নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূস জেলে যাবেন? যে ভয়াবহ অভিযোগে বিদ্ধ তিনি...
Muhammad Yunus: খুব কম করে হলেও, অন্তত ছ’মাসের জন্য ইউনূসের জেলে যাওয়া নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন মনিকা।
মানুষ কেন ব্যাঙ্কে যাবেন, ব্যাঙ্ককে পৌঁছতে হবে তাঁদের দোরগোড়ায়। অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই সারসত্য বুঝে গিয়েছিলেন মহম্মদ ইউনূস। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে অর্থনীতির সঙ্গে জুড়তে তাই গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজে হাতে। সমাজ চেতনার চেয়ে যদিও তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থকেই এগিয়ে রাখেন সমালোচকরা। কিন্তু স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে ঋণ চালু করে অনেক দুঃস্থ পরিবারকে সমাজজীবনের মূল স্রোতে আনতে সফল হয়েছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ইউনূস। তার জন্য গোটা বিশ্বে বন্দিত হলেও, নিজভূমে আজ, আপনজনেদের কাছেই জাতিশত্রুতে পরিণত হয়েছেন তিনি।
এই মুহূর্তে হাজতবাসের খাঁড়া ঝুলছে ইউনূসের উপর। নোবেল বিজয়ীর নিজ কর্মকাণ্ডকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন কেউ কেউ, কেউ কেউ আবার বলছেন, আদর্শগতভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের চেয়ে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান বলেই আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে ইউনূসকে। তবে কারণ যাই হোক না কেন, ইউনূসের কপালে দুঃখ আছে বলে ঢের আগেই আঁচ পেয়েছিলেন অনেকে।
সমাজমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ৮০-র কোঠা পেরিয়েছেন ইউনূস। যত বড় দিকপালই হন না কেন, এই বয়সে মোটামুটি সেঁধিয়ে যান বলেই ধারণা রয়েছে সাধারণের মনে। কিন্তু অশীতিপর ইউনূস রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে বহু মানুষের আশীর্বাদ। সম্মান পেয়েছেন যেমন ইউনূস, তেমনই আবার আক্রমণ, কটূক্তির শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে। আওয়ামি লিগের নেত্রী, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনও রকম রাখঢাক না করেই প্রকাশ্যে ‘রক্তচোষা’ বলে উল্লেখ করেছেন। হতদরিদ্র মানুষকে ঋণের ফাঁদে ফেলে, তিনি সুদ-সহ তাঁদের হাড়মাস জ্বালিয়ে খেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন হাসিনা।
আরও পড়ুন- পদ্মা সেতুই নির্বাচনে বৈতরণী পার করাবে হাসিনাকে?
এমনকী আমেরিকার তৎকালীন বিদেশ সচিব, হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে সখ্যকে কাজে লাগিয়ে, ইউনূস কলকাঠি নাড়াতেই ২০১১ সালে পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাঙ্কের সরে দাঁড়ায় বলে অভিযোগ করেছে হাসিনা, তাঁর পরিবার এবং তাঁর দল ও সরকারের নেতা-মন্ত্রী-আমলারা। দেশদ্রোহী বলে সরাসরি দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কখনও, কখনও আবার করফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। ২০০৮ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আইনি লড়াইয়ে গিয়েও হারতে হয় তাঁকে। ২০১৩ সালে সরকরি অনুমোদন ছাড়া বিদেশ থেকে অনুদান গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। বর্তমানে শ্রম আইন লঙ্ঘন মামলায় হাজতবাসের দিকে এগোচ্ছেন ইউনূস। ২০২১ সালে বাংলাদেশের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধি দফতরের শ্রম পরিদর্শক ইউনূস এবং গ্রামীণ টেলিকম সংস্থায় তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেন।
ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, প্রফেসর ডঃ মহম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট, ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্ট এবং ইউনূস সেন্টার নামের তিনটি অলাভজনক সংস্থায় টাকা ঢেলেছিলেন তিনি। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলার ঢালেন ওই তিন সংস্থা, যার জন্য প্রায় ১০ লক্ষ ডলার কর দিতে হবে তাঁকে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১২ কোটি টাকা। ইউনূস যুক্তি দেন, তিনি কোনও লাভজনক সংস্থায় টাকা ঢালেননি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের নীতি অনুযায়ী, অলাভজনক সংস্থায় টাকা ঢালার ক্ষেত্রেও কর দেওয়া বাধ্যতামূলক। সেই টাকা যদিও পরিশোধ করে দেন তিনি।
ইউনূস শ্রমিক-কর্মচারী তহবিলের টাকা নয়ছয় করেছেন, স্থায়ী করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজে রাখেন, ১০০-র বেশি শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী করা হয়নি, সংস্থার লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টনের কথা থাকলেও, বাস্তবে তা ঘটেনি বলেও মামলা জমা পড়েছিল। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী তহবিলের ২৫ কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। সেই মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে নাম ওঠে ইউনূসের। এরপর, যত সময় গিয়েছে একের পর এক মামলা জুড়েছে। সংস্থার কর্মীরাও মামলা করেন ইউনূসের বিরুদ্ধে।
