যৌনতা হোক বা যন্ত্রণা, দেহই ফকিরদের পরীক্ষাগার
যে বয়সে পড়ার কথা নয়, সেই বয়সে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে প্রথম পাতাতেই একটি গানের মুখোমুখি হই। গানটি হল: খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মনোবেড়ি আমি দিতাম পাখির পায়। বলা বাহুল্য, বুঝতে পারিনি, এরকম একটি খাঁচা কে বা কারা তৈরি করেছে, যেখানে পাখি আসে আবার বেরিয়েও যায়? কারণ বাড়িতে পাখি থাকায় খাঁচা সম্পর্কে ধারণা ছিল। বহুদিন পরে বুঝতে পারি, লালন তাঁর এই গানে খাঁচা বলতে বুঝিয়েছেন আমাদের দেহকেই। শুধু তাই নয়, ফকির লালন ছয়শোর বেশি এই দেহতত্ত্বের গান রচনা করেছেন।
এলাম আমি কোথা থেকে?- এই প্রশ্নেরই পথ ধরে বহুদূর হেঁটে সাধু-সন্ত-মরমিয়ারা এসে পৌঁছন নিজেরই কাছে, বা বলা যায় নিজের দেহের কাছে। বুঝতে পারেন, জানতে হবে দেহকে, কেননা দেহ থেকেই তাঁরা জন্মেছেন। পেয়েছেন দুর্লভ মানবজনম। তাই এই মানবজনমকে বৃথা নষ্ট না করে দেহকে জানার মধ্য দিয়ে তাঁরা প্রেম-মুক্তি-আনন্দ আর অনন্তের সন্ধান করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন জাতপাত, ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে ছড়িয়েছে তাঁদের দেহতত্ত্বের নিয়মনীতি আর গানে গানে ছড়িয়েছে এই তত্ত্বের গুণকীর্তন, যে তত্ত্বের ভাষা জানা না থাকলে গানের প্রকৃত অর্থ জানা যাবে না।
বাংলার ফকিরদের বিষয়টা বুঝতে গেলে ইসলামি সুফি ঐতিহ্যটি একটু জানা দরকার। আরবি ‘সুফ’ শব্দটির অর্থ 'পশম'। এই সাধকরা পশমের আচ্ছাদন ব্যবহার করতেন শরীর ঢাকার জন্য। একদল মহম্মদ-ঘনিষ্ঠ সহচর সাধক সুফি নামে পরিচিত ছিলেন। যেমন তাঁরা নিজেদের ঘিরে রাখতেন পশমের আপাত ঘন আবরণ দিয়ে, তেমনই তাঁরা ঘিরে রাখতেন মহম্মদকে।
আরও পড়ুন: বাংলার এই দুঃসাহসী সাংবাদিককে ঠাণ্ডা করতে সেদিন লেঠেল পাঠিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি
সুফি মতবাদ কোরানের গুপ্ত ঐতিহ্যের ওপর নির্ভরশীল। সুফিরা কোরানের যে ব্যখ্যা করে, তা শরিয়তিরা ঘৃণা করে। সুফিরা বলে, এই হল আসল কোরান আর শরিয়তিরা বলে ওটা কোরানের বিকৃত ব্যাখ্যা। দেহের মধ্যে খোদা আছেন, তাঁকে জানার সাধনায় গড়ে ওঠে সুফিদের দেহসাধনার সংস্কৃতি। সুফি প্রেমপন্থী সাধকেরা যুগলসাধনায় শরীরের ভেতরের খোদাকে জানতে চেষ্টা করেন। সুফি সাহিত্যও নর-নারীর যুগলপ্রেম, আশেক–মাশুকের প্রসঙ্গে পূর্ণ।
ইসলামের সূত্রপাত থেকেই ধর্মীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। হজরত মহম্মদের মৃত্যুর পর থেকেই ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব শুরু। সুফিসাধকরা রক্ষণশীল রাষ্ট্রীয় ধর্মের বিরুদ্ধে মসজিদের প্রার্থনায় যোগ না দিয়ে মসজিদের বাইরে খাটিয়ায় বসে নীরবে প্রতিবাদ জানায়। উদ্বিগ্ন রাষ্ট্র আর রক্ষণশীল ধর্ম সুফিদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। বহু সুফি সাধককে হত্যা করা হয়। তাতেও এই দর্শনটিকে মুছে ফেলা যায়নি।
