একা জোশীমঠ নয়, তলিয়ে যেতে চলেছে হিমালয়ের এই বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্রগুলিও!
Joshimath Landslide: নৈনিতাল শহরটি কুমায়ুন হিমালয়ে অবস্থিত এবং ২০১৬ সালের একটি রিপোর্ট জানান দিচ্ছে, শহরের অর্ধেক এলাকা ভূমিধসের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসাবশেষে ঢাকা।
উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠ তলিয়ে যাচ্ছে। তাই তড়িঘড়ি সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাসিন্দাদের। নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে পাহাড়ি মানুষদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে সরকারের তৈরি অস্থায়ী কেন্দ্রে। তবে জোশীমঠ থেকে মানুষ সরিয়ে নিলেই কি বিপর্যয়কে রোখা যাবে, মানুষের প্রাণ আর প্রকৃতির ভার দুই রক্ষা করা যাবে? যাবে না। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছেন, জোশীমঠ কোনও নিরবিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জোশীমঠের মতোই, হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত আরও কয়েকটি শহর ভূমিধসের মুখে পড়তে চলেছে, যাদের মধ্যে অন্যতম হলো নৈনিতাল।
পার্বত্য অঞ্চলের ভূতত্ত্ব বিবেচনা না করেই মানুষের উন্নয়নের জন্য নানা কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়া ভূমিধসের সবচেয়ে বড় কারণগুলির মধ্যে একটি। সাম্প্রতিক অতীতে অবিরাম বৃষ্টিপাত এবং বন্যার কারণে জমি দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং ক্ষয়ের কারণে জোশীমঠ এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে মানুষের জন্য, মানুষের তৈরি নির্মাণকার্যই সবচেয়ে বেশি দায়ী।
পরিস্থিতি আকস্মিকভাবে খারাপ হয়ে যাওয়ার পিছনে প্রধান কারণ হল মেইন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট বা MCT-2-এর ফের সক্রিয় হয়ে ওঠা। এটি একটি চ্যুতি যেখানে ভারতের টেকটনিক প্লেট হিমালয় বরাবর ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে চেপে গিয়েছে। "এই MCT-2 জোনটি ফের সক্রিয় হয়েছে, যার ফলে জোশীমঠের মাটি ডুবে যাচ্ছে এবং এই জাতীয় ঘটনা কবে, কখন ঘটবে তা কোনও ভূতাত্ত্বিকই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন না। আমরা দুই দশক ধরে সরকারকে সতর্ক করে আসছি কিন্তু এখনও পর্যন্ত সবই উপেক্ষা করা হয়েছে। ভূতত্ত্বের সঙ্গে আপনি যুদ্ধ করতে পারবেন না। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষ জয়ী হতে পারবে না,” ইন্ডিয়া টুডে-কে বলেছেন কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক ডাঃ বাহাদুর সিং কোটলিয়া। তিনি জানিয়েছেন, জোশীমঠই নয়, নৈনিতাল, উত্তরকাশীও একই বিপদের মুখে।
আরও পড়ুন- চিরতরে তলিয়ে যাচ্ছে জোশীমঠ! বন্ধ হোটেল, কেন বাড়ি ঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন মানুষ?
জোশীমঠের মতোই, নৈনিতালও নির্মাণকার্যের বাড়াবাড়ি, অনিয়ন্ত্রিত হারে পর্যটন বৃদ্ধির সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই শহরটি কুমায়ুন হিমালয়ে অবস্থিত এবং ২০১৬ সালের একটি রিপোর্ট জানান দিচ্ছে, শহরের অর্ধেক এলাকা ভূমিধসের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসাবশেষে ঢাকা।
২০০৯ সালের বালিয়া নালা ভূমিধস বিশ্লেষণ করে শহরের দুর্বলতার দিকটি চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বিশ্লেষণ বলছে, এই ধরনের বিপর্যয়ের অন্যতম মূল কারণ হল এলাকাটির ঢাল। বেশিরভাগ অঞ্চলেই এখানে খুব খাড়াই ঢালের। দ্বিতীয়ত, এই এলাকার টেকটোনিক প্লেট এবং ভূমি ধসের ফলে শিলা বা পাথরের প্রকারগুলিও খুব প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে বিপর্যয়ে।
এই ধরনের ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি বা থ্রাস্ট যদি ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে, তাহলে মানুষ কোনওভাবেই তা বন্ধ করতে পারবে না। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং এটি যেকোনও এলাকার দুর্বল অঞ্চলকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকবে। বাঁচার কয়েকটি মাত্র বিকল্প আছে। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির প্রকৌশল ব্যবহার করে এই ধরনের বিপর্যয়ের মোকাবিলা।
ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অব জিওলজি এবং গ্রাফিক এরা হিল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা নৈনিতালের আশেপাশের এলাকার একটি ভূতাত্ত্বিক গবেষণাতেও একই ধরনের বিষয় লক্ষ্য করেছেন। গবেষণায় নিশ্চিত করেই বলা হয় যে, এই অঞ্চলে প্রধানত শেল, স্লেট আর চুনাপাথর রয়েছে যা নৈনিতাল হ্রদের চ্যুতির কারণে অত্যন্ত গুঁড়ো গুঁড়ো এবং আবহাওয়ার প্রভাবে ক্ষয়ে যাওয়া। এই শিলা এবং উপরিভাগের মাটির শক্তি খুবই কম।
ফলে জোশীমঠে যা দেখা যাচ্ছে, খুব সহজে এবং তাড়াতাড়িই নৈনিতাল, উত্তরকাশী এবং চম্পাওয়াতে এই ঘটনা ঘটতে চলেছে। এই সমস্ত জায়গাই ভূমিকম্পপ্রবণ, ফলে যে কোনও সময় এই ফল্টলাইন বা চ্যুতিরেখা সক্রিয় হয়ে যেতে পারে। জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি এবং নির্মাণকার্যের ফলে এই শহরগুলির জমির কোনও ধারণ ক্ষমতাই নেই, খুব দুর্বল তারা।
আরও পড়ুন- একটু একটু করে ডুবছে আস্ত শহর! কনকনে ঠান্ডায় রাস্তায় জোশীমঠের মানুষ
সংবাদ সংস্থা এএনআই এর তথ্য বলছে, জোশীমঠের প্রায় ৫৬১টি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। সিংধর এবং মারওয়াড়িতে ফাটল বাড়ছে। বন বিভাগের চেকপোস্টের কাছে সিংধর জৈন এলাকা এবং মারওয়াড়িতে জেপি কোম্পানি গেটের কাছে বদ্রীনাথ জাতীয় সড়কে ক্রমাগত ফাটল ধরছে, প্রতি ঘণ্টায় এই ফাটল বাড়ছে। ২০২৩ এই যে প্রথম এই ঘটনা ঘটেছে এমনটা মোটেও না। ২০২১ সালে যখন চামোলিতে বেশ কয়েকটি ভূমিধস দেখা দেয় তখনই ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। বাসিন্দারা কাঠের খুঁটি ব্যবহার করে বাড়ি ঘরকে ঠেস দিয়ে রাখতে শুরু করেন। পরের বছরও, মানে ২০২২ সাল জুড়ে প্রায়ই ভূমিকম্প দেখা দেয়। গতবছরই উত্তরাখণ্ড সরকার বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল তৈরি করে। এই বিশেষ দলটিই জানিয়েছিল, জোশীমঠের বেশ কয়েকটি অঞ্চল মনুষ্যসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক কারণে তলিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, ভূপৃষ্ঠের উপাদান, মানে জঙ্গল জমি ইত্যাদি সরিয়ে বা খনন করে বসতি স্থাপন হয়েছে, শহর, হোটেল ও অন্যান্য নানা কাঠামো গড়ে উঠেছে। পাথরে প্রাকৃতিক চ্যুতির কারণেও জোশিমঠের প্রায় সমস্ত ওয়ার্ডের ক্ষতি হয়েছে। সারা শহরটিই আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে। গত বছর জোশীমঠ পৌরসভা একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, এক বছরে শহরের ৫০০ টিরও বেশি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। জোশীমঠের গান্ধীনগর, রবিগ্রাম এবং সুনীল এলাকায় ৪০ টিরও বেশি পরিবার বাড়ির ভাঙন আটকাতে কাঠের খুঁটি দিয়ে কোনও মতে বাড়ি ধরে রেখেছে।
প্রাকৃতিকভাবে এত দুর্বল জায়গায় বারেবারে নানা সতর্কতা সত্ত্বেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। অতিরিক্ত নির্মাণ, টানেল কাটা, শহরের বৃদ্ধির কারণে এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড়সড় ভূমিধস হয়েছে। CSIR-এর প্রধান বিজ্ঞানী ডিপি কানুনগো জানিয়েছেন, ২০০৯ থেকে ২০১২ অবধি চামোলি-জোশীমঠ অঞ্চলে ১২৮ টি ভূমিধস ঘটেছে!
টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালের মিশ্র কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করে। প্রায় ৫০ বছর আগেই ওই রিপোর্টে সতর্ক করা হয়েছিল যে, এমন তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটবে অচিরেই। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাস্তা মেরামত এবং অন্যান্য নির্মাণের জন্য, পাহাড়ের পাশে খনন বা ডায়নামাইট বিস্ফোরণ করে পাথর সরানো যাবে না। এই পাহাড়ের গাছগুলিকে শিশুদের মতো লালন-পালন করতে হবে। এসব সুপারিশ যে ফাইলবন্দি হয়েই পড়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।