শ্রম আইন লঙ্ঘন মামলায় অভিযোগ গঠনের নির্দেশ এহং রায়দানে স্থগিতাদেশ চেয়ে কিছু দিন আগে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ইউনূস। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ইউনূসের সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। ইউনূস-কন্যা মনিকা যদিও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলছেন, আমেরিকার নিউ ইয়র্কে একটি সমাজসেবা মূলক সংস্থা চালান মনিকা। তাঁর দাবি, জামিন অযোগ্য ধারায় ইউনূসকে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে হুমকি দিয়েছেন হাসিনা। খুব কম করে হলেও, অন্তত ছ’মাসের জন্য ইউনূসের জেলে যাওয়া নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন মনিকা।
সমাজ মাধ্যমে মনিকা লেখেন "ঈর্ষা এবং বিদ্বেষপরায়ণতায় কোনও সীমার ধার ধারেন না শেখ হাসিনা। গত ১৫ বছর ধরে লাগাতার হুমকি দিয়ে আসছেন। জানুয়ারিতে নির্বাচন রয়েছে। তার আগে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন হাসিনা। মিথ্যে অভিযোগ তুলে প্রকাশ্যে আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন, যার ফলশ্রুতি এই সমস্ত মামলা। সুপ্রিম কোর্টও আবেদন খারিজ করে দিয়েছে, অর্থাৎ বড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে, বাবার গ্রেফতারি আসন্ন।"
আরও পড়ুন- লাখে লাখে মানুষ কেঁদে মুক্তি পান! কেন বাংলাদেশে বিতর্কের নাম দেলোয়ার হোসেন সাঈদী?
পেশায় অর্থনীতিবিদ হলেও, বাংলাদেশের রাজনীতির অলিন্দে ইউনূসের ঘোরাফেরা ছিল বরাবরই। তাই ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব উড়িয়ে দিতে পারছেন না ইউনূসের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন কেউই। তাঁদের মতে, ২০০৬ সালে ইউনূসের নোবেল জয় হোক বা ২০০৭ সালে নিজের রাজনৈতিক দলের পত্তন, বরাবরই হাসিনার সঙ্গে ইউনূসের সম্পর্ক অম্লমধুর থেকেছে। নির্বাচনে পাঁচ মাস বাকি থাকতে, ইউনূসকে জেলে ঢোকানোর সুযোগ হাসিনা হাতছাড়া করবেন না বলে মনে করছেন নোবেলজয়ীর শুভান্যুধায়ীরা। বাংলাদেশের বিশিষ্ট মহলের একাংশও এ নিয়ে সরব হন, খোলা চিঠি প্রকাশ করেন।
গত কয়েক মাসে ইউনূসের সমর্থনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও চিঠি এসে পৌঁছেছে বাংলাদেশে। ১০০-র বেশি নোবেলজয়ী হাসিনার উদ্দেশে খোলা চিঠি লেখেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন মহাসচিব বান কি মুনও ইউনূসকে ‘হেনস্থা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ সংবাদপত্রে বিশিষ্টজনেদের সাক্ষাৎ-সহ প্রতিবেদনও বেরিয়েছে। এমনকী আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও অগাস্ট মাসে চিঠি লেখেন ইউনূসকে। সঙ্কটের সময়ে সাহস জোগানোর পাশাপাশি, দারিদ্র্য দূরীকরণে তিনি আগামী দিনেও নিরলস পরিশ্রম করে যাবেন বলে আশাপ্রকাশ করেন ওবামা।
কিন্তু ইউনূসের প্রতি কড়া অবস্থান থেকে একচুলও সরেননি হাসিনা। বরং বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতা, কর্তা-ব্যক্তিরা যে ইউনূসের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করলে হাসিনা তাচ্ছিল্যই করেন ইউনূসকে। ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেন, ‘‘অপরাধ করেননি বলে আত্মবিশ্বাস থাকলে, আন্তর্জাতিক স্তরে এভাবে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না ইউনূস। অন্য দেশ থেকে ওঁর পক্ষে এত বিবৃতি না দিয়ে বরং আইনজীবী, বিশেষজ্ঞ পাঠানো হোক। কেউ যদি কর না দেন, শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ করেন, তারপর শ্রমিকদের তরফে মামলা করা হয়, সেখানে আমরা মামলা বন্ধ করব কী করে?’’ ইউনূস যদিও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন আগের মতোই। সম্প্রতি জাপানে একটি অনুষ্ঠানে কৃত্রিম যন্ত্রমেধার বাড়বাড়ন্তে আগামী দিনে মানুষ প্রযুক্তির দাসে না পরিণত হয়, আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। ইউনূসের পরিণতি এবং বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের দিকে এই মুহূর্তে নজর রয়েছে আমেরিকারও। বাংলাদেশে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের উপরই সেদেশের নাগরিকদের ভিসা প্রদানের বিষয়টি নির্ভর করছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন আমেরিকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। সেই তালিকায় সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও রয়েছেন বলে জানিয়েছেন।