সরকারি চাকরি নয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যদের, নিষিদ্ধ ঘোষণার পরে আরও কড়া ইউনূস সরকার
Bangladesh Chhatra League: শুধু যে ছাত্র সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ হল বাংলাদেশ লীগ, তা-ই নয়। ঘোষণা করে দেওয়া হল, নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনও সদস্য বাংলাদেশে আর কোনও সরকারি চাকরি করতে পারবেন না।
কিছু দিন আগেই বড়সড় বদল এসেছে বাংলাদেশে। ছাত্রদের নিয়ে শুরু হয়েছিল যে কোটা সংস্কার আন্দোলন, তা বিরাট আকার ধারণ করে গণআন্দোলনের রূপ নিতে দেরি হয়নি। কার্যত দেশের সরকারকেই উৎখাত করে ফেলতে সফল হয়েছিল সেই দেশের গণজাগরণ। আপাতত বাংলাদেশে ক্ষমতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূস। দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে আওয়ামী লীগের নেত্রী তথা বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাভাবিক ভাবেই দেশে কোণঠাসা হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরাও। এমনটাই হয়ে এসেছে সর্বদা। পাকিস্তানেও ইমরান সরকার পতনের পর একই পরিস্থিতি হয় তাঁর দল পিআইএল-এর। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। দু'দিন আগেই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই ঘোষণা করা হয়। যার জোরে বাংলাদেশের ছাত্রলীগের কোনও সদস্যের বন্ধ হয়ে গেল সরকারি চাকরি করার পথ। সম্প্রতি সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকার। বুধবার সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার বিজ্ঞপ্তি সামনে আসার পরেই বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে এ কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারের উপর চাপ বাড়িয়েছিল ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে। এমনকী সময়ও বেঁধে দেয় তারা। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই ২৩ অক্টোবর নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় সংগঠনটিতে। আওয়ামী লীগের এই ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ তাদের। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে,'বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনকালে (হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়) হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন-সহ নানা জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল আওয়ামী লীগের শাখা সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর পদত্যাগ, আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনকে জঙ্গি তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করা-সহ ৫ দফা দাবি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মঙ্গলবার দুপুর থেকে নতুন করে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেছিল ঢাকায়। সেই সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবন-এর বাইরে অবস্থান ঘিরে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের একাংশের সংঘর্ষও হয়। এর পরে বুধবার আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন: মুজিবের বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ! ৭৬ বছরের সংগঠন কেন নিষিদ্ধ করল সরকার?
নতুন করে বিপদ বাড়াতে চায়নি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তড়িঘড়ি তাদের দাবি মেনে নিয়ে নিষিদ্ধ করা হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। ঠিক যেভাবে, যে আইনের আওয়ামী লীগ গত ১ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল চলতি বছরের অগস্ট মাসে, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হল এবার আওয়ামী লীগের ছাত্রশাখা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য গায়ে লেগে রয়েছে যে ছাত্রলীগের, তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইউনূস সরকারে জানিয়েছে, ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী এই পদক্ষেপ। ওই আইনের তফসিল-২–এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ তালিভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি, এ সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসবাদী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া, গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষের উপর ‘উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ’ চালিয়ে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন বলে জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। দাবি করা হয়েছে, সরকারের কাছে এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। এমনকি গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। তেমন অভিযোগও রয়েছে ইউনূস সরকারের হাতে।
১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তখন অবশ্য তার নাম ছিল র্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ। এর প্রথম আহ্বায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন নঈমুদ্দিন আহমেদ , সাধারণ সম্পাদক হন খালেক নওয়াজ খান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ওই বছরই আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মতো একাধিক বড় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এই ছাত্রসংগঠন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তারা। সে সময় ছাত্রলীগের একটি অংশ আবার রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র শাখায় পরিণত হয়। এ হেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই নব্বইয়ের দশক থেকে উঠতে শুরু করে ধর্ষণ, যৌন সহিংসতার মতো একাধিক গুরুতর অভিযোগ। এবং উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে সেসব অভিযোগ।
বাংলাদেশের ছাত্রলীগের উপর গণক্ষোভ বাড়তে থাকে গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ জুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে। সে সময় আন্দোলনরত পড়ুয়াদের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল ছাত্রলীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের প্রায় ৩৫০ জনের বেশি পড়ুয়া মারা পড়ে সেই হামলায় বলেই অভিযোগ।
ছাত্রাবাসে পড়ুয়াদের হত্যা, নির্যাতন-সহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। আর সেসবের বিরুদ্ধে একাধিক প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশের নয়া সরকার। আর তার ভিত্তিতেই সাম্প্রতিক এই নিষেধাজ্ঞা বলে জানানো হয়েছে। গেজেটে আর্থিক দুর্নীতি ও সহিংস হামলার অভিযোগও তোলা হয়েছে। ২০০৯ সালের বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইন ১৮(১)-এর উপর ভিত্তি করেই আনুষ্ঠানিক ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। সেই আইন অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকার যথাযথ প্রমাণ মিললে, তাকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে দেশের সরকারের।
শুধু যে ছাত্র সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ হল বাংলাদেশ লীগ, তা-ই নয়। তার সঙ্গে আরও বড় সমস্যায় পড়লেন বাংলাদেশ লীগের সদস্যরা। ঘোষণা করে দেওয়া হল, নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনও সদস্য বাংলাদেশে আর কোনও সরকারি চাকরি করতে পারবেন না। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে জানান, “নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনও সদস্য প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত হতে পারবে না। যেসব নিয়োগ এখনও প্রক্রিয়াধীন, সেখান থেকেও তাদের বাদ দেওয়া হবে। পরবর্তী সার্কুলারে শূন্যপদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হবে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে।” তিনি আরও জানান,“আসন্ন সার্কুলারগুলোতে সংখ্যাগত দিক থেকে অধিক সংখ্যক প্রার্থী নিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে। ঘুষ দিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধে সরকার বদ্ধপরিকর। নিয়োগের জন্য ঘুষ দেওয়া এবং নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।”
আরও পড়ুন:বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কি সত্যিই নির্যাতিত? প্রকৃত চিত্রটি আসলে যেমন
সরকারি চাকরি নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে এর সঙ্গেই। দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভাতে এই সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৪ সালের বিধিমালা সংশোধন খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে। তাতে চাকরির বয়স বাড়ানো ছাড়াও একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ তিনবার বিসিএসে বসতে পারবেন, এমন বিধি ও উপবিধি সংযোজন করা হবে বলে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রায় দু'মাসের বেশি সময় হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশে পালাবদলের। এখন সেখানে ক্ষমতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নয়। জনগণের সরকার কবে আসবে বাংলাদেশে? সেই প্রশ্ন উঠে আসতে শুরু করেছে বারংবার। দেশের প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস, সরকারে আসার পর পরই দাবি করেছিলেন, তাঁর কাজ হবে যত দ্রুত সম্ভব দেশে নির্বাচন পরিচালনা করা ৷ তবে চলতি বছর সেই ভোটের সম্ভাবনা তিমিরেই। ইউনূস অবশ্য জানাচ্ছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সেই ভোট করা সম্ভব হবে। তবে নির্বাচনের দিনক্ষণ তেমন সুস্পষ্ট ভাবে জানানো হয়নি। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পর নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হতে আওয়ামী লীগকেও। সেক্ষেত্রে সত্যিই গণতান্ত্রিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বাংলাদেশে হবে তো পরবর্তী ভোট? আগের মতোই প্রহসন হয়ে দাঁড়াবে না তো গোটা ভোট প্রক্রিয়া। সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।