ঠিক কী কী দাবি ছাত্রদের? অগ্নিগর্ভ যাদবপুরের নেপথ্যে পুঞ্জীভূত যেসব ক্ষোভ

Jadavpur University: স্থায়ী উপাচার্য নেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে শূন্যপদ রয়েছে, অধ্যাপক নেই পর্যাপ্ত। ফিজ বাড়ছে ব্যাপক পরিমাণে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলপন্থী অধ্যাপকদের সংগঠন ওয়েবকুপার বার্ষিক সভায় ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গিয়েছে গত শনিবার। ক্যাম্পাসের ভিতরে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখায় ছাত্ররা। ব্রাত্য বসুর গাড়ি এগিয়ে যায় বিক্ষোভরত ছাত্রদের ভিড়ের মধ্যে দিয়েই। অভিযোগ, ঘটনায় গাড়ির তলায় চাপা পড়ে যায় এক ছাত্র। আর এক ছাত্রের পায়ের উপর দিয়ে চলে যায় গাড়ির চাকা। একপ্রকার বেপরোয়া হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন যাদবপুরের ছাত্ররা। কিন্তু কীভাবে জমলো ক্ষোভের পাহাড়! শুধুই কি ছাত্রভোটের দাবি নাকি নেপথ্যে রয়েছে আরও কারণ? খোঁজ নিল ইনস্ক্রিপ্ট।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের (SFI, AISA, AIDSO, RSF) কথায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন তাদের মূল দাবি হলেও ক্ষোভের নেপথ্যে রয়েছে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

এসএফআই-এর শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এই ক্ষোভ জমেছে। ২০২০ সালে যাদবপুরে শেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। গত ৫ বছর নির্বাচন হয়নি, যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল তারা সবাই পাস করে বেরিয়ে গেছে। ফলে ক্যাম্পাসে এখন কোনও 'ইলেক্টেড বডি' নেই। যার কারণে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে ক্যাম্পাসের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অনুদান পাচ্ছে না। ফলে আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কারওই ভ্রূক্ষেপ নেই এ ব্যাপারে। একাধিক ক্লাসরুমের ফ্যান, লাইট খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। ল্যাব ইকুইপমেন্ট খারাপ, সেগুলো সরানোর টাকাও নাকি নেই বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্য, রেজিস্ট্রার নেই। দু'দিন আগেই সেমিস্টার পরীক্ষায় ফিল্ম স্টাডিজের প্রশ্নপত্র কম্পারেটিভ লিটারেচার-এ চলে গেছে। পরীক্ষা শুরু হচ্ছে দু'ঘণ্টা পর। কোনও ক্ষেত্রে অধ্যাপকরা জানেনই না, সেদিন পরীক্ষা! এমনই চূড়ান্ত অব্যবস্থা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে উপাচার্য অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব সামলাচ্ছেন, তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ তা স্পষ্ট। শুভদীপের অভিযোগ, এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্য কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার। এই চূড়ান্ত অব্যবস্থা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যতবারই সরকারের সঙ্গে কথা বলতে গেছে, সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে সেই প্রস্তাব। সেই থেকেই জমেছে ছাত্রদের ক্ষোভের পাহাড়।

আরও পড়ুন- যাদবপুরে ছাত্র ভোটের দাবিতেই সংঘর্ষ! কী বলছে পক্ষ ও বিপক্ষ?