দেহতত্ত্বের জ্ঞান সাধারণের কাছে গুপ্ত, দুর্বোধ্য। এই বিষয়ে একটি সুফি গল্প আছে। প্রসঙ্গত, একদল মহম্মদ সহচর সাধক সুফি নামে পরিচিত ছিলেন। আরবিতে সুফি শব্দটির অর্থ 'পশম' বা পবিত্রতা। সুফিরা পশমের আচ্ছাদন বা কম্বল ব্যবহার করতেন। যেমন তাঁরা নিজেদের ঘিরে রাখতেন পশমের আপাত ঘন আবরণ দিয়ে, তেমনই তাঁরা ঘিরে রাখতেন মহম্মদকে। তো একদিন হজরত মহম্মদ তাঁর সঙ্গীদের কাছে ঈশ্বরসৃষ্ট সপ্তস্বর্গের ব্যাখ্যা করছিলেন। তখন চকিতেই এর এক নতুন অর্থ তাঁর মনে ভেসে ওঠে। ইবন আব্বাস, হজরত অনুচর এক মরমি সুফি সাধক উপস্থিত সেই আসরে। হজরত শুধু তাঁকেই বলেন সেই নতুন অর্থ। পরে অন্যরা আব্বাসকে জিজ্ঞেস করেন যে, কী সেই নতুন অর্থ? আব্বাস বলেন যে, সেই নতুন অর্থ যদি আমি তোমাদের জানাই, তাহলে তোমরা আমাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলবে। আব্বাস এই কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, অদীক্ষিত শ্রোতার কাছে গুপ্তজ্ঞান উন্মোচিত করা মহাপাপ। তাতে সেই জ্ঞানটিকেই হত্যা করা হয়।
আরও পড়ুন: শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত, বাংলা সাহিত্যের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় অন্তর্ঘাত
বাংলার ফকিরদের সুফি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার আছে বলে মনে করা হয়। সুফি মতবাদ কোরানের গুপ্ত ঐতিহ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। দেহের মধ্যে খোদা আছেন, তাঁকে জানার সাধনায় গড়ে ওঠে সুফিদের দেহসাধনার সংস্কৃতি। বাংলায় ফকির শব্দটির অর্থ ১. ভিক্ষুক ২. সাধনার জন্য অর্থ-বিত্ত-সমাজ পরিত্যাগ করে যে নিজের দেহটুকু সম্বল করে নিঃস্ব হয়েছে। ৩. লালন দেহতত্ত্বের গুপ্তসাধনাকে 'ফকিরি' বলেছেন। বাংলার ফকিররা প্রণাম করেন মানুষকে, কারণ এঁরা মনে করেন, ঈশ্বর মানবদেহেই আছেন। তাঁদের যুক্তি হল, মানুষের শরীর থেকেই যখন মানুষের জন্ম, তাহলে মানবজন্মের পিছনে ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা নেই। আর যদি মানবজন্মের প্রক্রিয়াই ঐশ্বরিক ব্যাপার হয়, তাহলে সেই ঈশ্বর মানুষের দেহের ভেতরই আছেন। বাংলা দেহতত্ত্বের গান যেহেতু দেহসাধনাকে কেন্দ্র করেই লেখা, তাই এর ভাষাটিও প্রচ্ছন্ন। ফকিররা এই ভাষাকে বলেন ইশারা কালাম বা ইঙ্গিতমূলক ভাষা।
ফকিররা বলেন, নিজের দেহকে জানতে হবে, দেহের ভাষা বুঝতে হবে। তবেই দেহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যাবে। যেমন পদকর্তা হাসান ফকির তাঁর একটি পদে বলছেন, কথা বলছে আল্লা পরোয়ার/ মোমিনের কালেবে আল্লার ঘর । এই কথারই উল্টোপিঠের কথা বীরভুমের নিজামুদ্দিন ফকিরের কাছে শুনি। তিনি বলেছিলেন, "কোরানের একটি আয়াতেই বলা আছে, ফেতরা তাল লাহিল লাতি ফাতারান নাসা আলাই হা, অর্থাত্ তোমাদের যে রূপ তোমরা জন্মে পেয়েছ, সেই রূপ আল্লারও।"
