শান্তির নোবেল পেলেন বেলারুশের জেলবন্দি! বেলেৎস্কির জয় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
Nobel Peace Prize 2022: গোটা বিশ্বের গায়ে যে যুদ্ধের দাগ সয়ে এসেছে, সেই ক্ষতেই ফের মোচড় দিল নোবেল কমিটি। সে কারণেই এবছরের এই পুরস্কার খোদ একটি যুদ্ধ, হিংসা, ঘৃণা ও অত্যাচারবিরোধী বয়ান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বশান্তির জন্য ২০২২-এ নির্বাচিত হলেন বেলারুশের এক জেলবন্দি। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের একটি করে মানবাধিকার সংগঠনকেও দেওয়া হল এই পুরস্কার। কেন জেলবন্দির হাতে নোবেল? কেনই বা মানুষের অধিকার নিয়ে যাঁরা কথা বলেন সরকারের বিরুদ্ধে, ছুঁড়ে দেন সওয়াল জবাব, তাঁদের হাতে নোবেল উঠল? আজকাল এতে ভারতের এক বিরাট অংশের জনগণ একটু অবাকই হন। আদতে ভারতে এই প্রশ্নকর্তাদের ট্রোল করা, অপমান করা, জেলে দেওয়া, এমনকি খুনের রেওয়াজও তৈরি হয়েছে বেশ কিছুদিন। এমনকি স্বাধীনতার পর যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, তাঁদেরকেও একটু বাঁকা চোখেই দেখে থাকে ভারতের একাংশ।
জেলবন্দি সেই নোবেল প্রাপকের নাম অ্যালেস বেলেৎস্কি। পুতিনের বন্ধু এবং বেলারুশের রাষ্ট্রপ্রধান আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর সমালোচনা তাঁর প্রধান 'অপরাধ'। 'মেমোরিয়াল' নামে রাশিয়ার নাগরিক অধিকার সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন পুতিন। এবং ইউক্রেনের সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজও পুতিনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধপরিস্থিতিকেই কটাক্ষ করল নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল সাইটেশনে বলা হয়েছে, "শান্তি পুরস্কার যাঁদের দেওয়া হল, এঁরা নিজের দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। বহুদিন ধরে নিরলস চেষ্টা করেছেন ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার অধিকার, নাগরিক অধিকারগুলি সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে। যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার প্রতিটি অপব্যবহার নথিবদ্ধ করতে দারুণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা। যৌথভাবে তাঁরা শান্তি এবং গণতন্ত্র বজায় রাখতে নাগরিক সমাজের গুরুত্বই তুলে ধরেছেন বারবার।" এই কারণেই নোবেল দেওয়া হয়েছে তাঁদের।
আরও পড়ুন- কয়েকটি ‘ক্লিক’-এই রোগ নিরাময়! রসায়নে নোবেল এনে দিল যে যুগান্তকারী আবিষ্কার
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে আমেরিকার নাগরিক। কিন্তু ভারতেই জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা তাঁর। নোটবন্দির, জিডিপির প্রয়োগপদ্ধতির বিরুদ্ধ সমালোচনা করার ফলে তাঁকে নিয়ে তুমুল ঘৃণা ছড়ায় ভারতের একাংশ। অমর্ত্য সেনকে তাঁদের অসহনীয় মনে হয়। তাঁকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়। কৈলাশ সত্যার্থীর কাজ নিয়েও না-খুশ তৎকালীন ভারতীয় সরকার। ফলে ভারতে নোবেলপ্রেম এবং নোবেল লরিয়েটদের প্রতি বিদ্বেষের বেশ ঐতিহ্য রয়েছে।
দ্য নরউইজান নোবেল কমিটির বয়ানে, "মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে মিলিটারি শাসনের বিরুদ্ধে আইনি অধিকার নিয়ে ক্রমাগত লড়ে গিয়েছেন নোবেল লরিয়েটরা। অ্যালফ্রেড নোবেলের দেশে দেশে শান্তি সংহতি নিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাকেই শক্তিশালী করেছেন এঁরা আপন কাজের মাধ্যমে। সম্মান জানিয়েছেন সেই দৃষ্টিভঙ্গিকেই। আজকের পৃথিবীতে এই দৃষ্টিভঙ্গির খুব খুব প্রয়োজন।" এই বেলেৎস্কি নিজের হাতে বেলারুশ মানবাধিকার গঠন ‘ভিয়াসনা’ গড়ে তোলেন ১৯৯৫ নাগাদ। এই সংগঠনের কাজ ছিল মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নিতে লড়াই, সেই অধিকার সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করা, এবং কোথায় কোথায় কী অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তা জনসমক্ষে তুলে ধরা। নিজের দেশের গণতন্ত্র আর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে উদয়াস্ত খেটেছেন বেলেৎস্কি। নোবেল কমিটিরও তাই মত।
