবিআই জানাচ্ছে, “আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে ৮৩টি ঋণ অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়েছে। সুদের হার হ্রাস করা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।

এনডিটিভির প্রতিষ্ঠাতা প্রণয় এবং রাধিকা রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং জালিয়াতির মামলা বন্ধ করে দিয়েছে সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন। না, প্রমাণের অভাবে নয়। সমস্ত অভিযোগে প্রণয়-রাধিকাকে সম্পূর্ণ ক্লিন চিট দিয়েছে সিবিআই৷ অভিযোগ ছিল, ৩৭৫ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ICICI ব্যাঙ্ককে প্রতারণা ও জালিয়াতির ষড়যন্ত্র করেছেন এনডিটিভির প্রতিষ্ঠাতারা। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া সেই ফৌজদারি তদন্ত অবশেষে বন্ধ করল সিবিআই। ২০২২ সালে, রাধিকা রায় ও প্রণয় রায়ের পদত্যাগের পর আদানি গ্রুপ এনডিটিভির দখল নেয়।

দ্য ওয়্যার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সিবিআই-এর তদন্তে দেখা গেছে যে, আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক রাধিকা রায় ও প্রণয় রায়ের সংস্থা মেসার্স আরআরপিআর হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেডকে যে ৩৭৫ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে, সেই ক্ষেত্রে কোনও ভুল ছিল না। যে ঋণটি তখন ব্যাঙ্কিং আইন লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছিল, পরে সিবিআইয়ের তদন্তে দেখা গেছে তা একটি স্বাভাবিক ব্যবসায়িক লেনদেনই ছিল।

ওই একই সময়ে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক এমনই যা যা ঋণ দিয়েছে তা বিশ্লেষণ করে সিবিআই তদন্তের রিপোর্টে লিখেছে, "এটি (এনডিটিভির ঋণ) কোনও বিচ্ছিন্ন মামলা ছিল না। আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক অন্যান্য এমন একই গোত্রীয় নানা কোম্পানিকেই এই ধরনের ঋণের সুবিধা দিয়েছে।" সিবিআই জানাচ্ছে, প্রায় ৩০টি ক্ষেত্রে এভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে আরবিআই-ও স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে এই ধরনের বেশ কয়েকটি ঋণ ব্যাঙ্ক তখন মঞ্জুর করেছিল।

বলা হয়েছে, “ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্টের ১৯(২) ধারা এবং আরবিআই-এর ২৮.০৮.১৯৯৮ তারিখের মূল নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে, আরবিআই স্পষ্ট করেছে যে, যেহেতু আরবিআই নির্দেশিকাতে কর্পোরেট শেয়ারের প্রাথমিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অগ্রিম ঋণ প্রদানে বাধা দেওয়ার কথা বলা নেই তাই NDU-POA ব্যবস্থার অধীনে ঋণের অনুমোদনের পরিমাণ নিয়ে কিছু নির্দিষ্ট বলা নেই। ২০০৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত NDU-POA ব্যবস্থার অধীনে ব্যাঙ্ক প্রায় ৩০টি ক্ষেত্রে ঋণ দিয়েছে এবং সেই ৩০ জন ঋণগ্রহীতার মোট ঋণ ছিল ১৫০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। উপরন্তু ব্যাঙ্ক NDU-POA-এর অধীনে ৬৫ জন ঋণগ্রহীতাকে টাকাও দিয়ে সাহায্য করেছে।”

আরও পড়ুন- যুগে যুগে দেশের শত্রু নির্ভীক সাংবাদিকতাই?

'NDU-POA' হচ্ছে 'নন-ডিসপোজাল আন্ডারটেকিং-পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি'। এটি একটি চুক্তি যা শেয়ারহোল্ডারদের কোনও একটি কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করতে বাধা দেয়।

প্রণয় রায়, রাধিকা রায়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ ছিল যে তাঁরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়ার কাছে শেয়ারের অঙ্গীকার সম্পর্কে কোনও তথ্য জানাননি। সিবিআই তার প্রতিবেদনে বলছে, এই বিষয়ে সেবির প্রাসঙ্গিক ধারাটি পরে যুক্ত করা হয়েছিল এবং সেই নিয়মের অধীনে রাধিকা এবং প্রণয় রায়রা নিজেরাই যে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন তাতে এই ধরনের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, “সেবি ০৪.০৮.২০১৭ তারিখে একটি চিঠির মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেয় যে বন্ধক রাখা শেয়ারের ফোরক্লোজারের বিধানটি সেবি (SAST) রেগুলেশন ১৯৯১-এ ঢোকানো হয়েছিল যা ২৮.০১.২০০৯ থেকে লাগু হয় এবং যেহেতু এই ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিটি ২০০৮ সালে করা হয়েছিল এবং বিধিটি ২০০৯ সালে যুক্ত হয়েছিল, তাই SEBI (SAST) প্রবিধানের অধীনে ফোরক্লোজারের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়৷ তাই NDU-POA ব্যবস্থার অধীনে ঋণ সুরক্ষিত করার চুক্তি করার জন্য SEBI-র কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না।"