দেহকে জানার একটি পদ্ধতি হিসেবে দেহ-র সহ্যশক্তিরও পরীক্ষা ফকিররা করে থাকেন। পাথরচাপুড়ির মেলায় দেখেছি, গভীর রাত, একটা বিরাট আগুনের কুণ্ডকে ঘিরে ফকিররা বসে আছেন। গান হচ্ছে। সেখানে শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ ফকির, তাঁর ভুরুতে, পিঠে, হাতে বেঁধানো রয়েছে কয়েকটি ধাতুর চকচকে লম্বা শলাকা আর তিনি নিরন্তর জিকর করে যাচ্ছেন বিড়বিড় করে, মাঝে মাঝে যখন চিত্কার করছেন ‘হক্ দাতা আল্ আল্ আল্' বলে, তখন বোঝা যাচ্ছে কী নাম জিকর করছেন।
মধ্যযুগের সুফি সাধক সক্ তী এক জমায়েতে ধর্মকথা শোনাচ্ছেন। সেই সময় একটি বিছে তাঁকে বারবার দংশন করছিল। পরে তাঁর রক্তাক্ত পা দেখে শিষ্যরা বলে, "আপনি বিছেটাকে তাড়িয়ে দিলেন না কেন?" সক্ তী হেসে বলেন, "আমার লজ্জা করল, কারণ তখন আমি ধৈর্য সম্পর্কে বক্তব্য রাখছিলাম।" সুফি সাধক আবিসকে হজরত মহম্মদ খুব শ্রদ্ধা করতেন। আবিস ধুলো-নোংরা লাগা ছেঁড়া পোশাক পরে ঘুরতেন, তাই দেখে বাচ্চারা 'পাগল' বলে তাকে পাথর ছুড়ে মারত। আবিস সেই বাচ্চাদের বলতেন, "ছোট ছোট ঢিল মারো, বড় পাথর মারলে রক্তপাত হবে, ওজু অশুদ্ধ হবে, আমি নমাজ পড়তে পারব না।"
এক সুফি সাধকের মনে ইচ্ছে জেগেছে, গরম রুটি আর মাংসের ঝোল খাবেন, বহুদিন তিনি ঠিকমতো খেতে পাননি। এই কথা ভাবতে ভাবতে সাধক পথ চলছেন । হঠাৎ সামনে হইহল্লা শুনে সাধক উঁকি দিয়েছেন, কী ব্যাপার! সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ জনতা তাঁর ওপর ‘চোর চোর’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি কিছু বলবার আগেই সপাসপ চাবুক পড়তে লাগল তাঁর ওপর। পথচলতি এক বৃদ্ধ তাঁকে চিনতে পেরে উদ্ধার করেন। ততক্ষণে বিশ ঘা চাবুক পড়ে গেছে। সেই বৃদ্ধ সাধককে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সুশ্রুষা করে খেতে দিলেন। সাধক দেখেন, সেই খাবার হল গরম রুটি আর মাংসের ঝোল। খাবার মুখে তোলার সময় কে যেন তাঁর মনের ভেতর বলে উঠল, "মনে রেখো, তোমার বাসনার দাম বিশ ঘা চাবুক। যতবার মনে লোভ জাগবে ততবার বিশ ঘা চাবুক খেতে হবে।"
ফকির তাঁর দেহ নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তা শারীরিক যন্ত্রণাই হোক, বা যৌনযোগাভ্যাস। লালনের গান দিয়ে শুরু করেছিলাম, ওই গানের কথাই ফকির গণি পাগল তাঁর পদে আরেকভাবে বলেছেন। মনে পড়ছে, ২০০৪ সালের পাথরচাপুড়ির মেলার মধ্যরাত। বিখ্যাত বটগাছের পাশেই ছোট ছাউনিতে আছেন আরমান ফকির। দেহ ঈশ্বরের কথায় আরমান শোনালেন ওঁর গুরু ফকির গণি পাগলের গান: এই দেহপিঞ্জরে বন্দি করো খোদারে/ দমসাগরে প্রেমের তরী বেলা থাকতে ধর/ মিছে এই খেলাঘর ভেঙে যাবে দুদিন পর/ মাটির বিছানা খাঁটি তখন হবে সার।