কেউ মদ‍্যপান করে উন্মত্ত, কেউ গৃহস্থের সামনে অপ্রকাশ্য! কালীতন্ত্রে কালীর নানা রূপ

Kali Puja: দীপান্বিতা অমাবস্যার সময় কেন কালীপুজো করা হয়, তারও ইতিহাস রয়েছে।

মহালয়া হয় অমাবস্যায়, পিতৃপক্ষ শেষ হয় এবং শুরু হয় দেবীপক্ষের। মহালয়ার দিনে পিতৃপুরুষদের তর্পণ করার প্রথা প্রচলিত আছে। পৌরাণিক বিশ্বাস এই যে, পিতৃপক্ষের সময় বিদেহী আত্মারা জল গ্রহণের জন্য মর্ত্যে আসেন। তার পর থেকে দীপাবলি পর্যন্ত তাঁরা মর্ত্যেই বিচরণ করেন। দীপাবলির সময় পিতৃলোকে ফিরে যান তাঁরা। কিন্তু যেদিন তাঁরা ফিরে যান, সেই দিনটি আবার অমাবস্যা। এই অন্ধকারে পিতৃপুরুষদের প্রত্যাগমনের অন্ধকার পথ আলোকিত করে রাখার জন্য  ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় প্রদীপ। বাংলায় সারা কার্তিক মাসজুড়ে বাড়ির ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর ঐতিহ্যও এই যাত্রাকে মনে করেই।

এভাবে কালীপুজোর সঙ্গে প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা জড়িয়ে পড়েছে। তবে দীপান্বিতা অমাবস্যার সময় কেন কালীপুজো করা হয়, তারও ইতিহাস রয়েছে।

ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের স্মার্ত পণ্ডিত ও নব্য স্মৃতি-স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপুজোর বিধান দেন। তবে কালীপুজোর কোনও উল্লেখ করেননি তিনি। এরপর অষ্টাদশ শতকে প্রকাশিত কালী সপর্যাস বিধিতে প্রথমবার দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সপ্তদশ শতকে বাংলায় কালীপুজোর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

আরও পড়ুন: খ্রিস্টধর্মকে করে তুলতে চেয়েছিলেন ভারতীয়! ব্রিটিশদের চক্ষুশূল ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ‍্যায়

নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপুজোর প্রবর্তক বলে মনে করা হয়। তন্ত্রশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এই সাধক ১৭০টি গ্রন্থ থেকে নির্যাস গ্রহণ করে ১৬৩০ থেকে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁর বিখ্যাত ‘বৃহৎতন্ত্রসার’ গ্রন্থটি রচনা করেন। তার আগে কালীর উপাসকরা তাম্রপটে বা পাথরে খোদাই করে কালীর মূর্তি তৈরি করে পুজো  করতেন। একটি তথ্য থেকে জানা যায়, বঙ্গদেশে প্রাচীন কালীমন্দিরগুলির শতকরা চুরাশি ভাগ স্থাপিত হয়েছিল ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে। সাধনার অঙ্গ হিসেবে শ্যামাসংগীত রচনা ও গীত হওয়ার সূত্রপাতও সেই সময় থেকেই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এইভাবে কালীর প্রতিমাপুজোর প্রচলন শুরু। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজোর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।

যাঁদের লেখা শ্যামাসংগীত এখনও বাঙালির হৃদয় ভরিয়ে রেখেছে, তাঁরা হলেন রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রামদুলাল নন্দী, দাশরথি রায়, ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল এবং কাজি নজরুল ইসলাম।

কালী বা কালিকা হলেন একজন দেবী। তার অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। তন্ত্র-অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। শাক্ততন্ত্রে বলা হয়, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। তার চার হাতে খড়্গ,   অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা রয়েছে। তার গলায় রয়েছে ৫১টি নরমুণ্ডের মালা। দেবীর গায়ের রং কালো। মাথায় আলুলায়িত চুল এবং তাঁর পায়ের নিচে মহাকাল শিব শুয়ে, তিনি শিবের বুকে ডান পা আগে রেখে দণ্ডায়মান। কালী শব্দের উৎপত্তি কাল থেকে। কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ কালী। কালের সঙ্গে যিনি রমণ করেন তিনিই কালী।  

কাল বলতে বোঝায় সময়। অর্থাৎ, অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে যিনি কলন করেন, তিনি মহাকাল আর সেই মহাকালের কলন বা রমণ-নিয়ন্ত্রক যিনি, তিনিই মহাকালী। সাধক কমলাকান্ত তাঁর গানে তাই বলেছেন,

সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিনী
তুমি আপনি নাচো আপনি গাও মা
আপনি দাও মা করতালি

এই গানেই একটু পরে কমলাকান্ত বলেন,

আদিভূতা সনাতনী শূণ্যরূপা শশীভালী
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুন্ডুমালা কোথায় পেলি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই দেখা যায়, আসলে কালী অনন্তের প্রতীক। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে মুণ্ডমালা পাওয়ার তাই প্রশ্ন উঠছে না। এ আসলে মানুষের অহং ছিন্ন করার প্রতীক। তার এক হাতে তাই খড়্গ। সেই খড়্গে আঁকা চোখ প্রজ্ঞার প্রতীক। অন্য হাতে বরাভয়। এই কল্পনাতেই শক্তির দ্বান্দিক রূপ একইসঙ্গে মূর্ত, একদিকে তা সৃষ্টি-বিনাশী, অন্যদিকে সৃষ্টির প্রতীক।