২০১১-তেই ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার নাম করে জেলে বন্দি করা হয় বছর ষাটেকের মানুষটিকে। ২০১৪-য় মুক্তি দেওয়া হয়। ফের মিনস্কের একটি গণআন্দোলন থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় ২০২১ সালে। লুকাশেঙ্কোর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ আয়োজিত হয়েছিল। সে বছরই রয়টার্সকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে লুকাশেঙ্কো নিজেকে 'ইউরোপের শেষ একনায়ক' বলে অভিহিত করেছিলেন। পুতিনের ঘনিষ্ঠ এই শাসকের মদতেই বেলারুশের পথ ঘুরে ইউক্রেনের উপর হামলায় সক্ষম হয়েছিল রাশিয়া। ইউক্রেনের উত্তর-পশ্চিমাংশের একটা বড় অংশ জুড়ে বেলারুশের সীমানা। মিনস্ক থেকে কিয়েভের দূরত্বও পাঁচশ কিমির বেশি নয়। রাশিয়ান মিসাইল লঞ্চারগুলিকেও বেলারুশের মাটি থেকে হামলা চালানোর ছাড় দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান। শোনা গেছে, বেলারুশ সৈন্য দিয়েও রাশিয়ার মদত করেছে। যদিও এসব কথা অস্বীকার করেছেন লুকাশেঙ্কো।
আরও পড়ুন- বারবার নিজের স্মৃতির ময়নাতদন্ত, নোবেল জয়ী অ্যানি এরনোঁর সাহিত্য যে কারণে জনপ্রিয়
ভিয়াসনার ঘোষিত লক্ষ্য, একটি আদর্শ শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করা যাতে সবার অধিকার সমান। বেলারুশের নির্বাচন এবং তৎসংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তাঁরা সদা সতর্ক। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার যে সমস্ত ব্যক্তি তাঁদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে থাকে এই সংগঠন। আইনি সহায়তাও দিয়ে থাকে। ভিয়াসনার সদস্যদের ঘর অফিস হাজার বার তোলপাড় করেছে পুলিশ। একশোর বেশি সদস্যকে জেরা করেছে, পাকড়াও করেছে কেবলমাত্র ভিয়াসনার সভ্য হওয়ার 'অপরাধে'। বেলেৎস্কির কোনও ট্রায়ালই হয়নি। তাঁকে এমনিই আটক করে রাখা হয়েছে। ইউএপিএ জাতীয় এই গ্রেফতার প্রসঙ্গে নোবেল কমিটি বলেছে, "কঠোর পরিস্থিতিতেও বেলেৎস্কি তাঁর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই ছাড়েননি।"
স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের জেলের বর্তমান অবস্থার কথা চলে আসে। ভারভারা রাও প্রতিস্পর্ধী লেখালেখির জন্য বন্দি। একাশি বছরের একটা বিরাট অংশ জেলেই কাটালেন। ভুয়ো সংবাদ বারবার ফাঁস করার জন্য বন্দি মুহম্মদ জুবায়ের। গৌরী লঙ্কেশ খুন হয়ে গিয়েছেন। কাফিল খানকে অনবরত নিগ্রহ করা হচ্ছে। তিস্তা শেতলওয়াড়কেও মোটামুটি কব্জা করে ফেলা গেছে। সরকারের বিরুদ্ধে চোখ তুললেই জেলের অন্ধকারে নিক্ষেপ করবে পুলিশ। তেমন প্রয়োজন বোধ করলে সমস্ত সংবাদমাধ্যম খবর চেপে যাবে। নেহাত সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ! তাই খবর খুব বেশি চেপে দেওয়া যায় না। তবে আইটি সেল দিয়ে ঘেন্নার, গালাগালির, ধর্ষণের হুমকির বন্যা বইয়ে দেওয়া যায়। বর্তমান ভারতও রাশিয়ার থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই। বরং তার আইটি সেল রাশিয়ার যুদ্ধকেই সমর্থন করে এসেছে এতদিন। ইউক্রেনের প্রতি কেবল ঘৃণা উগরেছে। মুক্তচিন্তকদের জেলে পুরেছে। বিরোধীদের গলা চেপে ধরেছে। খুন হয়ে গিয়েছেন গৌরী লঙ্কেশ। মানুষ সেই খুন উদযাপন করেছে। এই পরিস্থিতিতে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য জেলবন্দি বেলেৎস্কিকে বেছে নেওয়া এই সমস্ত প্রবণতার গালে থাপ্পড় বৈকি। গোটা বিশ্বের গায়ে যে যুদ্ধের দাগ সয়ে এসেছে, সেই ক্ষতেই ফের মোচড় দিল নোবেল কমিটি। সে কারণেই এবছরের এই পুরস্কার খোদ একটি যুদ্ধ, হিংসা, ঘৃণা ও অত্যাচারবিরোধী বয়ান হয়ে দাঁড়িয়েছে।