তৃতীয় অভিযোগ ছিল যে, এনডিটিভির প্রতিষ্ঠাতারা শেয়ারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অনুমতিও নেয়নি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা বলছে, এই অনুমতিরও প্রয়োজন ছিল না। প্রতিবেদনে সিবিআই লিখেছে, “০৪.০৭.২০১৭ তারিখের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের চিঠি অনুসারে, নীতি নির্দেশিকা অনুসারে কোম্পানিকে কোনও আর্থিক কোম্পানির সঙ্গে শেয়ারহোল্ডিংয়ের জমানতের অঙ্গীকারের বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।”

আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কে প্রাক-ঋণপ্রদানের বিষয়ে কম সুদের হারের ক্ষেত্রে সিবিআই বলছে, “মেসার্স আরআরপিআর নিয়মিতভাবে ব্যাঙ্কে ঋণ পরিশোধ করছিল না... আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের পরিচালনা কমিটি ডিএসআরএ (ডেট সার্ভিস রিজার্ভড অ্যাকাউন্ট) ব্যালেন্স কমিয়ে ৯ মাসের সুদের পরিবর্তে ৬ মাসের সুদের সমতুল্য করার প্রস্তাব করেছে এবং এই কমিয়ে দেওয়া সুদের ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব ক্রেডিট কমিটির দ্বারা অনুমোদিতও হয়েছে।”

আরও পড়ুন- পরোয়া করেননি সরকারের রক্তচক্ষু! এনডিটিভি আদানির দখলে যাওয়ার পর কী করবেন রবীশ কুমার?

সিবিআই জানাচ্ছে, “আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে ৮৩টি ঋণ অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়েছে। যেহেতু সুদের হার হ্রাস করা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, তাই আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কে পরিশোধের জন্য RRPR-এর প্রস্তাব গ্রহণও কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।"

এনডিটিভির প্রতিষ্ঠাতারা, মেসার্স আরআরপিআর-এর মাধ্যমে আইন লঙ্ঘন করে মেসার্স ভিসিপিএল থেকে ঋণ নিয়েছিলেন এই অভিযোগে, সিবিআই জানাচ্ছে, এই আইনটিও ঋণ নেওয়ার অনেক পরে কার্যকর হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, "মেসার্স ভিসিপিএল ২১.০৭.২০০৯ তারিখের একটি ঋণ চুক্তির অধীনে ০৫.০৮.২০০৯ তারিখে মেসার্স আরআরপিআর-এ ৩৫০ কোটি টাকা পাঠিয়েছে এবং ২৫.০১.২০১০ তারিখের ঋণ চুক্তির ভিত্তিতে মেসার্স শেনানো রিটেল প্রাইভেট লিমিটেড, রিলায়েন্স স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, রিলায়েন্স ভেঞ্চারস লিমিটেড ইত্যাদি কোম্পানিগুলির মাধ্যমে ৫৩.৭৫ কোটি টাকা পাঠিয়েছে। ব্যাঙ্কিং কোম্পানি, আর্থিক কোম্পানি, বীমা কোম্পানি, সরকারি কোম্পানি ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনও কোম্পানির দুই স্তরের বেশি ভর্তুকি থাকবে না এমন নিয়ম ভারতের কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের ক্ষেত্রে ২১.০৯.২০১৭ তারিখের গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।"

আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের ৪৮ কোটি টাকার ক্ষতি এবং এনডিটিভির প্রোমোটারদের লাভের বিষয়ে, সিবিআই জানাচ্ছে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের কোনও সরকারি কর্মচারী বা অফিসারদের বিরুদ্ধে কোনও যোগসাজশ বা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বা আনুষ্ঠানিক পদের অপব্যবহার এখানে হয়নি। ২০০৯ সালের ৫ অগাস্ট অনুমোদিত সুদের হার ১৯% থেকে কমিয়ে ৯.৬৫% করা হয়েছিল। ঋণ গ্রহীতার অক্ষমতা, সময়মতো অর্থ প্রদান, NDTV-এর ক্রমাগত দুর্বল আর্থিক কার্যকারিতা, শেয়ারের দামের অস্থিরতা ইত্যাদির বিভিন্ন কারণের উপর ভিত্তি করে ঋণ পরিশোধ করা হয়েছিল। সেই হিসেবে, সুদের হারের এই ধরনের হ্রাস আকস্মিক কোনও ঘটনা ছিল না। অর্থাৎ রাধিকা রায় ও প্রণয় রায়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলির কোনও ভিত্তিই নেই।

More Articles