AIDSO সংগঠনের রেশমি তারা খাতুন বলছেন, দীর্ঘ ৮ বছর এই রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। স্থায়ী উপাচার্য নেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে শূন্যপদ রয়েছে, অধ্যাপক নেই পর্যাপ্ত। ফিজ বাড়ছে ব্যাপক পরিমাণে। উচ্চশিক্ষাকে কার্যত অচলাবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। যার বিরুদ্ধে বছরভর আন্দোলন করছে AIDSO। এছাড়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ চালু হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্য শিক্ষানীতি ২০২৩ নিয়ে আসে। যার মাধ্যমে কেন্দ্র সরকারের শিক্ষানীতিই নিজেদের মতো করে এই রাজ্যে চালু করে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। যার ফলে স্নাতকে তিন বছরের পরিবর্তে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স হয়ে গেল। এই কারণে ব্যাপক পরিমাণে ড্রপ আউট বেড়েছে। "চার বছর ধরে গ্র্যাজুয়েশন করেও চাকরির নিশ্চয়তা নেই। প্রাইমারি, এসএসসি নিয়ে দুর্নীতি চলছে। ফলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর একজন পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। শিক্ষার উপর একের পর এক আঘাত নেমে আসছে। সিলেবাস থেকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বাদ দেওয়া হচ্ছে। ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধেই দেশজুড়ে আমাদের আন্দোলন," বলছেন রেশমি তারা খাতুন।

AISA-এর শঙ্খদীপ চক্রবর্তীর বক্তব্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ ইউনিয়ন ইলেকশন হয়েছিল ২০২০ সালে। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত অবস্থা খুবই শোচনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাথরুমগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে পর্যাপ্ত অধ্যাপক নেই। যার কারণে ক্লাস হচ্ছে না অনেক ডিপার্টমেন্টেই। ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়াও আইসিসি ইলেকশন প্রয়োজন ইউনিভার্সিটিতে। ইন্টারনাল কমপ্লেইন কমিটি (ICC) সক্রিয় ভূমিকায় নেই। আইসিসি-তে কোনও অভিযোগ জানালে উদ্ভট প্রশ্ন করা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের এবং কেসগুলিকে দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়।

আরও পড়ুন- যাদবপুর কাণ্ডে বেকায়দায় ব্রাত্য, কেন চুপ তৃণমূল?

RSF-এর সৃজন দত্তের কথায়, ২০১৭ সালে যাদবপুরে ইউনিয়ন ইলেকশন হয়েছিল। সেই সময়ও লাগাতর আন্দোলন করে আবার ২০২০ সালে ইলেকশন করানো হয় কিন্তু তারপর পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে কোনও নির্বাচন হয়নি। এত বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ফ্যাকাল্টি ও তার তিনটি ইউনিয়ন। ইলেকটেড ইউনিয়ন না থাকায় অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নানা সমস্যার মোকাবিলা করা যাচ্ছে না কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই ছাত্রদের। শুধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাজ্যের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও ইউনিয়ন ইলেকশন বন্ধ করে রেখেছে তৃণমূল। এই নিয়েই মূলত ছাত্রদের ক্ষোভ। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সরকার ও ছাত্রদের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের দাবিতে ব্রাত্য বসুর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল ছাত্ররা।

প্রসঙ্গত যাদবপুর কাণ্ডে ছাত্রকে গাড়িতে চাপা দিয়ে গুরুতর আহত করার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলতে চায় বামেরা। ব্রাত্য বসুর গ্রেফতারির দাবি তোলা হয়েছে বামেদের তরফে। শিক্ষামন্ত্রী ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি বলেই যাদবপুরে এই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি বলে যখন দাবি করছে ছাত্ররা, সেই নিয়ে নীরবতা ভেঙেছেন ব্রাত্য বসু। তিনি বলেছেন, “আমি তো কথা বলতেই চেয়েছিলাম। বলেছিলাম জনা চারেক আসুন, কথা বলব। আমি কোনও ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিতে চাইনি। আলোচনা চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা বলল ৪০ জনের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। সেটা হয় নাকি! তারপরের ঘটনা ক্যামেরার সামনে ঘটেছে। সকলে দেখেছেন। যাদবপুরে শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যা ঘটেছে তা আসলে নৈরাজ্য তৈরির চেষ্টা। শারীরিক সন্ত্রাস। বর্বরতা।” যদিও ছাত্রদের দাবিগুলি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কী ভাবনা, তিনি আদৌ কোনও ভূমিকা গ্রহণ করবেন কিনা তা নিয়ে কোনও কথাই বলেননি।

More Articles