এই আদিশক্তি বা আদ্যাশক্তি সময়ের থেকেও উচ্চতর। কাল থেকে কালীর উৎপত্তি ধরলে, তা আসলে সময়ের সীমানা পেরনো এক ধারণা। সেই অনন্তকে কোনও জাগতিক বস্ত্রের আবরণে আবৃত করা যায় না। দেবী তাই নগ্নিকা। দেবীর কেশ বৈরাগ্যের প্রতীক, দেবীর বর্ণ কখনও কালো কখনও বা নীল। দেবীর ত্রিনয়ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পাপ বিনাশকারী। দেবীর প্রসারিত জিহ্বা হলো ‘খেচরিমুদ্রা’-র প্রতীক, যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভারসাম্য রক্ষা করে। আদ্যাশক্তি স্বয়ং জীব ও জড়ের কেন্দ্রীভূত লীলার লীলাময়ী।

মহাকালের অন্তর্গত খণ্ডকালের মধ্যে সংসারের নিত্য সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কার্য যা, অবিরত পরিচালিত হচ্ছে,  সেই অনাদিকাল থেকেই কাল-সংহারিণী কালীর করালবদনের মধ্যে নিত্য কত কী যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, সেসবও যিনি সতত ঈক্ষণ বা দর্শন করছেন, তিনিই 'কালী'। কালীর কণ্ঠের শোভা ৫১টি মুণ্ডের এই মালা আসলে জ্ঞানের প্রতীক৷ প্রসঙ্গত, বাংলা বর্ণমালায় ৫১টি বর্ণ আছে। স্বরবর্ণ ১১টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ৪০টি ।

কালীপুজো বা শ্যামাপুজো হিন্দু দেবী কালীর পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত একটি হিন্দু উৎসব। প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই পুজো খুবই জনপ্রিয়, কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে হয়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই দিন লক্ষ্মীপুজো অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত, কলকাতার কালীঘাটের কালীমন্দিরেও এই দিন লক্ষ্মীপুজো হয়। 

এছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ফলহারিণী কালীপুজোও যথেষ্ট জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং কোনও কোনও মঙ্গলবার ও শনিবারে রক্ষাকালী পুজো হয়ে থাকে। রক্ষাকালী পুজোর নিয়ম হলো ভোররাত থেকে তৈরি কাঠামোর ওপর কুমোর কালীমূর্তি নির্মাণ শুরু করবে, রাত্রে নির্মাণ শেষ হবে, তারপর পুজো এবং পরের দিন ভোরে প্রতিমা বিসর্জন।    

তন্ত্র অনুসারে কালী বহুরূপে পূজিত হন। কালীতন্ত্রে বর্ণিত কালীর ৪টি রূপের বর্ণনা এইরকম:    

দক্ষিণাকালী
দক্ষিণাকালী হলো কালীর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ মূর্তি। ইনি প্রচলিত ভাষায় শ্যামাকালী নামেও আখ্যাতা। গৃহস্থ বাড়িতে ও বারোয়ারিতে এর পুজো হয়। দক্ষিণাকালী করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তার বাম করযুগলে সদ্য ছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ, দক্ষিণকর যুগলে বর ও অভয় মুদ্রা। তার গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তার গলায় মুণ্ডমালা, কানে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস বা কানের দুল, কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তার দন্ত ভয়ানক, তার স্তনযুগল উন্নত, সে ত্রিনয়নী এবং মহাকাল শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তার দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই কালীর সাধন করতেন দক্ষিণেশ্বরে।

Kali

চার রূপে কালী

বামাকালী
বামাকালী বা সিদ্ধকালী হলো কালীর একটি অপ্রচলিত রূপ। গৃহস্থের বাড়িতে বামাকালী বা সিদ্ধকালীর পুজো হয় না; তিনি মূলত সিদ্ধ-সাধকদের ধ্যান-আরাধ্যা, বাড়ির বাইরে কোনও নির্জন স্থানে এই কালীর পুজো হয়। কালীতন্ত্রে তাকে দ্বিভূজা-রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তার দক্ষিণ হস্তে ধৃত খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে নিঃসৃত অমৃত রসে প্লাবিত হয়ে বামহস্তে ধৃত একটি নরকপালপাত্রে সেই অমৃত ধারণ করে পরমানন্দে পানরতা। সে সালংকারা। তার বাম পদ শিবের বুকে ও দক্ষিণ পদ শিবের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত।

শ্মশানকালী
কালীর ‘শ্মশানকালী’ মূর্তি একমাত্র শ্মশানঘাটে পুজো হয়ে থাকে। এই দেবীকে শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনে করা হয়। 'বৃহৎতন্ত্রসার' অনুসারে এই দেবীমূর্তির গায়ের রং কাজলের মতো কালো। তার চোখদু'টি রক্তপিঙ্গল বর্ণের। দেবীর হাস্যমুখ, চুলগুলি আলুলায়িত, দেহটি ক্ষীণ ও ভয়ংকর, উন্নত স্তন, বাঁদিকের দু'টি হাতের একটিতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, অপরটিতে সদ্য কাটা নরমুণ্ড আর ডানদিকের দু'টি হাতের একটিতে খড়্গ ও অপরটিতে ত্রিশুল। তার গায়ে নানারকম অলংকার থাকলেও, সে উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তার বাঁ-পা শিবের বুকে স্থাপিত এবং ডান-পা ভূমিতে রাখা। বাংলার অনেক প্রাচীন শ্মশানঘাটে এখনও শ্মশানকালীর পুজো হয়।

গুহ্যকালী
গুহ্যকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। সে সাধকদের আরাধ্য। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর: গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় ৫১টি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগ যজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; উন্মুক্ত উন্নত স্তন, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বাম কঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণ কঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব।

More Articles